দরজা খুললেই ফ্লায়ার

সপ্তাহ শুরুর আগেই রং-বেরঙের ফ্লায়ারগুলো দরজার নিচে হাজির। আপনার চিঠি ঠিকানা ভুল করতে পারে; কিন্তু ফ্লায়ারগুলো কখনো ভুল করে না। কারণ সব বাসায় ফ্লায়ারগুলো সযত্নে বিলি করা হয়। এই একটা জিনিসই না চাইতে বিনা মূল্যে পাওয়া যায় কানাডায়। পণ্য বিক্রয়ের বিজ্ঞাপন এটি। কিছু দরকারি জিনিস কিনবেন বলে মনে মনে ভেবেছিলেন, কিন্তু ভুলে গেছেন হয়তো। কোনো সমস্যা নেই; ফ্লায়ারগুলো আপনার স্মরণশক্তি বাড়িয়ে দেবে, আর ভুলে যাওয়া পণ্যগুলো গড়গড় করে মাথায় আসতে থাকবে। শুধু তাই না, আরও অনেক দরকারি জিনিস যুক্ত হয়ে আপনার বাজারের লিস্টটা দীর্ঘ হবে। আপনি মনে মনে বলবেন, ভাগ্যিস ফ্লায়ারগুলো হাতে পেয়েছিলাম।
পণ্যের মূল্য ছাড়ের কি বাহারি অফার! ৫% থেকে ৯৫% পর্যন্ত মূল্য ছাড়, একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি অথবা একটা কিনলে দ্বিতীয়টায় অর্ধেক দাম, অমুক দিনে ট্যাক্স ফ্রি—আরও কত কী! এই মূল্যছাড়কে এখানে ‘সেল’ বলে। গ্রোসারি থেকে শুরু করে ক্লথিং, ইলেকট্রনিকসসহ সব পণ্যই স্থান পায় এতে। প্রতিদিনের এই সেলের সঙ্গে আবার যুক্ত হয় ‘বিশেষ সেল’, যেমন বক্সিং ডে সেল, ব্ল্যাক ফ্রাইডে সেল, ক্রিসমাস সেল, ডোর ক্রেসার, আর্লি বার্ড প্রাইস ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। আর এখানকার মানুষও ঝাঁপিয়ে পড়ে এই বিশেষ ফ্লায়ারের মনোহর বিজ্ঞাপনের ওপর। কখনো কখনো এই ঝাঁপিয়ে পড়াকে কর্তৃপক্ষ সামলাতে হিমশিম খেয়ে পুলিশের সাহায্য নিতে হয়।
পণ্যের দাম নির্ধারণে বিক্রেতা বিশেষ এক কৌশল অবলম্বন করে। পণ্যের দাম পূর্ণ সংখ্যা যেমন ১, ৫, ১০ অথবা ১০০ ডলার না হয়ে ভগ্ন সংখ্যা হয়ে থাকে যেমন ১.৯৯, ৪.৯৫, ৯.৯৭ অথবা ৯৯.৯৯ ডলার। পরবর্তী পূর্ণ সংখ্যা থেকে কয়েক সেন্ট কম থাকায় ক্রেতার মাথায় সব সময় আগের পূর্ণ সংখ্যাটিই ঘুরতে থাকে। যেমন, ১.৯৯ ডলার ক্রেতার কাছে ২ ডলার মনে না হয়ে কেবল ১ ডলার মনে হতে থাকে। এই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটা বেশ কাজ করে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে। আমার মনে হয় এখানকার একটা শ্রেণির হিসাবজ্ঞান খুব কম। যেমন, চারটি জিনিসের দাম একত্রে দশ ডলার দেখে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ভাবে এতগুলো জিনিস মাত্র দশ ডলার! অথচ দেখা যাবে প্রতিটি জিনিসের আলাদা আলাদা দাম হয়তো আড়াই ডলার করেই।
আট বছর আগে যখন কানাডায় আসি, এই ফ্লায়ারকে একদম পাত্তা দিতাম না। যারা এগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মিলিয়ে বাজার করত তাদের দিকে আড়চোখে তাকাতাম। এর কারণ হয়তো দেশে ফ্লায়ার কনসেপ্টটা তখনো তেমন একটা প্রচলিত হয়নি। এখন হয়েছে কি না, তা জানি না। দেশে থাকতে তো দেখতাম পচা-বাসি জিনিসই শুধু ডিসকাউন্টে/সেলে বিক্রি করা হয়। কানাডায় এসেছি উন্নত জীবনের আশায়; বাসি-পচা খাওয়ার জন্য নয়। গিন্নি আগেই বলে দিয়েছে ডিসকাউন্টের কোনো মাল যাতে বাসায় না আসে। তাই ফ্লায়ারগুলো আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল তখন।
কয়েক মাস পর কীভাবে যেন ধীরে ধীরে ফ্লায়ারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলাম। লক্ষ্য করলাম অমুক জিনিস এই শপে তো তমুক জিনিস ওই শপে সেলে আছে। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে প্রায় সব জিনিসই কোনো না কোনো দোকানে সেলে থাকে। মানে সেল প্রাইসই হচ্ছে রেগুলার প্রাইস। শুধু একটু চোখ-কান খোলা রাখার ব্যাপার। এটা বোঝার পর খালি মনে হতে থাকল, হায়রে কত টাকা লস করলাম আগের দিনগুলোয়! প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম সামনের দিনগুলোতে আর ‘লস করা চলবে না’।
আমাদের দুজনের টোনাটুনির সংসার; বাচ্চা-কাচ্চার আগমন তখনো ঘটেনি। ফ্লায়ারে দ্বিগুণ মনোযোগ দিলাম। এত দিন যা লস করেছি, তা সুদে আসলে পুষিয়ে নিতে হবে। শপিং কার্টকে সঙ্গী করে পাবলিক বাসে চড়ে একেকবার চলে যাই একেক দোকানে একেক জিনিস কিনতে। মাঝে মাঝে আশপাশের প্রতিবেশীদের সাহচর্যও পাওয়া যায়। অফুরন্ত সময়; পাঁচ ডলার বাঁচানোর জন্য ঘণ্টা দু-এক সময় ব্যয় করলেও কোনো সমস্যা নেই। একটা নেটওয়ার্কও তৈরি হয়ে গেল সেলে বাজার করার। যেখানেই সেল থাকুক না কেন খবর সময়মতো চলে আসে। এভাবে ভালোই চলল কিছুদিন।
একে একে দুই বাচ্চার আগমন ঘটল সংসারে। একটা গাড়িও পরিবারের সদস্য হলো। চলার গতিও বেড়েছে অনেক। ইচ্ছা করলেই এই দোকান ওই দোকান ঘুরে আগের চেয়ে অনেক কম সময়ে সব সেল ঘরে তুলতে পারি। কিন্তু এখন আর হয় না। ফ্লায়ারগুলো আজকাল আমাকে আর তেমন টানে না। মাঝে মাঝে যদিও ফ্লায়ারে চোখ বোলাই, তবুও যাওয়া হয় না। এক দোকানে গিয়ে যা যা দরকার একসঙ্গে কিনে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরি। পাঁচ ডলার বাঁচানোটা এখন আর প্রাধান্য পায় না।
মানুষের জীবনে চাওয়া পাওয়ার পরিবর্তন প্রতিনিয়ত হয়। একসময় পাঁচ ডলার বাঁচিয়ে যে আনন্দ পেতাম, এখন হয়তো তার চেয়ে শত গুন বেশি তৃপ্তি পাই বাচ্চাদের একটু বেশি সময় দিয়ে।