আরেক 'ছুটির ঘণ্টা'

দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের সমাপ্তি টেনে ঢাকায় যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর। মনে দারুণ প্রশান্তি আর চোখেমুখে খুশির আভা, বাড়ি চলে এলাম বলে। কিন্তু না, সবেতো ঢাকায় এলাম, বাড়ি পৌঁছতে আরও ৬-৭ ঘণ্টা বাকি। আমার ভাগনি জামাই ব্যাংকার রউফের সঙ্গে কথা হয়েছিল অভ্যন্তরীণ বিমানে সিলেটে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু তা আর হয়নি, রউফ জানাল; নোয়া ব্র্যান্ডের গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে আপনারা নিরাপদে সুনামগঞ্জ পৌঁছতে পারবেন আমার অতি পরিচিত চালককে নিয়ে।
অভিবাসনের ঝামেলা চুকিয়ে বাইরে এসেই দেখা পেলাম রউফের। সঙ্গে তাঁর এক চাপরাসি আমাদের মালামাল ছিল অনেক, তাই তাঁদের সহায়তা পেয়ে খুবই উপকৃত হলাম। আমি, আমার স্ত্রী আর সঙ্গে আছে আমাদের এক ছেলে। দেশে এলাম ছেলেকে বিয়ে দেব বলে, তাই এত বাক্স-পেট্রার সমারোহ। সব প্রস্তুতি শেষ করে এবার যাত্রা শুরু সুনামগঞ্জের পথে। বিমান বন্দর পেরিয়ে আসতেই পথে চালক বলল আজ বিশ্ব ইজতেমার শেষ দিন।
আখেরি মোনাজাত চলছে। তাই বিরাট যানজট। দেখলাম রাস্তার পাশে দোকানে দোকানে সবাই মোনাজাতে শামিল হয়েছে, টঙ্গী থেকে শহরের বিভিন্ন স্থানে মাইক সংযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে, মনে হলো পুরো ঢাকা শহর এক আধ্যাত্মিক নগরীতে পরিণত হয়েছে। চালক যানজট এড়াতে ব্যস্ত হলো। গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সিএনজি চালিত বেবিট্যাক্সি আমাদের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ধোঁয়া আর শব্দের প্রতিযোগিতা করছে—চারদিকে বাস, টেম্পো, বেবিট্যাক্সি গিজগিজ করছে। এত ধোঁয়া যে মনে হলো আজকের শীত ঋতুর সুন্দর দিনটা একেবারে ধূসর হয়ে গেছে। আরেকটু দূরের যানজটের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়াচ্ছন্ন রাস্তা দেখে মনে হলো সামনে কোথাও আগুন লেগে গেছে।
মনে হলো এই তো আমার দেশ, নানান রঙের বর্ণচ্ছটায় বর্ণিল। সকালের রোদ ছিল কমলা রঙে রাঙা। দুপুরে ধুলো আর ধোঁয়ায় ধূসর; বিকেলে হয়তো ঘষা স্লেটের মতো ধূসর কালো আকাশ। আরও কিছু পথ এগুলোই আমন ধানের মৌ মৌ গন্ধ, কিংবা ধানখেতের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীতে পালতোলা নৌকা—এইতো আমার দেশ আমার সোনার বাংলা দেশ। অনেক স্মৃতি বিজড়িত ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চারপাশের দৃশ্য দেখে দেখে এক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। চালককে জিজ্ঞেস করলাম এখন আমরা কোথায়। চালক বলে, স্যার এটা তেলিয়াপাড়া। অনেক দিন পরের দেখা তেলিয়াপাড়া, দৃশ্যপটের অনেক পরিবর্তন। চালককে বললাম গাড়ি থামিয়ে একটু চা খাওয়া যাক। কিন্তু চালক জানাল জায়গাটা খুবই ভয়ংকর, এখানে গাড়ি থামানো যাবে না। শুনে আমার স্ত্রীও চালকের কথায় সায় দিয়ে বলল, না চা খাওয়ার দরকার নেই। আমিও নিরুৎসাহিত হলাম। এবার সত্যিই আমার মনেও ভয়ের উদ্রেক হলো। কারণ আমাদের সঙ্গে ছেলের বিয়ের জন্য ক্রয় করা শাড়ি-গয়নাসহ অনেক মূল্যবান সামগ্রী এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ ডলারও রয়েছে।
কারও মুখে কোনো কথা নেই। আমরা তিনজনই এক অজানা আতঙ্কে জড়সড়। মনে হচ্ছে এই বুঝি একদল ডাকাত এসে বন্দুক হাতে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াবে। এক সময় আমার স্ত্রী ও ছেলেকে ফিশ ফিশ করে বললাম সঙ্গের ডলারগুলো গাড়িতে ব্যবহৃত পাপোশের নিচে রেখে দিতে। কথায় বলে সাবধানের মার নেই। ওরা তাই করল। চালককে কিছুই বুঝতে দিলাম না। কে জানে চালক যদি কোনো ডাকাত দলের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়।
যাক এক সময় সব চিন্তার অবসান করে আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। সুনামগঞ্জে কদিন কাটিয়ে ঠিক করলাম সিলেটে বাসা নিয়ে থাকব। সিলেটে চমৎকার ফার্নিশড্ বাসা ভাড়ায় পাওয়া যায়। আমাদের দীর্ঘ স্মৃতিবিজড়িত দরগাহ মহল্লায় চার বেড রুমের একটি বাসা পাওয়া গেল। আমার বোন গৃহপরিচারিকা হিসেবে লাভলীর মাকে নিয়ে আসলেন। তারপর শুরু হলো ঘটকের মাধ্যমে পাত্রী দেখার পালা, সঙ্গে ঘটকের দৈনিক মহড়া।
প্রথমে পুরুষ ঘটকের দৌরাত্ম্যে একেবারে অতিষ্ঠ। মাঝেমধ্যে শুরু হলো মহিলা ঘটকের আধিপত্য। ভোরবেলা দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে দেখি এক মহিলা দাঁড়িয়ে। পরিচয় চানতে চাইলে মহিলা বলেন, তিনি একজন উকিল। আমি যেন আঁতকে উঠলাম। তারপর বললাম, আমার তো কোনো মামলা-মোকদ্দমা নেই, সুতরাং আমি কোনো উকিলও নিযুক্ত করিনি, আপনি হয়তো ভুল ঠিকানায় চলে এসেছেন। উকিল মহিলা বললেন, না না আমি সেই উকিল নয়। আমি হলাম ঘটক উকিল। পরিচয় দিয়েই আমার বসার ঘরে চলে এলেন। তারপর ব্যাগ খুলে বের করলেন কয়েকটা খাম। তাতে শুধু বিবাহ উপযোগী পাত্রীদের ছবি। সঙ্গে নাম-ঠিকানা ও খান্দানের পরিচয়। আমি হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তারপর মহিলাকে আপ্যায়িত করে বিদায় দিলাম। পরে অবশ্য ঘটকদের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি পেলাম নিজেদের পছন্দমতো বিয়ের মাধ্যমে।
ছেলের বিয়ে উপলক্ষে অনেক আত্মীয়স্বজনের সমাগম হলো; কমিউনিটি সেন্টার লোকে লোকারণ্য। কেউ আসলেন রঙিন কাগজে মোড়ানো উপহার হাতে নিয়ে। সবাই অনেক আয়েশ করে খেয়েছেন। যাওয়ার সময় পান চিবোতে চিবোতে কেউ কেউ হয়তো বলেছেন, রোস্টটা ভালো হয়নি। কমিউনিটি সেন্টারে এসি থাকলে ভালো হতো। সচরাচর আলাপচারিতার অংশবিশেষ এই আর কি।
আমাদের লাভলীর মাও ছিল অনেক খুশি। ছেলের বিয়ের শুরু থেকেই বেচারী অনেক কষ্টে সবকিছু সামাল দিয়েছে। ষাটোর্ধ্ব বয়সী
এই মহিলার জীবনটা অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র মেয়ে লাভলীকে নিয়ে জীবনটাকে সে দেখে নিয়েছে কাচের আরশিতে। তিল তিল করে মেয়েকে বড় করে পাত্রস্থ করেছে। এখন সে বলতে গেলে ভাবনামুক্ত, ষাটোর্ধ্ব বয়সটা তাকে কাবু করতে পারেনি মোটেও। পাতলা চিকন গড়নের মেদবিহীন দেহে তিনি দিব্যি আছে। রোগবালাই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।
দেখতে দেখতে আমাদের টিকিটের অতিরিক্ত সময়টা জানান দিচ্ছে আবার ফিরে আসতে হবে প্রবাসী জীবনে। ঠিক হলো সদ্য বিবাহিত ছেলে আর ছেলের বউকে রেখে আমরা ফিরে আসব। তাদের সঙ্গে লাভলীর মা তো থাকছেই।
ভেতরে এক ধরনের হাহাকার প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে, আত্মীয়স্বজন ছেড়ে, চলে যেতে হবে সুদূর প্রবাসে। না গিয়েও উপায় নেই। কারণ ওখানেও আমাদের তিন সন্তান। নাতি-নাতনি রেখে এসেছি; তাই ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতিকে সামনে রেখে সন্ধ্যায় স্ত্রীকে নিয়ে বের হয়েছি জিন্দাবাজারে কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। ছেলে নতুন বউকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। লাভলীর মা বাসায় আছে দেখে আমরা নিশ্চিন্তে বেরিয়ে গেলাম সঙ্গে চাবি নেওয়ার কোনো প্রয়োজনই মনে করিনি। এদিকে আমার স্ত্রীর মনে দারুণ উৎকণ্ঠা। তিন সন্তানকে নিউইয়র্কে রেখে আসাই এই উৎকণ্ঠার কারণ। তার ওপর আর এক উপসর্গ দেখা দেয়, দেশে আসার পরপরই শ্বাসকষ্ট যোগ হয়। বড় করে শ্বাস নিলেও তাঁর বুক ভরে না। মনে হয় ফুসফুসের একটি অংশে বাতাস যাচ্ছে না।
প্রায় দু ঘণ্টার মতো বাইরে কাটিয়ে আমরা বাসায় চলে আসি। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে না উঠতেই শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি এই ভেবে যে ঝড়বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই বাসায় আসতে পেরেছি। দরজার সামনে এসে কড়া নেড়ে জানান দিলাম আমরা চলে এসেছি। লাভলীর মা তুমি দরজা খোল। কিন্তু লাভলীর মা তো দরজা খুলছে না, আবার কড়া নাড়া, আবার দরজায় খটখটানি আওয়াজ। না তবুও ভেতর থেকে লাভলীর মার কোনো সাড়া নেই। ভাবলাম বাইরে বৃষ্টি আর ঝড়ের শব্দে হয়তো ভারী দরজা ভেদ করে আওয়াজ ভেতরে যাচ্ছে না। তা না হলে বেচারি দরজা খুলতে এত দেরি করত না। এদিকে আশপাশের ফ্ল্যাট থেকে লোকজন বেরিয়ে এল। সবাই উপদেশ দিতে লাগলেন। একজন বাড়িওয়ালাকে ফোন দিন। তার কাছে নিশ্চয়ই চাবি আছে। আরেক জন বলেন পুলিশকে খবর না দিয়ে বাড়িওয়ালার মাধ্যমে দরজা খুলতে যাবেন না। মনে মনে ভাবলাম, এতে আবার পুলিশের কথা উঠছে কেন! বাঘে ছুঁলে এক ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। কী যে ঝামেলায় পড়লাম আল্লাহ ভালো জানেন। আমার মুখে কোনো কথা উঠছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। বিপদে পড়ে যেন সব জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে। হঠাৎ মনে হলো স্থানীয় কমিশনারের কথা। এক কালে খুবই পরিচিত লোক ছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে বাড়িওয়ালা এসে হাজির। সব শুনে তিনি দরজা খুলতে উদ্যত হলেন। আমি বাঁধা দিয়ে বললাম দরজা খোলার আগে কমিশনারকে জানানো উচিত। বাড়িওয়ালা আমার সঙ্গে একমত হলেন। তার পর বাড়িওয়ালাকে সঙ্গে নিয়ে কমিশনারের শরণাপন্ন হলাম। বিস্তারিত ঘটনা শুনে কমিশনারও পুলিশ ডাকার পরামর্শ দিলেন। তারপর তিনি নিজেই পুলিশকে ফোন দিলেন। কমিশনার সাহেবের ফোন পেয়ে টহলরত পুলিশের একজন সাব ইন্সপেক্টর দুজন কনস্টেবল নিয়ে ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই হাজির হলেন। এসেই পুলিশ অফিসার প্রশ্ন করলেন। কই উনি কই। কমিশনার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন এই যে উনি। পুলিশ অফিসারটি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন আমি একজন পেশাদার খুনি। তারপর হাতের ওয়াকিটকি বেশ কায়দা করে হাত বদল করে কমিশনারের কাছে একটা সাদা কাগজ চাইলেন। মনে হলো আমাকে আসামি করে একটা জিডি তৈরি করে ফেলবেন। খানিক ভেবে বললেন থাক সাদা কাগজ লাগবে না। চলেন ঘটনাস্থলে যাওয়া যাক। কমিশনার সাহেবসহ চলে এলাম বাসায়। তারপর পুলিশ অফিসার বাড়িওয়ালাকে আদেশ দিলেন দরজা খুলতে। মুহূর্তেই আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে মাথা থেকে সব গরম বালির উত্তাপ বেরোচ্ছে। ভাবছি দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে হয়তো দেখব লাভলীর মার লাশটা পড়ে আছে মেঝেতে। তারপরই শুরু হবে পুলিশি তৎপরতা। আমি হব আসামি, কোর্ট, কাচারি, নিউইয়র্ক ফিরে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে। কত শত ভাবনা মনে মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে। ইতিমধ্যে বাড়িওয়ালা তাঁর সঙ্গে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খোলেন। পুলিশসহ আমি কালবিলম্ব না করে ভেতরে ঢুকে লাভলীর মাকে চিৎকার করে ডাকতে থাকি। এক সময় রান্নাঘরের বাইরে থেকে মৃদু গলার শব্দ শুনতে পাই। আমি তৎক্ষণাৎ রান্না ঘরের বাইরের দরজা খুলে লাভলীর মাকে উদ্ধার করি। সে বলছে রান্না ঘরের বাইরে গ্রিলে কিছু কাপড় শুকাতে দিয়েছিল। বৃষ্টি আসার সঙ্গে সঙ্গে কাপড়গুলো তুলে আনতে দরজার বাইরে যেতেই হঠাৎ তীব্র ঝোড়ো বাতাসে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর অনেক চেষ্টা করেও দরজা খুলতে পারেনি। সব শুনে পুলিশ অফিসার বললেন, ও তাহলে নাটকের এই কাহিনি। তারপর আমাকে বললেন, আপনি কি কাজের মহিলা আর পাননি। ষাট বছরের এক বুড়িকে বেছে নিলেন! বুঝলাম পুলিশ অফিসার খুবই নাখোশ হয়েছেন, তাই আমাকে রসিকতার ছলে মৃদু একটা ঝাড়ি দিতে ছাড়লেন না।