মনের কারাগার থেকে মুক্ত কোহেন!

মাইকেল কোহেন। ছবি রয়টার্স
মাইকেল কোহেন। ছবি রয়টার্স

মাইকেল কোহেন একসময় বলেছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য তিনি গুলি খেতেও প্রস্তুত। আপাতত গুলি খাওয়া নয়, তাঁকে জেলখানায় ঢুকতে হচ্ছে, তাও তিন বছরের জন্য। গতকাল বুধবার নিউইয়র্কের একটি ফেডারেল আদালত ট্রাম্পের সাবেক এই আইনজীবীকে আয়কর ফাঁকি, কংগ্রেসের কাছে মিথ্যা বলা ও নির্বাচনী আইন ভঙ্গের অপরাধে এই দণ্ড দেন।

আদালতে কোহেন সপরিবারে এসেছিলেন। স্যুট-বুট পরেই, কিন্তু মুখখানা ঘন কালো মেঘের মতো। তাঁর বড় মেয়েটি অঝোরে কাঁদছিল। আদালতের রায় শোনার পর এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে কোহেন বলেন, আজ থেকে তিনি মুক্ত। তিনি আরও বলেন, ‘এত দিন আমি একধরনের মানসিক জেলখানায় আটক ছিলাম। যেদিন থেকে আমি এক বিখ্যাত রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর পক্ষে কাজ করতে সম্মত হই, সেদিন থেকেই এই কারাজীবন শুরু। আজ আমি মুক্ত হলাম।’

আদালতে কোহেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিজের সব কুকর্মের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করেন। কয়েক দিন আগে ট্রাম্প তাঁকে ‘দুর্বল’ হিসেবে পরিহাস করেছিলেন। সে কথা উল্লেখ করে কোহেন আদালতকে জানান, তিনি দুর্বল, সে কথা ঠিক, তবে ট্রাম্প যে কারণে বলেছেন, সে কারণে নয়। ‘আমি আসলেই দুর্বল, কারণ আমি বরাবর মনে করেছি, তাঁর (অর্থাৎ ট্রাম্পের) সব কুকর্ম—কোহেনের ভাষায় ‘ডার্টি ডিডস’—ঢাকা দেওয়াই আমার কাজ।’

একসঙ্গে দুটি ভিন্ন ভিন্ন তদন্তের কোপে পড়েছিলেন কোহেন। রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাত প্রশ্নে তদন্তরত বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলার তাঁর বিরুদ্ধে রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্প ও তাঁর পরিবারের ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিয়ে মিথ্যাচারের অভিযোগ এনেছেন। অন্যদিকে, এফবিআইয়ের একটি ভিন্ন তদন্তের ভিত্তিতে নিউইয়র্কের একটি ফেডারেল আদালত তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন নির্বাচনী আইন ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। উভয় ক্ষেত্রেই কোহেন কাজগুলো করেছিলেন ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী হিসেবে।

কোহেন স্বীকার করেন, ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে তিনি ট্রাম্পের একসময়ের প্রণয়ী পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের মুখ বন্ধ রাখতে তাঁকে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার দিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের ফলাফলের ওপর কোনো রকম ক্ষতিকর প্রভাব আটকানো। কোহেন বলেছেন, এই কাজ তিনি করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত নির্দেশে। মস্কোতে ট্রাম্প টাওয়ার নির্মাণের ব্যাপারে যে আলাপ-আলোচনা তিনি করেন, সেটিও ট্রাম্পের নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে।

কোহেন মিথ্যাবাদী—এ কথা প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ তেমন ওজনদার নয়, এ কথা অনেকেই বলেছেন। ট্রাম্প নিজে কোহেনকে দুর্বল ও মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর আইনজীবী রুডি জুলিয়ানিও একই দাবি করেছেন। কিন্তু গতকাল তদন্তকারী সরকারি আইনজীবীরা জানান, কোহেনের কথার সমর্থনে নতুন তথ্য–প্রমাণ তাঁরা পেয়েছেন। স্টর্মি ড্যানিয়েলস ছাড়া প্লেবয় মডেল ক্যারেন ম্যাকডুগালের সঙ্গেও ট্রাম্পের অবৈধ প্রণয় ছিল। সে কাহিনি প্রথম জানতে পারে ন্যাশনাল ইনকোয়্যারার নামে একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা। কিন্তু এই পত্রিকার মালিক ডেভিড পেকার তা প্রকাশের বদলে ম্যাকডুগালকে ১ লাখ ৫০ হাজার ডলারের বিনিময়ে তাঁকে চুপ থাকার ব্যবস্থা করেন। আদালতে সরকারি আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এই কাজও করা হয় ২০১৬ সালের নির্বাচনে যাতে কোনো ক্ষতিকর প্রভাব না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে। কোহেন ছাড়াও ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের একাধিক সদস্যের অংশগ্রহণে এই ব্যবস্থা পাকা করা হয়।

আদালতে উত্থাপিত নথি অনুসারে, এই পত্রিকার মালিক ডেভিড পেকার সরকারি তদন্তের সঙ্গে সহযোগিতায় সম্মত হয়েছেন, সে জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হচ্ছে না। এ কথার অর্থ, একা কোহেন নন, ডেভিড পেকারও বেআইনি নির্বাচনী কার্যকলাপের দায়ে ট্রাম্প ও তাঁর নির্বাচনী ক্যাম্পেইনকে অভিযুক্ত করেছেন।

ট্রাম্প নিজে আগাগোড়া দাবি করে এসেছেন, এই অর্থ হাতবদলের কোনো কথা তিনি জানেন না। পরে হাতেনাতে ধরা পড়ার পর তিনি যুক্তি দেখান, যে অর্থ ‘তাঁরা’ (অর্থাৎ তিনি ও কোহেন) দিয়েছেন, সেটা তাঁদের সম্পাদিত ‘ব্যক্তিগত লেনদেন’, এর সঙ্গে নির্বাচনী আইন ভঙ্গের প্রশ্ন ওঠে না। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ও তাঁর একাধিক সহযোগী রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিয়ে গোপন আলাপ-আলোচনা করেছেন, সে কথা স্বীকার করে রয়টার্সকে এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছেন, সেসব গুরুত্বহীন, বড়জোর হাতের ময়লা।

ওবামা সরকারের সাবেক অস্থায়ী সলিসিটর জেনারেল নিল কাতিয়াল প্রশ্ন তুলেছেন, ট্রাম্পের পক্ষে মিথ্যাচার ও বেআইনি কার্যকলাপের জন্য তাঁর আইনজীবীর তিন বছর জেল হলো। কিন্তু এসব কার্যকলাপের সুবিধা যিনি ভোগ করছেন এবং যাঁর নির্দেশে তা সংঘটিত হয়, তিনি কত বছরের শাস্তি ভোগ করবেন?

উল্লেখ্য, মার্কিন বিচার বিভাগের অনুসৃত নীতি অনুসারে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত করা যায় না। শুধু ক্ষমতা ত্যাগের পরই সে অভিযোগ আনা যায়। যে আইনের ভিত্তিতে এই অভিযোগ দায়ের করা যায়, তার কার্যকরী মেয়াদ—বা স্টাচুট অব লিমিটেশন—পাঁচ বছরের অধিক নয়। অন্য কথায়, ট্রাম্প ২০২০ সালে দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এই অভিযোগের সম্মুখীন হবেন না। কংগ্রেসের হাতে অবশ্য যে বিকল্প উপায় রয়েছে, তা হলো তাঁর বিরুদ্ধে অভিশংসনের উদ্যোগ গ্রহণ। পরবর্তী কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্প অভিশংসিত হলেও রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত সিনেটে তা অনুমোদনের কোনো সম্ভাবনা নেই।

গতকালের রায়ের পর একাধিক ডেমোক্রেটিক সিনেটর প্রস্তাব করেছেন, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মামলা করা যাবে না, বিচার বিভাগের এই নীতিমালা পরিবর্তন করতে হবে। সিনেটর রিচার্ড ব্লুমেনথল ও কংগ্রেসম্যান অ্যাডাম শিফ এ ব্যাপারে বিচার বিভাগের কাছে চিঠি লিখবেন বলে জানিয়েছেন। অ্যাডাম শিফ বলেছেন, আমেরিকার শাসনতন্ত্র অনুসারে কেউই—এমনকি প্রেসিডেন্টও—আইনের ঊর্ধ্বে নয়।