ছড়িয়ে দিন বিজয়ের চেতনা

মেয়ে রিদা আঁকছে বাংলাদেশের পতাকা। তাকে সাহায্য করছেন মা আইরিন রহমান
মেয়ে রিদা আঁকছে বাংলাদেশের পতাকা। তাকে সাহায্য করছেন মা আইরিন রহমান

ভিনদেশে বেড়ে ওঠা আপনার সন্তানকে বাংলাদেশের কথা বলুন। বলুন ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের কথা। সন্তানকে পরিচিত করে তুলুন বাংলাদেশের সব সেরা অঞ্চলের সঙ্গে।
ভারতীয় উপমহাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে ছোট্ট একটি সবুজ ভূখণ্ড আমাদের চোখে পড়বে। দেশটি বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো করে না তাকালে চোখেই পড়ে না; এত ছোট এই দেশটি। এর তিন দিকই ঘিরে রেখেছে বিশাল দেশ ভারত, পাহাড়ি দেশ নেপাল, ভুটান আর মিয়ানমার। নদীমাতৃক বদ্বীপ এই দেশটি আগে ছিল অখণ্ড ভারতেরই একটি ক্ষুদ্র অংশ। নাম ছিল পূর্ববাংলা। ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে রাজনীতির মারপ্যাঁচে দেশটি গিয়ে পড়ে পাকিস্তানের হাতে। তখন নাম হলো পূর্ব পাকিস্তান। কিন্তু বাঙালিরা পাকিস্তানি হয়ে উঠতে পারল না। কারণ তারা যে বাংলা মায়ের সন্তান। বাংলা তাদের ভাষা। বঙ্গোপসাগরের নরম পলি মাটিতে তাদের জন্ম। পাকিস্তানিদের উর্দু ভাষা তারা নিজের ভাষা হিসেবে মানতে পারল না। নদীর মতোই সহজ-সরল মানুষগুলো নির্যাতিত হতে হতে একসময় রুখে দাঁড়াল। তাদের জীবনে বাঁধভাঙা বন্যার মতোই এল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। তারা নদীর মতোই উত্তাল হয়ে উঠল স্বাধীনতার দাবিতে। গর্জে উঠল নিরীহ হালচাষ করা, মাছ ধরার জেলে মানুষগুলো। কারণ এটাইতো তাদের পরিচয়; তারা মাছেভাতে বাঙালি। শুরু হলো ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭১ সাল। দেশজুড়েই তখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মানুষের মনে প্রচণ্ড ঘৃণা আর রাগ। সবার মনে উৎকণ্ঠা। জননেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দেশের মানুষ তখন মানসিকভাবে স্বাধীনতার দাবি আদায়ের জন্য রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত। সবার মনে ভয় ছিল, হয়তো পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরা সহজে শেখ মুজিবের দাবিগুলো মেনে নেবে না। হয়তো তারা কঠিন কোন আইন বা নিয়ম চাপিয়ে দেবে আমাদের জনগণের ওপর। কিন্তু তা কখন, কীভাবে হবে, তা কেউই অনুমান করতে পারেনি, ভাবতেও পারেনি। ঠিক তখনই, পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকায় শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অতর্কিত বর্বর আক্রমণ।
এরপর কী হলো তাতো আজ ইতিহাস হয়ে আছে। বাঙালিদের জন্য বিজয় আর পাকিস্তানিদের জন্য চরম পরাজয়ের সেই ইতিহাস। কিন্তু এই বিজয় আর স্বাধীনতা সহজে আসেনি। এই স্বাধীনতা আসবে বলেই আমাদের অগুনতি মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়ে ছিল। হাজার হাজার বাবা, ভাই তাদের জীবন দিয়েছিল। বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়েছে। রক্তের বন্যা বয়ে গেছে দেশে। আর এই রক্তে পা ডুবিয়ে পিশাচের মতোই উল্লাস করেছে একদা বড় ভাইয়ের পদ অধিকার করা পাকিস্তানি হায়েনারা।
হাজার হাজার কিশোর, তরুণ, তরুণী, যুবক আর বৃদ্ধ আনাড়ি হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়েছিল আমাদের জওয়ানরাও। বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসারের বেশির ভাগ সদস্যই এসব বাহিনীতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া এফএফ মুজিব বাহিনী এবং যৌথবাহিনীর অবস্থান ও নিরাপত্তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এসব বাহিনী। মুজিব নগর সরকারের অনুগত ছোট ছোট বাহিনীই মূলত মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রাণ’ ছিল। দেশের ভৌগোলিক কারণ ও যাতায়াত ব্যবস্থা তেমন উন্নত না হওয়ায় দুর্গম অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বিভিন্ন বাহিনী গড়ে উঠেছিল।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি আমাদের দেশের চলচিত্র, নাট্য ও কণ্ঠশিল্পীরাও যুদ্ধে যার যার মতো করে তাদের অবদান রেখেছেন। এ সময় কলকাতা থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নানা অনুষ্ঠান, দেশাত্মবোধক গান মানুষের মনোবল বাড়িয়েছে, উৎসাহ-উদ্দীপনা জুগিয়েছে।
অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই যুদ্ধ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সারাক্ষণই চাপা আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা আর আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় মানুষ কাঁটা হয়ে থাকত। যেকোনো খবর, সামান্য একটা শব্দও আতঙ্কিত মানুষগুলোকে দিশেহারা করে দিত। এতগুলো বছর পরেও চোখ বুজে ভাবলেই সেই দৃশ্য আর স্মৃতিগুলো আমার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আমি ফিরে যাই ফেলে আসা কৈশোরের সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে। কানে বাজে সেই আর্তচিৎকার, ‘মিলিটারি আইছে’!
মানুষ তখন প্রাণভয়ে ইঁদুরের মতোই এখানে-সেখানে পালিয়ে বেড়িয়েছে। ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার মানুষ দলে দলে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। যশোর রোড ধরে প্রাণভয়ে ছুটে আসা বিশাল এই যুদ্ধবিধ্বস্ত জনগোষ্ঠীকে মানবতার খাতিরে ভারত আশ্রয় দিয়েছিল। ক্ষমতার মারপ্যাঁচ আর দেশ ভাঙাগড়ার কী বিচিত্র এই খেলা। বারবার এই খেলারই বলি হয়েছি আমরা নদীপাড়ের গরিব জনগোষ্ঠী।
এ আমার নিজের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের স্মৃতি মনে করলে আজও ফিরে যাই সেই কিশোরী বয়সে। সেই বয়সে আমরা জেনেছিলাম, এই যুদ্ধের নাম জয়বাংলা। এই যুদ্ধ ছিল জয়বাংলার যুদ্ধ। আমাদের সবার তখন একটিই নাম ছিল, জয়বাংলা! মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর কথা বলুন আপনার সন্তানকে। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিন লাল-সবুজের প্রতি ভালোবাসা।