রাজনীতিতে আনুগত্য

রাজা ভাবলেন, সেনাপতির যুদ্ধজ্ঞান কম, কিংবা মহামন্ত্রী আর তাঁর অনুগত নয়, কেমন বেফাঁস কথা বলে ফেলছে ইদানীং। তাই অতিসত্বর এদের বদলাতে হবে। সভাসদ মাত্রই আনুগত্য। আনুগত্যের হেরফের মানেই সংশ্লিষ্টকে ছুড়ে ফেল। আর যারা সভাসদ নয়, তারা তো ধর্তব্যেই পড়ে না। এটা রাজতন্ত্রের ধারা, যাকে আধুনিক বিশ্ব বহু আগেই বিদায় বলে দিয়েছে। দেশ পরিচালনায় গণতন্ত্র নামে একটি তন্ত্র হাজির ও থিতু হয়েছে অনেক দিন। কিন্তু এখন এই মতবাদেও কেমন ক্ষয়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
গণতন্ত্রে কোনো রাজা নেই। আছেন আইনপ্রণেতা। রয়েছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশ, প্রতিবাদ, ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীলতাসহ নানা ধরনের সামাজিক চুক্তি। এই সামাজিক চুক্তিগুলোই সমন্বিতভাবে গড়ে তোলে গণতন্ত্রের ভিত। কিন্তু এই ভিতেই এখন চিড় দেখা যাচ্ছে, যা সময়ের সঙ্গে গাঢ় হচ্ছে কেবল। আমেরিকা থেকে শুরু করে সর্বত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রোগাক্রান্ত মনে হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের ঝাঁকুনিটি নিয়ে এসেছে আমেরিকার সর্বশেষ নির্বাচন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমেরিকা এমন একজনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছে, যিনি মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিটি ভিতকে নাড়িয়ে দিচ্ছেন। বাদ পড়ছে না বিচারব্যবস্থার মতো সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটিও। গণমাধ্যমকে আক্রমণ করাটা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাগরিকদের মধ্যে বিভাজনের রেখা টেনে মার্কিন রাজনীতির ধারাই বদলে দিচ্ছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের উচ্চ পদগুলোকে তিনি পরিণত করেছেন মিউজিক্যাল চেয়ারে। তাঁর আচরণে পর্যুদস্ত এমনকি রিপাবলিকান রাজনীতিকেরা। এটা এতটাই যে, তাঁর চিফ অব স্টাফ খুঁজে পেতেই এখন নাজেহাল হতে হচ্ছে। নিজের দলকেই তিনি যেভাবে নাজেহাল করে ছাড়ছেন, তাতে বিরোধী ডেমোক্রেটিক দলের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
আধুনিক বিশ্বের সব দেশে গণতন্ত্র সমভাবে বিকশিত হয়নি। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় এমনিতেই একটা নড়বড়ে অবস্থান ছিল। দুর্বল গণতন্ত্রের সেসব দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিকশিত করতে উন্নত দেশগুলোর দিক থেকে একটি চাপ থাকত। এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে বরাবরই আমেরিকা। কিন্তু এখন এই দেশটিতেই গণতন্ত্র হুমকির সম্মুখীন হওয়ায় তা অনুরূপ ভূমিকা পালনের এখতিয়ার হারাচ্ছে, যা সারা বিশ্বের জন্যই বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। কারণ, গণতন্ত্রের জয়গান গাওয়া দেশটির শাসকই যখন প্রতিপক্ষ মাত্রই আক্রমণোদ্যত, তখন নড়বড়ে গণতন্ত্রের দেশগুলো নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে এটিকে উদাহরণ হিসেবে হাজির করে। কিন্তু এ অবস্থা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ, সাধারণ মানুষের অধিকারকে অস্বীকার করে গণতন্ত্র চলতে পারে না। দীর্ঘ মেয়াদে এমন পরিস্থিতি গোটা বিশ্বকেই সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। তাই বাতিল, বর্জন, হুমকি-ধমকির রাজনীতির ধারা বদলে সহনশীল রাজনৈতিক ধারা ফেরাতে সব স্তরের মানুষকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সক্রিয় হতে হবে, যাতে বিভিন্ন দেশের সরকারে থাকা শীর্ষ ব্যক্তি যেন বুঝতে পারেন, গণতন্ত্র মানে আনুগত্য নয়।