বাঙালি সংস্কৃতি, বড়দিন ও আমরা

স্বামী প্যাট্রিক ও সন্তানদের নিয়ে এবারও সাড়ম্বরে ক্রিসমাস উদ্‌যাপন করবেন সংগীত শিল্পী ক্রিস্টিনা লিপি রোজারিও।
স্বামী প্যাট্রিক ও সন্তানদের নিয়ে এবারও সাড়ম্বরে ক্রিসমাস উদ্‌যাপন করবেন সংগীত শিল্পী ক্রিস্টিনা লিপি রোজারিও।

ধর্ম, ভাষা, লোকাচার সবকিছুর সমন্বয়েই আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি। বাংলা ভাষায় যেমন বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণ ঘটেছে, ঠিক তেমনি বিভিন্ন ধর্মাচার আমাদের সংস্কৃতিকে এক অনন্য রূপ দিয়েছে। ধর্ম চর্চা তাই বাঙালির নিজস্ব ধারায় বয়ে চলে। আর তাই বড়দিন উদ্‌যাপিত হয় বাঙালির পিঠাপুলি বানানো ও কীর্তন পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। বড়দিনের সময় বিশেষ করে গ্রাম বাংলায় পিঠা তৈরির উৎসবে পরিণত হয়। শহরে খ্রিষ্টান পরিবারেও নানা ধরনের পিঠা তৈরি হয়। ছোটবেলায় দেখতাম বড়দিনের আগের দিন রাতে মা, দিদিমা, মাসীমাসহ পাড়ায় মায়ের বান্ধবীরা সবাই মিলে পিঠা তৈরি করতেন। আমরাও ছোট ছোট হাতে পিঠা বানানোর চেষ্টা করতাম। কেক তখন বিদেশি খাবার। এখন অবশ্য গ্রামেগঞ্জেও কেক হয়। কিন্তু সেটি পোলাও-মাংসের মতো একটি ভালো খাবার মাত্র। কিন্তু পিঠা হতেই হবে।
কেকের মতোই ‘ক্যারল’, যা পৃথিবীজুড়ে বড়দিনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, সেটিও আমাদের নিজস্ব ধারায় অনুষ্ঠিত হয়। কীর্তন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। এর সঙ্গে মিলিয়ে শত শত বছর ধরে বড়দিনের কীর্তন গাওয়া হয়। ২৪ ডিসেম্বর রাতে কীর্তনের দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঢোল-করতাল নিয়ে নেচে গেয়ে কীর্তন পরিবেশন করে। ছোটবেলায় এই কীর্তনের জন্য মুখিয়ে থাকতাম। গান পরিবেশনের পরে হইচই করে প্রত্যেক বাড়িতে খাওয়াদাওয়া—সে এক মহা আনন্দ উৎসব।
বড়দিনে ক্রিসমাস ক্যারলের বঙ্গানুবাদ করেও গাওয়া হয়। বিভিন্ন গির্জায় বাংলায় ক্যারল পরিবেশিত হয়। ক্যারলের সুরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লেখা গান পরিবেশিত হয়। কার্ডের একদিকে ইংরেজি ক্যারল, অন্যদিকে তার বঙ্গানুবাদ লিখে বিলি করার রেওয়াজ এখনো রয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বড়দিনের অনুষ্ঠান গির্জা থেকে সরাসরি প্রচার করত বাংলাদেশ বেতার। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ অন্য টেলিভিশন চ্যানেল ও এফএম রেডিও অত্যন্ত যত্ন নিয়ে বড়দিনের বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে এখন। দিনে দিনে বড়দিন একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হচ্ছে। সেই ছোটবেলা থেকেই আমরা বোনেরা দেশে টেলিভিশন ও রেডিওর বড়দিনের অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। সেই স্মৃতি আজও আনন্দ দেয়।

বড়দিন মানেই রাত জেগে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো, সারা বাড়ি কাগজের জাফরি কেটে, কাগজের শেকল বানিয়ে সাজানো, নতুন জামা-জুতো পরে ২৪ ডিসেম্বর রাতে গির্জায় যাওয়া। আবার ২৫ ডিসেম্বর সকালে গির্জায় গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা হওয়া হইচই—এ এক অপার আনন্দ অনুভূতি। চোখ বুজলে এখনো যেন সেই নির্মল আনন্দ অনুভব করতে পারি।
শৈশব-কৈশোরে আমাদের মাঝে ধর্মের চেয়ে উৎসবটাই প্রাধান্য পেত বেশি। এ কারণে আমাদের বন্ধুরাও আমাদের সঙ্গে নতুন জামা পরে ক্রিসমাস ট্রি সাজাতে আসত; যেমনটি আমরা ওদের সঙ্গে উদ্‌যাপন করতাম ঈদ ও পুজোয়।
মানুষ তার সংস্কৃতি নিজের সঙ্গেই বহন করে ফেরে। তাই সুদূর আমেরিকায়ও বাঙালি খ্রিষ্টানরা ঘরে ঘরে পিঠাপুলি বানায়, কীর্তন গায়। নিউজার্সি থেকে কীর্তনের দল নিউইয়র্কে আসে। আমি নিজেও ঘুরেছি জার্সি সিটি, এডিসন, কানেকটিকাট, কুইন্স, ব্রুকলিনসহ অনেক জায়গায়। বারবারই মনে হয়েছে আমি আমার দেশেই আছি। একবার লস অ্যাঞ্জেলেসে বিপুল উৎসাহে বড়দিন উদ্‌যাপনে অংশ নিয়েছিলাম। ওখানেও কীর্তন হলো, হলো পিঠা ও দারুণ ভোজ। বলতে হয় ভোজের কথা। বড়দিনের আরেক অনুষঙ্গ এই ‘ভোজ’। আগে প্রায় প্রতিটি গির্জায় বড়দিনের ভোজ হতো। গির্জার সদস্যরা সপরিবারে একসঙ্গে বড়দিনের দিন দুপুরের ভোজ সারতেন। বিশাল আয়োজন প্রচুর খাবারসহ এই ‘ভোজ’ হতো। সারা বছর যাদের সঙ্গে দেখা হতো না, তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার একটি সুযোগ মিলত এ আয়োজনে। আধুনিকতার যুগে সবারই নিজস্ব আয়োজন থাকে। তাই এই আচারটি সেভাবে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। অবশ্য এখনো জেলা শহর ও গ্রামে ভোজের আয়োজন হয়। ছোটবেলায় আরেকটি আনন্দের বিষয় ছিল একের পর এক সুসজ্জিত গির্জা ঘুরে বেড়ানো। এটি এ দেশে হয়ে ওঠে না।
আমেরিকায় বাঙালি খ্রিষ্টানরা যেভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রেখে বড়দিন উদ্‌যাপন করে পৃথিবীর অন্য দেশেও সেভাবেই উদ্‌যাপিত হয়। তাই আশা করা যায় যে আমাদের বাঙালি খ্রিষ্টীয় ধর্মাচারের এই ধারা আরও বহুকাল বজায় থাকবে।