ঘরে বসে আয়

ডিজাইনার নুসরাত জাহান এলিন শখের বশে শাড়ি ডিজাইন শুরু করলেও, এখন এটা তার আয়েরও উৎস।
ডিজাইনার নুসরাত জাহান এলিন শখের বশে শাড়ি ডিজাইন শুরু করলেও, এখন এটা তার আয়েরও উৎস।

ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার সঙ্গে মানুষের রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলা শহর নিউইয়র্ক। স্বামীর একার আয়ে সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করা অনেক সময় কঠিন হয়ে উঠে। এ জন্য নিজের হাতখরচ মেটাতে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সন্তানেরা তাঁদের কলেজের পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করছে। অনেক পরিবারে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেন গৃহিণীরা। ঘরে বসে সংসার, সন্তান সামলেও তাঁরা স্বনির্ভর হয়ে উঠছে নানান উপায়ে। সাহানা নামের একজন কঠোর পরিশ্রমী নারীকে জানি, যিনি এ দেশে আসার পর শুরুর দিকে বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে পোশাক, গয়না কিনে এনে সেগুলো ঘরে বসে চেনা–জানা বন্ধুদের কাছে বিক্রয় করতেন। এভাবে একজন থেকে অন্যজন করে খবর ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ে স্কুলের অন্য মায়েদের কাছে। নানাবিধ বৈধ কাগজপত্রের জটিলতা কিংবা পারিবারিক সমস্যার কারণে অনেকেরই বছরের পর বছর দেশে যাওয়া হয় না। কখনো বা সন্তানদের স্কুল, স্বামীর চাকরির কারণেও যেতে পারেন না। সে সব নারীই হয়ে উঠে সাহানার নিয়মিত গ্রাহক।

এই বিদেশ বিভুঁইয়ে জীবনে এখন বছরজুড়ে সর্বত্রই বাংলাদেশিদের অনুষ্ঠান লেগে থাকে। হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও আনন্দ, বিনোদনের জন্য দেশীয় সে সব অনুষ্ঠানে দেশীয় পোশাক পরে সপরিবারে নারীদের পদচারণা দেখা যায়। গত বসন্তে সাহানার সঙ্গে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটসের প্রাণকেন্দ্রে একটি শোরুমে দেখা। আমি নিজেও যেহেতু তাঁর একজন নিয়মিত গ্রাহক, তাই খানিক সখ্য ছিল আগে থেকেই। জানালেন, বাসায় ছোট রুমে ক্রেতাদের চাহিদা পূরণে হিমশিম খেতে হয় বিধায় ব্যবসাকে বড় পরিসরে নিয়ে এসেছেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে এই শোরুম দিয়েছেন। সন্তানেরা স্কুলে থাকাকালে তিনি ব্যবসায় সময় দেন, আর বিকেলে তিনি সন্তানদের দেখভাল করেন। তখন তাঁর স্বামী ব্যবসা দেখাশোনা করেন। ভিনদেশে পুরোদস্তুর গৃহিণী থেকে সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার অসাধারণ এই গল্প আমায় যারপরনাই মুগ্ধ করে। আমার জানা মতে, শুধু সাহানা নন, ঘরে ছোট পরিসরে অনেক গৃহিনী এখন এমন ব্যবসা করছেন।
একবার পত্রিকায় ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায়, ‘ ঘরোয়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য ক্যাটারিংয়ের অর্ডার নেওয়া হয়।’ ফোন করে বিস্তারিত জানলাম। বছরজুড়ে ঘরে ঘরে যে জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী কিংবা বৈশাখী অনুষ্ঠানাদি হয়ে থাকে, সে সব অনুষ্ঠানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করে আনা হয়। যেসব নারী ঘরে বসে রান্নার অর্ডারগুলো গ্রহণ করছেন, তাঁরা রেস্টুরেন্টের চেয়েও কম দামে গ্রাহককে খাবারদাবার তৈরি করে দিচ্ছেন। কেউ শুধু পিঠা বানাচ্ছেন ঘরে বসে। সে সব পিঠা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে চমৎকার পরিবেশনায় বাঙালি গ্রোসারিগুলোয় বিক্রি করছেন। কেউবা পরোটা, ডালপুরি বানাচ্ছেন, কেউ মুড়ি কিংবা মিষ্টি। একবার আমার বাসায় দেশ থেকে অতিথিরা আসবেন। তাঁরা সংখ্যায় ছয়জন। থাকবেন মাস খানিক। বাড়তি কাজের চাপ কমাতে এমন একজনের কাছ থেকে বেশ কিছু শিঙারা এবং সমুচা কিনি, যিনি ঘরে বসে সে সব তৈরি করেন। রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করে রোজ বিকেলে আমার অতিথি আপ্যায়নের কাজটি সহজ হয়ে উঠেছিল তখন।
এই শহরে যেসব নারী বাইরে চাকরি করছেন, তাঁদের সময় কোথায় সকালের নাশতায় পরোটা বানিয়ে খাওয়ার কিংবা বৈকালিক নাশতার সময়ে চায়ের সঙ্গে গরম ডালপুরি বানিয়ে খাওয়ার? আর যারা ব্যাচেলর, পরিবার–পরিজন দেশে অবস্থান করছেন, তাঁদের তো গ্রোসারি থেকে তৈরি খাবার কেনা ছাড়া উপায় নেই। একবার গ্রোসারি করতে গিয়ে কিছু ছোট ছোট কৌটায় চোখ যায়। চ্যাপা শুঁটকি ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা লেখা লেবেল দেখে লোভ জাগে মনে। দুই ডলারের বিনিময়ে কিনে আনি একটি। পেঁয়াজ, ধনেপাতা মিশিয়ে মাখিয়ে গরম ভাতের সঙ্গে ঝটপট খাওয়ার চমৎকার এই লোভনীয় ভর্তার বিষয়টি কিন্তু মন্দ নয়। এমন করে কর্মজীবী মানুষের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে বসে নারীদের অর্থ আয় করার পথও প্রসারিত হচ্ছে দিনে দিনে এই দূর পরবাসে।