পেলাম নতুন জাতীয় সংগীত

সুরমা নদীর ওপারে লেলিহান আগুনের শিখা ক্রমেই উঁচু হয়ে উঠছে। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে গুলি হচ্ছে। আব্বা বললেন, আকমল চাচাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা। উনি নুরজাহান সিনেমা হলের মালিক। দ্রিমদ্রিম শব্দ। কেঁপে কেঁপে উঠছে চারদিক। ভয়ে সবাই খাটের নিচে লুকিয়ে পড়েছি। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন করার যুদ্ধ। আমার বয়স তখন আট বছর।
কয়েক দিন আগেও আরতি মাসির সঙ্গে সঙ্গে আমি নীতা আর সিপি শহর প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ে যেতাম।
আমরা বুকের কাছে স্লেট আর বই জড়িয়ে ধরে মাসিমার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম। সিপি ফোরে, আমি আর নীতা থ্রিতে পড়ি। সরস্বতী পূজার আগে বরই গাছের বরই খাই না। পূজার আগে নাকি খেতে নেই। পূজার প্রসাদ বানানোর কাজে হিন্দু মেয়েরা হাত লাগায় শিক্ষকদের সঙ্গে। আমরা ওদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বোরখা দিদি। মুসলিম কিন্তু মহাসমারোহে সরস্বতী পূজা হয়। মাইক ভাড়া নিয়ে গান বাজানো হয়। কিছু সময় পরপর মেয়েরা বলে...‘বীণাপাণি কী, জয়’। ‘সরস্বতী মাই কী, জয়’। আমরা প্রসাদ খেয়ে সব পূজামণ্ডপ দেখে বেড়াই। এইচএমপি, বুলচান্দ স্কুল, কলেজ। নকুলদানা, বাতাসা, গজা, প্যাড়া সন্দেশ, কুটি নিমকি পূজার প্রসাদ।
স্কুলের অ্যাসেমব্লির সময় তখন প্রথমে গাইতে হতো

‘পাক সার জমিন সাদ বাদ
কিশওয়ারী হাসিন সাদ বাদ
তুমি সানি আজমী...!
আর দ্বিতীয় অংশে গাইতাম

‘পূর্ব বাংলার শ্যামলিমায়
পঞ্চ নদীর তীরে অরুণিমায়
পাকিস্তান ...জিন্দাবাদ
পাকিস্তান... জিন্দাবাদ।’
আমাদের ছোট্ট শহর। যেখানে মায়া-মমতায় জড়াজড়ি করে আমরা হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই বসবাস করি। পূজা সংক্রান্তিতে আরতি মাসি, শান্তি মাসি, বাণী মাসি, কিরণ মাসি, প্রশান্তি দিদিদের বাসায় যাই। সন্দেশ, নারকেলের বরফি, পিঠাপুলি খাই। আবার ঈদের সময় আমাদের বাসায় সেমাই, পুডিং, কেক খাওয়ার দাওয়াত থাকে টিংকু, জয়া, সিপি, নীতা, গৌতম, অর্পাদের। আবার বড়দিনে ধ্রুব কাকুদের বাসায় কেক খেতে যেতেই হতো। রমজান মাসে ইফতার আসে অক্ষয় মিনিস্টার কাকু, আরতি মাসি, দীপালি মাসি, শান্তি মাসির বাসা থেকে। এই সুন্দর সাজানো শহর হায়েনার কবলে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেল! আমার বন্ধুরা সব ভারতের বালাটে চলে গেল। আর প্রতি রাতে আগুনে পুড়ে যেতে লাগল আমার বন্ধুদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর। তামান্নাদের বাড়ি, তাহমিনা, সারাদের বাড়ি। একদিন দুপুরবেলা কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উঠল আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী খসরু ভাইদের বাসা থেকে। সেদিন দিনের বেলায় জ্বালিয়ে দিল লিজি খালাদের বাড়ি। কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে ওঠে। আমাদের বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে যায়। আব্বার কোলে শুয়ে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদি। এই বাড়িগুলোর সঙ্গে আমাদের ছেলেবেলার কত স্মৃতি জড়িয়েছিল।
আমার বুকের ভেতর কী যে কষ্ট উথাল-পাথাল করতে লাগল। আমি মনে মনে সারা দিন পাঞ্জাবি সেনা নিধন করি। আমার বন্ধুর বাবারা সবাই কোন না কোনভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত।
যুদ্ধ চলাকালে সুরমা নদী দিয়ে নৌকায় করে দুবার আমরা গ্রামে পালিয়ে গেলাম। এখন যখন ‘শ্যামলছায়া’ আর ‘জয়যাত্রা’ সিনেমা দেখি তখন মনে হয় এত সিনেমা নয়।এত আমাদের জীবনের ঘটনা প্রবাহ।
দিন রাত ঘরে বন্দী। খেলতে পারছি না, স্কুলে যেতে পারি না। রাতের বেলাটা বিভীষিকাময়। ব্ল্যাকআউটের জন্য একটা ঘরে কম পাওয়ারের আলো জ্বলে। তাও আবার কালো ভারী কাগজে মুড়ে দেওয়া, যাতে আলো বাইরে ছড়াতে না পারে। রাতের অন্ধকারে রেডিওতে আব্বা–আম্মা আর মেজ ফুফু আম্মারা ‘বিচ্ছু বাহিনী’, এ রকম কী যেন শোনেন। এর ভেতরেই একবার দিন তারিখ মনে নেই, নানু মোক্তার খালু আসলেন আমাদের বাসায়। তিনি সারার আব্বা। হাফপ্যান্ট পড়া, হাতে স্টেনগান। আম্মা চেয়ার এগিয়ে দিলেন, কিন্তু উনি মাটিতে বসে পড়লেন। আমার দেখা প্রথম মুক্তিযোদ্ধা। উনি সারাদের ভারতে পাঠিয়ে যুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। ওরা কে, কোথায় তাও জানতেন না। কখনো হাসলেন, কখনো কাঁদছিলেন। বুঝতে পারছিলাম জীবনটা খুব ভালোভাবে যাচ্ছিল না। কিন্তু কতখানি খারাপ যাচ্ছিল তা বুঝতেও পারিনি।
একদিন ভোরে অনেক শোরগোল। ওই দিন ছিল ৬ ডিসেম্বর। দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে আসছে। জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত চারিদিক। সুনামগঞ্জ স্বাধীন হলো। মালেক চাচা, হাশিম ভাই, নেক ভাই, সুজাত ভাই আরও কত নাম জানা–অজানা মুক্তিযোদ্ধা ফিরে আসছিলেন।
‘এক সাগরই রক্তের বিনিময়ে
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলব না’ ।।
বৃহস্পতিবার স্কুল ছুটির আগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দীপালি নামের ক্লাস থ্রির মেয়েটি যখন এই গানটি গাইল, তখন নিজের অজান্তেই অশ্রুসজল হই। অটো প্রমোশন পেয়ে থ্রি থেকে ফোরে উঠছি। আমার বন্ধুরা অনেকেই ফিরে এসেছে। শুধু ফিরল না নীতা। নীতার সঙ্গে আর কখনো কি দেখা হবে? নীতার জন্য আমার বুকে জমতে থাকে দীর্ঘশ্বাস।
আমরা এখন স্বাধীন। উর্দু গান আর না বুঝে গাই না। গাওয়ার জন্য বাধ্য করা হয় না। অ্যাসেম্বলিতে আমরা এখন গাই

‘আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি’।।