বিজয়ের মাসে 'শিক্ষার মৃত্যু'

“শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা” শীর্ষক সংবাদটি এ মুহূর্তে অন্যতম বহুল আলোচিত বিষয়। বিজয়ের আনন্দ, গর্ব আর শহীদদের স্মৃতি নিয়ে যখন আমরা দেশ গড়ার শপথ নিচ্ছি তখন এক কোমলমতি কিশোরীর অপমৃত্যু আমাদের বিমর্ষ করে, শোকাহত করে, এবং আমরা এক অন্ধকার ভবিষ্যতের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হই। আমাদের আগামী প্রজন্ম কি শিক্ষা পাচ্ছে, আলোকিত হচ্ছে? দেশ এগিয়ে নিয়ে যাবে কারা তবে?
অরিত্রি অধিকারী নামের ঢাকার ভিকারুননিসা স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রীর বিরুদ্ধে বার্ষিক পরীক্ষায় নকলের অভিযোগে তার অভিভাবকদের ডেকে এনে অপমান করা হয়। সে রাতেই অরিত্রি বাসায় নিজেকে হননের কঠিনতম পথ বেছে নেয়। এ মৃত্যুর দায়ভার কার? সমালোচনার তির এখন বিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের প্রতি। আলোচনা থেকে বাদ যাচ্ছে না অভিভাবকের সচেতনতা এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দৈন্য। আমি এর সঙ্গে যোগ করতে চাই নতুন প্রজন্মের মানসিক বিকাশ ও হতাশা।
পুরো বিষয়টির দায়ভার আমাদের সমাজব্যবস্থার। প্রধানত শিক্ষাব্যবস্থার। আমাদের শিক্ষা বহুদিন থেকেই মুখস্থবিদ্যা নির্ভর। গাদা গাদা মোটা মোটা বই আমরা শিক্ষার্থীদের কাঁধে চাপিয়ে দিই। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের বাণিজ্য চিন্তা কোনো শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে না। নেই কোনো মেধা বা সৃজনশীলতার স্থান। বিদ্যালয়ের ছুটি শেষে শিক্ষার্থীরা ছোটে কোচিং সেন্টারে বা প্রাইভেট টিউটরের কাছে। এরপর রয়েছে বছর শেষে ভয়াবহ বার্ষিক পরীক্ষা। শিক্ষার্থীদের জীবনে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে এ পরীক্ষা। নির্দিষ্ট ২-৩ ঘণ্টা সময়ের সীমানায় সারা বছরের সব মুখস্থবিদ্যা উগলে দিতে হবে। আর সে পরীক্ষার তথাকথিত ফলাফল একজন শিক্ষার্থীর জীবনের প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়। সে কীভাবে সমাজে বেঁচে থাকবে, কী উপার্জন করবে, কেমন সংসার করবে, কেমন জীবন যাপন করবে, সব সিদ্ধান্ত একটি পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণ করবে। একটি সমাজ, একটি দেশ নির্ভর করছে শুধু পরীক্ষার ফলাফলের ওপর। তাই পরীক্ষার ফলাফল সংবাদমাধ্যম ও জাতীয় আলোচনার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরীক্ষার ফলাফলে কেউ কেউ আনন্দোল্লাস করে, আবার কেউ নীরবে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
অতএব, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন—সবারই দৃষ্টিপাত একমাত্র পরীক্ষার ফলাফলে। পরীক্ষার ফলাফল ভালো হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনাম ও বাণিজ্য, শিক্ষকের প্রসার এবং অভিভাবকের তৃপ্তির হাসি। কিন্তু সবার অগোচরে হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও মানসিক বিকাশ। এ সুযোগেই ঢুকে পড়ছে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের নানাবিধ অনৈতিক পন্থা। প্রশ্নপত্র ফাঁস, নকল, নম্বর জালিয়াতি ইত্যাদি তো রয়েছেই। সেই সঙ্গে শিক্ষকের তথাকথিত ‘পরীক্ষার সাজেশন’ দেওয়াটা তো অনৈতিক। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই যখন অনৈতিক কার্যে লিপ্ত তখন একজন শিক্ষার্থীর অসাবধানতা বা অপরিপক্বতার কারণে অসদুপায় অবলম্বনে ধরা পড়লে শুধু তার ওপর খড়্গ নেমে আসবে কেন? নকল তো সবাই করছে, কেউ চিরকুট থেকে, কেউ মুঠোফোন থেকে, আবার কেউ স্মৃতি থেকে। কেউ তো কিছু শিখছে না। যেখানে শেখার কোনো পরিবেশ নেই সেখানে নকল নিয়ে এত হইচই কেন? শিক্ষক ও প্রশাসনের যুক্তি মেনে নিচ্ছি, কেউ অন্যায় করলে তো তাকে শাস্তি পেতেই হবে। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে তো সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। অবশ্যই যুক্তিসংগত। কিন্তু যেখানে পুরো ব্যবস্থাই ত্রুটিপূর্ণ সেখানে একজনকে নকলের অভিযোগে বিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দেওয়াটা লঘু পাপে গুরুদণ্ডেরই শামিল। কিংবা নিজেদের দোষ ঢাকতে একজন শিক্ষার্থীকে বলি দেওয়া?
এখানে প্রধান সমস্যা দুটো। প্রথমত: শিক্ষাসূচিতে শিক্ষার্থীর কোনো স্বাধীনতা নেই, সৃজনশীলতার কোনো স্থান নেই, বিশ্লেষণের কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষার্থী কী বিষয় শিখবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার নেই, বরং সমাজ বেঁধে দেবে। শেখার সময় প্রশ্ন করার সুযোগ নেই, নতুন কিছু করার অধিকার নেই। মুখস্থ করা ছাড়া মেধার পরিচয় দেওয়ার আর কোনো মাধ্যম নেই। দ্বিতীয়ত: একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই একটি দু’তিন ঘণ্টার পরীক্ষায় কখনো করা যায় না। সারা বছর নানাবিধ কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে মেধার পরীক্ষা নিতে হয়। ছোট ছোট পরীক্ষা, সৃজনশীল প্রকল্প, দলীয় কাজ ও নেতৃত্ব প্রদান, পাঠ্যসূচির বাইরের জগতে অংশগ্রহণ, ইত্যাদি বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মেধা ও যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ করে দিতে হবে। এসবের ভেতর দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর আগ্রহ, প্রতিভা ও দক্ষতার বিষয় নির্ধারণের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এ সুযোগ নেই বলেই অধিকাংশ শিক্ষার্থী আলোকিত না হয়ে বরং আতঙ্ক ও হতাশায় ভোগে। এর ফলশ্রুতি হচ্ছে মাদকাসক্তি-জাতীয় নানা উপসর্গ। সমাজপতিরা তরুণ প্রজন্মের হতাশা রোগ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন, সমাধানের উপায় খুঁজতে ব্যতিব্যস্ত। কিন্তু সমস্যার মূলে কারও দৃষ্টি নেই। শুধু দু/একটি দুর্ঘটনায় আমরা জেগে উঠি, আলোচনার টেবিলে ঝড় তুলি। কিন্তু ভুলে যাই, পরীক্ষা ও আতঙ্ক নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে অনেক রকম দুর্ঘটনা ঘটছে নিয়মিতই। পরীক্ষার্থীর মানসিক ভারসাম্য হারানো থেকে আত্মহত্যার ঘটনা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। সেগুলো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না বলে আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।
অরিত্রির অপমৃত্যুর জন্য দায়ী সবাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন, শিক্ষক ও অভিভাবক। অরিত্রির নিজেরও কোনো মানসিক বিকার ছিল কিনা বা আরও কোনো ঘটনা তাকে এ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে ধাবিত করেছে কিনা, আমরা জানি না। শুধু জানি, একজন অভূত সম্ভাবনাময়ীর জীবনাবসান হলো, একটি আগামীর মৃত্যু হলো। সর্বোপরি মৃত্যু হলো শিক্ষার।

লেখক: অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, ফার্মিংডেল, যুক্তরাষ্ট্র