নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন

একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার পালাবদল হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। কারণ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জনগণকেই সব ক্ষমতার উৎস হিসেবে স্বীকার করে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত হয় সরকার।
বাংলাদেশ বর্তমানে নির্বাচনী আবহের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী মেয়াদে কে সরকার পরিচালনা করবে, তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনাকল্পনা। আবার বিভিন্ন মহল থেকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্যতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু এই সব চিরায়ত উদ্বেগের মধ্যে অনেকটা নিয়ম মেনেই নির্বাচন নিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন অনুচ্চারিত থেকে যাচ্ছে। নির্বাচন মানে তো ভোট। কিন্তু কাকে ভোট? উত্তর হচ্ছে প্রার্থী। কিন্তু এই প্রার্থী কে ঠিক করছে? উত্তর হচ্ছে প্রথমে দল, পরে দুর্নীতি, ঋণখেলাপি, মামলা, দণ্ড ইত্যাকার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নির্বাচন কমিশন এই প্রার্থিতা চূড়ান্ত করছে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন আসনের চূড়ান্ত মনোনয়নের বিষয়টি শুধু দলীয় হাইকমান্ডের ওপরই নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে জনগণ তো দূরের কথা, দলীয় কর্মীদের মতামত গ্রহণের কোনো বালাই নেই। এর ফলে ভোটের দিন জনগণের সামনে মার্কা বাছাই করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প সত্যিকার অর্থে থাকে না, যা জনপ্রতিনিধিত্বের ভিতটিকেই নড়বড়ে করে দেয়।
আমেরিকার দিকে তাকালে দেখা যায় ভিন্ন দৃশ্য। সেখানে প্রার্থিতা থেকে শুরু করে সবকিছুই একটি নির্বাচনী পদ্ধতিতে করা হয়। দলীয় মনোনয়ন পেতে হলে দলীয় নিবন্ধিত ভোটারদের সম্মতির প্রয়োজন হয়। প্রাথমিক নির্বাচনের মধ্য দিয়েই জনপ্রতিনিধিত্বের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এই পুরো প্রক্রিয়া জনগণকে একরকম অস্বীকারের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। ফলে চূড়ান্ত বিচারে এমন অনেক অঞ্চলই থাকে, যেখানে জনগণ হাজির হয় মন্দের ভালো বেছে নেওয়ার এক বাস্তবতায়। আর শেষ পর্যন্ত নির্বাচিত প্রার্থীও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকার বদলে দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতিই দায়বদ্ধ থাকেন। কারণ, তাঁর প্রার্থী হওয়া থেকে শুরু করে নির্বাচিত হওয়াটা ওই অংশটিরই আনুকূল্যে হয়েছে। ফলে জনগণের প্রশ্নটি তাঁর কাছে গৌণ হয়ে যায়।
বাংলাদেশে দলীয় মনোনয়নের চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তুলনামূলক জনসংশ্লিষ্ট। দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে যেখানে জনগণের মতামত গ্রহণের বিন্দুমাত্র প্রয়োজন পড়ে না, সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্দিষ্ট আসনের ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরসংবলিত মনোনয়নপত্র জমা দিতে হয়। এর অর্থ এই নয় যে, দলীয় প্রার্থীমাত্রই জনবিচ্ছিন্ন, আর স্বতন্ত্রমাত্রই জনসম্পৃক্ত।
একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে জনগণ তার যাবতীয় ভালো-মন্দের দায়ভার যাঁর বা যাঁদের ওপর ন্যস্ত করছে, তাঁদের প্রার্থিতার বিষয়েও মতামত দেওয়ার অধিকার জনগণের রয়েছে। না হলে পুরো নির্বাচনটিই দল ও মার্কা বাছাইয়ে পরিণত হয়। ফলে জবাবদিহির সংস্কৃতিটি গড়ে ওঠে না। আর জবাবদিহির সংস্কৃতি ছাড়া গণতন্ত্র নামসর্বস্বতায় পরিণত হয়।