মেক্সিকোতে পরিবর্তনের সুর

সমর্থকদের নিয়ে নির্বাচনের জয় উদ্‌যাপন করছেন আমলো। ছবি: এএফপি
সমর্থকদের নিয়ে নির্বাচনের জয় উদ্‌যাপন করছেন আমলো। ছবি: এএফপি

ক্ষমতায় আসতে তিন দশকের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো মেক্সিকোর বাম রাজনীতিকে। ১ ডিসেম্বর আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওবরাদর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মধ্য দিয়ে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওবরাদরের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে তাঁকে ডাকা হয় ‘আমলো’। আমলো নামেই অধিক পরিচিত ৬৫ বছর বয়সী এই বাম নেতা। সবুজ, সাদা, লাল—তিনরঙা প্রেসিডেন্ট স্যাশ আমলো দ্বিতীয়বারের মতো তাঁর গায়ে চড়িয়েছেন। এর আগে ২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজয় প্রত্যাখ্যান করে তিনি এই স্যাশ ধারণ করেন।

মেক্সিকোর নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়ে ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টে বলা হয়েছে, মেক্সিকোর ইতিহাসে ভোটাররা আমলোর পক্ষে সবচেয়ে বড় রায় দিয়েছেন। তিনি ৫৩ শতাংশ ভোটে জয়ী হয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন ৩০ শতাংশ ভোটে। দুর্নীতি, সহিংসতা ও অর্থনৈতিক অসাড়তার মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নতুনত্ব আনার লক্ষ্যে আমলোর যুক্তি সাদরে গ্রহণ করেছেন ভোটাররা। আমলো ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মেক্সিকো সিটির গভর্নর ছিলেন।

মেক্সিকোর ‘চতুর্থ রূপান্তর’ শব্দটির মাধ্যমে যে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন আমলো, সে লক্ষ্যে তিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিষয়টি এমনভাবে বলা হয়েছে যেন, ১৯১০-২০ সালের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মতো তাঁর নির্বাচন ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। এতে তাঁর ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা দুই-ই বেড়ে যায়। ২০১৪ সালে তিনি ‘মোরেনা’ নামের দল গঠন করেন। শরিকদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে তাঁর দল কংগ্রেসের দুটি কক্ষেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। সমালোচকেরা নীরব হয়ে গেছেন। এতে উৎসাহিত হয়ে তাঁর ছয় বছরের মেয়াদের প্রথমার্ধে সংবিধান পরিবর্তন না করার প্রতিশ্রুতি ভেঙে ফেলেছেন। দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার এ ব্যাপারে তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন।

নির্বাচনী প্রচারে আমলোর কিছু কিছু প্রতিশ্রুতি মধ্যবিত্ত মেক্সিকান ও বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করেছিল, তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেসব প্রতিশ্রুতি থেকে পিছু হটেছেন তিনি। পরিবর্তে তিনি একটি জনপ্রিয় ইস্যুর দিকে ঝুঁকেছেন, যা স্টক মার্কেটকে নাড়িয়ে দিয়েছ—এমনকি তাঁর ক্ষমতাকেও সংকুচিত করেছে।

অক্টোবরে আমলো বলেছিলেন, তিনি মেক্সিকো সিটিতে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করতে পারেন, অথচ বিমানবন্দরটির নির্মাণকাজ ইতিমধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শেষ হয়েছে। সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় ভোটারদের ক্ষুদ্র একটি অংশের একটি ভোটের বা কনসাল্টার ফলাফলের পর। আলমোর দল মোরেনা ওই ভোটের আয়োজন করে। এতে মাত্র ১ শতাংশ ভোটার অংশ নেন। ভোটের জন্য আলমো নিজে প্রশ্ন রাখেন। তিনি জানতে চান, ভোটাররা কি নির্মাণাধীন বিমানবন্দরটি চাইছেন, নাকি বিকল্প কর্মপরিকল্পনা পছন্দ করছেন।

আমলোর ব্যাপারে অবিশ্বাসী ব্যক্তিরা আশা করেছিলেন, সব ক্ষেত্রে শক্তিশালী সমরাজনৈতিক ক্ষমতার অনুপস্থিতি থাকায় অর্থনীতির বাজারে তিনি চাপে থাকবেন। এটা হতেও পারত।

মেক্সিকোর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওবরাদর ওরফে আমলো। ছবি: রয়টার্স
মেক্সিকোর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওবরাদর ওরফে আমলো। ছবি: রয়টার্স

জে পি মর্গান ব্যাংকের গ্যাব্রিয়েল লোজানো বলেছেন, ১৫ ডিসেম্বর নতুন সরকার কংগ্রেসে বাজেট পেশ করবে। নতুন সরকারের দেখানোর সুযোগ রয়েছে, অর্থবছরগুলোকে স্থিতিশীল রাখার বিষয়টিকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে।

নতুন প্রেসিডেন্ট নিশ্চিতভাবেই একজন উদ্যমী মানুষ। আমলো নাফটার (উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি) নতুন সংস্করণে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকতে সম্মত হয়েছেন। দুর্নীতি রোধে এবং সরকারি খাতে মিতব্যয়িতার জন্য তিনি ৫০টি প্রস্তাব দিয়েছেন। সেগুলো বাস্তবায়নও শুরু করেছেন। নিজের বেতন তিনি ৬০ শতাংশ কমিয়েছেন এবং একইভাবে শীর্ষ কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা কমিয়েছেন। অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামরিক নির্দেশনার অধীনে ৫০ হাজার জাতীয় নিরাপত্তারক্ষীকে নিয়ে তিনি একটি বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছেন। বেকার তরুণদের শিক্ষানবিশ চাকরি ও বয়স্কদের উচ্চ পেনশন দেওয়ার ভাবনা রয়েছে তাঁর।

আমলোর আরও অনেক কর্মপরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে পর্যটক ট্রেন, যা দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে চলবে এবং তাঁর নিজ শহর তাবাস্কোতে শোধনাগার স্থাপন। বড় বড় সিদ্ধান্ত এবং ছোটখাটো অনেক বিষয়েও সরাসরি জনগণের মত নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আমলোর। পর্যটক ট্রেন ও শোধনাগার স্থাপন বিষয় দুটো গত ২৪ ও ২৫ নভেম্বর ভোটারদের ভোটে পাস হয়েছে। ভোটাররা আরও আটটি কর্মপরিকল্পনায় সমর্থন দিয়েছেন। এর মধ্যে ‘১০ লাখ হেক্টর জমিজুড়ে ফল ও কাঠের গাছ লাগানো, চার লাখ স্থায়ী চাকরির সুযোগ সৃষ্টি’ ব্যালট প্রস্তাবও রয়েছে।

মার্চে তৃতীয় কনসাল্টা অনুষ্ঠিত হবে। এতে জাতীয় নিরাপত্তারক্ষীদের বিষয়টি ভোটাররা অনুমোদন দিতে পারেন। যদিও মানবাধিকারকর্মীরা ও সুপ্রিম কোর্ট মনে করেন না, সেনাবাহিনীকে পুলিশের কাজে যুক্ত করা ঠিক। আমলোও তাঁদের সঙ্গে একমত। দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক প্রেসিডেন্টদের বিচার করা হবে কি না, সেই মতামতও জনগণের ভোটের ওপর ছেড়ে দিতে চান তিনি। যদিও বিষয়টি নিয়ে তিনিও দ্বিধায় ভুগছেন, নিজেই বলেছেন, তিনি এর বিপক্ষে।

ক্ষমতা জোরদার করার জন্যই অতিরিক্ত জবাবদিহি দেখানো হয়। গণভোট কংগ্রেসকে অকিঞ্চিৎকর করে তুলছে। বিদায়ী সরকারের অল্প কিছু জনপ্রিয় ইস্যুর একটি হচ্ছে শিক্ষাসংস্কার। এটাকে ফিরিয়ে আনতে মধ্য ডিসেম্বরে কংগ্রেসে বিল তোলা হবে। কংগ্রেস একটি আইন পাস করেছে, যেটিতে আমলোকে ‘সুপার-ডেলিগেটস’ নাম দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রের প্রতিটি ব্যয় তিনি পর্যবেক্ষণ করবেন। এর মধ্যে দিয়ে তাঁর বিরোধিতা করতে পারেন—এমন গভর্নরদের তিনি বাগে রাখতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

মোরেনার নেতা ও সিনেটর রিকার্ডো মনরিয়েলের মতে, মেক্সিকো একজন শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট পেতে যাচ্ছে, যা ৩০ বছরেও ছিল না। আমলোর ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই।