ঘূর্ণিচূর্ণ

‘ওহ্, আই সি! ইউর ফাদার ওয়াজ এ ফ্রিডম ফাইটার। অ্যান্ড হি গেট কিল্ড ইন দ্য ওয়ার অব সেভেনটি ওয়ান।’ কথাগুলো বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে রাহিদের কানে কানে। পিৎজা হাটের পুষ্ট চিজ পিৎজার স্লাইস কামড়াতে কামড়াতে আবারও নড়েচড়ে বসার চেষ্টা করে সে। প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছে নিউইয়র্ক শহরে। গেল দশ বছরে এমনটি পড়েনি। সাধারণত শীতকালে আইসমিশ্রিত কোকাকোলা পান করে না রাহিদ। কিন্তু আজ বরফকোলা পান করেও যেন তার বুক ঠান্ডা হতে চাইছে না। তার চোখে-মুখে এখনো একটি ক্ষোভের লাল আগুন। কিন্তু বিষয়টি সে কাউকে এ মুহূর্তে বলতেও পারছে না। যেমন পারেনি গত রাতের পার্টিতে শক্তভাবে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করতে। অথচ এখন তার মনে হচ্ছে ওই তাচ্ছিল্যের জোরালো প্রতিবাদ করা তার উচিত ছিল।
তবে এ প্রসঙ্গটি যে তাৎক্ষণিকভাবে প্রধান একটি বিষয়ে পরিণত হতে পারে, এর জন্য প্রস্তুতও ছিল না সে। তাহলে জেবিনের বাবা ওই প্রসঙ্গটি এত গুরুত্বের সঙ্গে তুললেন না কেন? ভাবতে ভাবতে বেশ কিছু উত্তর রাহিদের মাথায় জমা হতে থাকে।
গতকাল ছিল জেবিনের জন্মদিন। জন্মদিনের পার্টিতেই নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে গিয়েছিল রাহিদ। জেবিন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। সহকর্মীও। ওয়াল স্ট্রিটের খ্যাতিমান শেয়ারবাজারি প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস্-এ পাশাপাশি টেবিলে কাজ করেন দুজন। আট বছরের জানাশোনা। সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে একই ব্যাচে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে লেখাপড়াও করেছে দুজন। প্রতিষ্ঠার শীর্ষচূড়া দেখার যে স্বপ্ন মানুষের থাকে, রাহিদ সব সময়ই ছিল সে রকম স্বপ্নবাজ। জীবনে লেখাপড়াটাকেই সব সময় আরাধ্য বিষয় মনে করেছে। বিশেষ করে মায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে তার দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সে ছিল সব সময়ই সচেতন। মা যখন তাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন, তা–ই সে পালন করেছে শ্রদ্ধার সঙ্গে। আর এভাবেই আজ সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জীবনের এই আসনে।
রাহিদকে মাত্র দুই মাস বয়সের রেখেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তাঁর পিতা। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে আকাশ-বাতাস যখন প্রকম্পিত, তখন কি কেউ ভেবেছিল মুক্তির জন্য ত্রিশ লাখ শহীদকে পবিত্র রক্ত আর দুই লাখ নারীকে সম্ভ্রম দিতে হবে? রাহিদের পিতা রাজিব ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। তিনি যখন সাতই মার্চের সেই অগ্নিঝরা ভাষণ শোনার পর যুদ্ধে যাওয়ার কথা রাহিদের মাকে জানিয়েছিলেন, তখনো তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি—এই সহজ-সরল মানুষটি আসলে কী বলছেন! কিন্তু পরে তা–ই হয়েছিল। প্রথম ও একমাত্র সন্তান রাহিদকে ছুঁয়ে রাজিব বলেছিলেন, ‘ফাহমিদা, আমি আমার প্রতিনিধি রেখে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি তবে তুমিই তাকে মানুষের মতো মানুষ করো।’
মিসেস ফাহমিদা রাজিব তখনো অনুমান করতে পারেননি কী ভয়ানক অন্ধকার তার জীবনে অপেক্ষা করছে। ভারতের শিলং ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে মাঝে মাঝে বাহক মারফত পত্র দিতেন রাজিব। রাহিদসহ সবার খোঁজখবর নিতেন। ফাহমিদাও প্রতি–উত্তর পাঠাতেন ওই বাহকের মারফতই।
যুদ্ধে সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাব সেক্টরের একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসেবেই স্বীকৃতি পান রাজিব। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ এগোতে থাকে পরিণতির দিকে। ক্রমশ মুক্ত হতে থাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। রাজিব সিদ্ধান্ত নেন, নিজ হাতেই শত্রুমুক্ত করবেন নিজ এলাকা, ঢাকার রায়পুরা। মুক্তিযোদ্ধারা আগেই গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিলেন রায়পুরা, পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকার আলবদররা দখল করে রেখেছে মেজর আরিফ রামজানের নেতৃত্বে। পাঞ্জাবি মেজর আরিফ রামজানের গণহত্যার কুখ্যাতির কথা বিদেশি মিডিয়াগুলো তখন প্রায় প্রতিদিন প্রচার করছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তাই রায়পুরা দখলের জন্য খুব শক্ত হাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অবশেষে নভেম্বরের শেষদিকে সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধা দল রায়পুরা দখলের সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিদ্দিকের নেতৃত্বে একরাতে তারা আক্রমণ করেন মেজর আরিফ রামজানের বাহিনীর ওপর। কমান্ডার সিদ্দিক ছিলেন রাজিবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রক্তক্ষয়ী সে যুদ্ধে পঁচিশজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে রাজিবও শাহাদাত বরণ করেন সে কালো রাতে। আটাশ ঘণ্টার যুদ্ধে শত্রুমুক্ত হয় ঢাকার রায়পুরা।
রাজিবের এসব ঘটনা কমান্ডার সিদ্দিকের কাছে জেনেছিলেন ফাহমিদা। রায়পুরার সেই গণকবরেই একত্রে সমাহিত করা হয়েছিল সব কটি শবদেহ। রায়পুরা দখলের তিন দিন পরই সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারবর্গকে ঘটনাটি জানানো হয়েছিল। ফাহমিদা এ ঘটনায় সেই যে নির্বাক হয়ে পড়েছিলেন, সে শোক আজও ফুটে আছে তার মুখমণ্ডলে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাহিদকে নিয়ে পিতৃগৃহে চলে যান ফাহমিদা। রাহিদ বেড়ে ওঠে মাতুলালয়েই। রাহিদের জন্মের পর থেকেই, তাকে পিতা রাজিবের প্রতিচ্ছবি বলতেন রাহিদের নানী। শহীদ জামাতার উত্তরসূরী রাহিদ তাই ছিল তাদের পরিবারের শ্রেষ্ঠ আদরের সন্তান।
যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষ করে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরপরই রাহিদ তার মাকে নিউইয়র্কে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ছোট সংসারে এখনো মা-ই তার ছায়ার মতো। এখন মায়ের শুধু চাওয়া রাহিদ বিয়ে করে সংসারী হবে। তাদের পারিবারিক সুখ দেখে মা ধন্য হবেন। এর জন্য মা যে রাহিদকে পীড়াপীড়ি করেননি তা নয়। কিন্তু রাহিদ চেয়েছে ভালো একটি চাকরিতে জয়েন করেই বিয়ে করবে।
নারীঘটিত বিষয়ে রাহিদ সব সময়ই লাজুক স্বভাবের মানুষ। তাই ঘনিষ্ঠ কোনো প্রেমে জড়ানো তার দ্বারা কখনোই সম্ভব হয়নি। সহকর্মী জেবিনকেও প্রেমিকা হিসেবে কল্পনা করে কি-না তা স্পষ্ট করে ভাবতে পারে না রাহিদ। জেবিন কি তাকে ভালোবাসে? নাকি শুধু সহকর্মীর মতোই থাকতে চায়? বিষয়টি পরখ করার চেষ্টা করেও কোনো সুরাহা করতে পারেনি রাহিদ।
সেদিন রাতের বার্থডে পার্টিতেই জেবিনের পিতার সঙ্গে প্রথম দেখা হয় রাহিদের। জেবিন পাকিস্তানের মেয়ে। ১৯৭৩ সালেই পিতা-মাতার সঙ্গে নিউইয়র্কে আসে। সেসব কথা রাহিদ জানলেও এর বেশি কিছু জানার প্রয়োজন সে কখনো মনে করেনি। জেবিন জানে রাহিদের পিতা ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় মারা গেছেন। সেদিনের পার্টিতে প্রসঙ্গটি এভাবেই উঠে আসে আবারও। জেবিনের পিতা যখন পারিবারিক নানা কথা জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, তখনই সে সহজাতভাবে গর্বের সঙ্গে বলে, সে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তারপর জেবিনের পিতা যে বাক্যগুলো উচ্চারণ করেন, সেই বাক্যগুলোই গেল কদিন থেকে তোলপাড় করে যাচ্ছে রাহিদের পাঁজর। কেন তিনি একাত্তরে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে তুচ্ছ ভাবছেন। এর নেপথ্যে কী কারণ থাকতে পারে? অথচ শিশুকাল থেকেই রাহিদ মায়ের কাছে শিখেছে সে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। মুক্তিযোদ্ধারা সেই শাণিত চেতনাধারী—যাঁরা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। রাহিদ সে রক্তের বহমান ধারা। সেই আত্মশক্তিতে সে চির বলীয়ান।
সেদিনের সে ঘটনা জেবিনের পরিবার সম্পর্কে কিছুটা আগ্রহ বাড়িয়ে দেয় রাহিদের। সে সুযোগ খুঁজতে থাকে আরেকদিন জেবিনের পিতার মুখোমুখি হওয়ার।
অবশেষে একদিন আসে সে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ। জেবিনের সঙ্গে দেখা করার অজুহাতে আবারও দেখা হয়ে যায় তার পিতার সঙ্গে তাদের বাসায়। এক বিকেলের আড্ডায় জেবিনও উপস্থিত ছিল সেখানে। নিউইয়র্কে আসার আগে তিনি কী করতেন? প্রশ্নটি সাহসের সঙ্গেই ছুড়ে দেয় রাহিদ।
‘আই ওয়াজ ওয়ার্কিং ফর ডিফেন্স অব পাকিস্তান।’- উত্তরটি শুনে আগ্রহ বেড়ে যায় রাহিদের।
‘হোয়াট ইউ ওয়াজ ডুয়িং দেয়ার?’
রাহিদের চোখে মুখে গভীর জিজ্ঞাসা।
‘মাই বয়, আই ওয়াজ এ মেজর অব দ্য পাকিস্তান আর্মি।’
উত্তরটি রাহিদকে জিজ্ঞাসার নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।
‘ওহ, আই সি! হোয়্যার ইউ ওয়াজ ইন নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান?’ রাহিদ জানতে চায়।
‘আই ওয়াজ ওয়ান অব দ্য ইনচার্জ অফিসারস ইন ঢাকা। আই ওয়াজ এ ব্রেভ ফাইটার ফর মাই মাদারল্যান্ড, পাকিস্তান। আই ডিড ফট ইন নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গি, রায়পুরা...।’
‘রায়পুরা’- শব্দটি শুনেই বুকের মধ্যে মুচড়ে ওঠে রাহিদের। আর কোনো প্রশ্ন সে করতে পারে না। এত দিন মি. রামজান বলে যে ব্যক্তিটিকে সে জেনেছে, তার অন্য পরিচয় জেনে রাহিদ যেন চমকে ওঠে হঠাৎ করেই। একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, শহীদ পিতা, রায়পুরা... প্রভৃতি শব্দগুলো আলোড়িত হতে থাকে তার মগজে, মননে।
কথা প্রসঙ্গে পরদিনই মিস জেবিন রামজানের কাছ থেকে জেনে নেয় রাহিদ, তার পিতার নাম আরিফ রামজান। একজন অবসরপ্রাপ্ত (বাধ্যতামূলক) মেজর। ছোটকালে মায়ের কাছ থেকে জানা কাহিনী, মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক চাচার, রায়পুরার গণকবর এলাকায় অধিবাসী মানুষের কথা—যেন মুহূর্তে ভাসতে থাকে রাহিদের চোখের সামনে। তাহলে তিনিই কি সেই মেজর আরিফ রামজান, যার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নভেম্বর অপারেশনে যোগ দিয়েছিলেন তার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজিব!
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেছে রাহিদ। সে জানে তিরানব্বই হাজার পরাজিত পাকিস্তানি সেনা, যারা ষোলোই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মাটিতে আত্মসমর্পণ করেছিল-তাদের কাউকেই আর সামরিকবাহিনীতে নেয়নি পাকিস্তান সরকার। এদের একটি বৃহৎ অংশকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরি দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর চতুর পরাজিত অফিসারদের অনেকে টুরিস্ট হয়ে সপরিবারে চলে আসে ইউরোপে, উত্তর আমেরিকায়। এদের সবাই খোলস পাল্টে এখন বিভিন্ন উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত। ব্যাংকার আরিফ রামজানের অতীত পরিচয় এখন আর কজন জানে!
রাতে বাসায় ফিরে একাত্তরের স্মৃতিকথা শোনার জন্য মাকে স্মৃতি ঘোরে ডুবাবার চেষ্টা করে রাহিদ। সে আবারও শোনে সেসব লোমহর্ষক রক্ত–কথা। মায়ের মুখে আবারও আরিফ রামজানের নামটি শুনে ঘৃণায় রি রি করে ওঠে তার শরীর।
নাৎসিদের সহায়তা করার জন্য প্রাক্তন কর্নেল, মেজর, জেনারেলদের বিভিন্ন দেশ থেকে খুঁজে বের করে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই যুক্তরাষ্ট্রেই খোলস পাল্টে মিলিয়নার হয়েছে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানি অফিসাররা। ‘ওয়ার ক্রিমিনাল’- এসব পরাজিত পাকিস্তানি অফিসারদের বিরুদ্ধে কি ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার ক্রিমিনাল কোর্টে মামলা করা যায় না? ভাবনাগুলো ক্রমশ ঘুরপাক খেতে থাকে রাহিদের মনে।
পরদিন সকালে সময়মতো অফিসে যায় রাহিদ। অন্যান্য দিনের মতো তাকে তেমন প্রাণবন্ত দেখা যায় না। লাঞ্চ আওয়ারে একসঙ্গে লাঞ্চ করার অফার করে জেবিন। জেবিনকেও বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে আজ। লাঞ্চ শেষে জেবিন বলে, ‘আই অ্যাম ওয়েটিং টু সে ইউ সাম ওয়ার্ডস, রাহিদ।’
‘প্লিজ কন্টিনিউ...’ রাহিদ বলে।
‘আই লাভ ইউ রাহিদ...’ বলেই রাহিদের দুটি হাত চেপে ধরতে চায় জেবিন।
রাহিদ নিজের দুটি হাত সরিয়ে নেয়, দ্রুত। একটি ঘূর্ণিচূর্ণ তাকে ঘন আলিঙ্গন করে।