বাবাকে যেভাবে মনে পড়ে

শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদের পরিবার। ছবি: সংগৃহীত
শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদের পরিবার। ছবি: সংগৃহীত

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অথবা ৯ এপ্রিলে এখনো সিলেট শহরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের এক মহান সৈনিক আমার বাবা শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদের কবরে ও স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে যান। আমার বাবার বিষয়ে প্রাণখুলে আলোচনা করতে পারি না। ক্ষতটা এখনো গভীর। এত দিন পরেও কষ্ট হয়, তাই আমরা অনেক সময় চুপচাপ বসে থাকি, অনুভব করার চেষ্টা করি ।

মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ শহীদের পরিবার ও তাদের ইতিহাস যদি উপেক্ষিত থাকে তবে শুধু নিজের বাবার কথা বলতেও বাধে। বাংলাদেশের ইতিহাস অনেক গর্বের ইতিহাস এবং অনেক দুঃখের ইতিহাস। বাবার কথা মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছা করে যখন দেখি আমাদের প্রজন্ম খুঁজে বেড়ায় নিজেদের অস্তিত্বকে, মূল্যবোধকে, নিজেদের মহান এবং অনুকরণ করার মত গর্বিত হওয়ার ইতিহাসকে। বলতে ইচ্ছে করে তাঁর আত্মত্যাগ হঠাৎ কোনো ঘটনা ছিল না। তাঁর সমস্ত জীবন, প্রতিটি পদে পদে তিনি অবলীলায় মানুষের সেবার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি কোনো দিন কোনো প্রতিদান বা স্বীকৃতি নিতে চাননি। তিনি বলতেন, মানুষের জন্য কাজ করতে পারাটা সৃষ্টিকর্তার একটি আশীর্বাদ।

দুয়েকবার তাঁর জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনতার পদক দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যে কোনো কারণে তা হয় নাই এই জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তার দেশপ্রেম এবং আত্মাহুতি একটি পদকের সীমাবদ্ধতায় রইল না। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের মধ্যে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায় সবচেয়ে প্রবীণ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক। মুক্তিযুদ্ধের প্রথমে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকাতে তাঁদের নাম থাকে না। তাঁরা রয়ে যান বিস্মৃত সাধারণ মানুষের মাঝে। তবে সিলেটের মানুষের মাঝে তিনি বেঁচে আছেন, সিলেটে তাঁর সমাধি এবং স্মৃতিসৌধে সম্মান, মেডিকেল ছাত্রাবাস এবং হাসপাতালের নামকরণ—এই সব স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি অনেক গভীরভাবে প্রতিফলিত হয় তাদের ভালোবাসার শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সারা জীবন আমার বাবা ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ কর্মী। ব্রিটিশ ভারতে স্কুলজীবনে বয় স্কাউট থেকে সমাজসেবা শুরু করে, ব্রিটিশ আমলে আসামের প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়া, বন্যা, মিয়ানমার থেকে আসা উদ্বাস্তু শিবির, হজ ক্যাম্প, কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা ঠেকানো—সবকিছুতে আত্মনিয়োগ করেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এবং দ্বিখণ্ডিত ভারতে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে সিলেটের ভারতের অংশের করিমগঞ্জ থেকে পাকিস্তানে চলে আসেন। ঢাকাতে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে কর্মরত থাকেন। ঢাকাতে থাকার সময় তিনিই প্রথম পূর্ব পাকিস্তান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সচিব হয়ে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কার্যক্রম এগিয়ে নেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম মেডিকেল সাহায্য সংস্থা ‘পাকিস্তান অ্যাম্বুলেন্স কোরের’ তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ১৯৫৪ সালে দেশব্যাপী বন্যায় সরকার তার ওপর পুরো দায়িত্ব প্রদান করে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে বন্ধ করে ছাত্র ও ডাক্তাররা তাঁর নেতৃত্বে দেশব্যাপী মেডিকেল রিলিফ কার্য পরিচালনা করেন। তাঁর অসীম দেশপ্রেম ও কর্মদক্ষতার জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে সুনজরে দেখেনি। তাই তারপর থেকে তাঁকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হতো এবং ১৯৫৮ এ লন্ডনে গিয়ে সার্জারিতে এফআরসিএস ডিগ্রি নিতে অনেক বাধার সৃষ্টি করেছিল। সেই সময় থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাঞ্জাবিরা বাঙালিদের কোনো দিন ভালো চোখে দেখবে না; ১৯৬২ সালে লন্ডন থেকে ফিরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। চাকরি জীবনে কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, চিটাগং যখন যেখানে গিয়েছেন সেখানে নিজের করে গড়ে তুলেছেন তার কর্মপরিধি; যা শুধু হাসপাতাল নয় , মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন সহ মানুষের সেবার জন্য গড়ে তুলতেন সব ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠান । তার সাহস ছিল অপরিসীম। ১৯৬৯ এ গণ অভ্যুত্থানের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে তখন ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ পোস্ট মর্টেমের পূর্ণ রিপোর্ট পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেন এবং তাঁরই সভাপতিত্বে এই হত্যার প্রতিবাদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৭০ এ তিনি সিলেট মেডিকেল কলেজে সার্জারির প্রধান হয়ে বদলি হয়ে আসেন।১৯৭১ এ মার্চ মাসের প্রথম থেকেই তিনি আসন্ন পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের আশঙ্কায় ইমার্জেন্সি টিম এবং ব্লাড ব্যাংক তৈরি করেছিলেন। অনেকেই তখন তার এই উদ্যোগের বিশ্বাসযোগ্যতা বুঝতে পারেনি। ২৫ মার্চে অতর্কিতে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। বাবা ব্যস্ত থাকলেন হাসপাতালে দিন রাত অসংখ্য গুলিবিদ্ধ মানুষের সাহায্যে। এপ্রিলের দুই তারিখ সিলেট ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানিরা তাদের দুজন বাঙালি অফিসারকে গুলি করে হাসপাতালে ফেলে যায়। একজন ক্যাপটেন মাহবুব মারা যান তবে লেফটেন্যান্ট ডা. সৈয়দ মাইনুদ্দিন বেঁচে যান। সেই দিন আমি প্রথম বর্ষ মেডিকেলের ছাত্র এবং আমার এমসি কলেজের ছাত্র বন্ধু সালাম ( কর্নেল (অব:) বীর প্রতীক) ঠিক করলাম আর বসে থাকা যাবে না। তখনো কে কোথায় যুদ্ধে আছে জানি না। ঠিক করলাম বিয়ানীবাজারে পুলিশ তখন অস্ত্র জমা দেয়নি। তাদের অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলব। বিয়ানী বাজারে গিয়ে দেখি কর্নেল (অব) আবদুর রব যিনি তখন একজন এমপি। তিনি আমাদের তক্ষুনি তেলিয়াপাড়া গিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বিদ্রোহীদের’ সাথে যোগ দিতে আদেশ করলেন। আমরা তখন করিমগঞ্জ হয়ে আগরতলা দিয়ে আবার বোর্ডের ঢুকে তেলিয়া পাড়া চা বাগানে পৌঁছলাম। যেহেতু আমরা আগে থেকে রাইফেলে পারদর্শী ছিলাম তাই শুধু গ্রেনেড এবং সাবমেশিনগান চালনা শিখিয়ে আমাদের মাধবপুর এলাকায় কাপ্তাই নাসিমের সাথে এবং পরে লেফটেন্যান্ট হেলাল মুর্শেদের সাথে সম্মুখ সমরে পাঠানো হলো। সিলেটে কি হয়েছে তখন ও আমরা জানি না।
এদিকে এপ্রিলের তিন তারিখে সিলেটে যখন সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনানীরা ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে সিলেট আক্রমণ করে তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা সিলেট থেকে সালুটিকর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান নেয়। এই ভয়াবহ যুদ্ধে যখন হাসপাতালে যুদ্ধাহত সংখ্যা যতই বাড়তে থাকে ততই শহরের মানুষ সিলেট ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে যেতে থাকেন। প্রায় জনশূন্য এবং ডাক্তার বিহীন হাসপাতালে আগলে রাখলেন মেডিকেল কলেজের সবচেয়ে প্রবীণ অধ্যাপক ও সার্জারির প্রধান ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ। তরুণ ইন্টার্ন ডা. শ্যামল কান্তি লালা তাঁর অধ্যাপককে ছেড়ে গেলেন না। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পরে ডা. শামসুদ্দিন অনেক রোগী, মেয়ে নার্স, রোগীর স্বজনদের কে হাসপাতাল ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। নিজের পরিবারকেও আগেই গ্রামে পাঠিয়েছিলেন, তবে স্ত্রীকে বাড়িতে থেকে যেতে বললেন, কারণ নার্সরা চলে গেলে তাঁকে কাজে লাগাতে হবে। অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার আলী, পুরুষ নার্স মাহমুদুর রহমান তাঁর সাথে থেকে গেলেন। ৯ এপ্রিলে বিপ্লবীরা ভয়ানক যুদ্ধে শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হলো এবং সেই সময় হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা হাসপাতালে ঢুকে আহতদের সেবায় কর্মরত অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ, ডা. শ্যামল কান্তি লালা, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার আলী, পুরুষ নার্স মাহমুদুর রহমান সহ আরও কিছু লোকজনকে হাসপাতালের ভেতর হত্যা করে। তিন দিন পর তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ ভাঙলে তাঁর চাচা তৎকালীন এইডেড স্কুলের প্রধান শিক্ষক মঈনুদ্দিন হোসাইন তাঁকে এবং অন্যান্যদের হাসপাতালের ভেতর রাস্তার পাশে মহিলা কলেজের দারোয়ান তৈয়ব আলী ও স্বল্প কিছু মানুষকে নিয়ে কবরস্থ করেন।
আমি তখন মনতলা এলাকায় যুদ্ধরত। বন্ধু সালামসহ সবাই জানেন আমার বাবার শহীদ হওয়ার কথা; কিন্তু তাঁরা আমাকে জানাননি। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াই তখন একমাত্র লক্ষ্য। একদিন আমি একটি অপারেশনের পর ক্যাম্পে ফিরে এসেছি বিকেলে ভাত খাওয়ার জন্য। দেখি একজন যুদ্ধাহত পায়ে প্লাস্টার বাধা সৈনিক ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমাকে গভীর কণ্ঠে বললেন, আপনার বাবা বড় ভালো মানুষ ছিলেন, আমাদের বড় গৌরব। আজকে ওনার জন্য আমি এখনো জীবিত। আমি যেন বজ্রাহত হলাম! মনে হলো মা , ভাইবোন কে কোথায় আছে কিভাবে আছে? হঠাৎ পিঠ হাত রাখলকে, দেখলাম সালাম এর চোখে জল। বুঝতে চেষ্টা করলাম, আমরা কোথায় আছি। একটা মহাশূন্যতা গ্রাস করার চেষ্টা করল। আবার বাবার কথা মনে পড়ল, তাঁর মানুষের জন্য গভীর ভালোবাসার কথা, দেশ নিয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা। মনে হলো বাবা জেগে থাকবেন শুধু সেই প্রজন্মদের মাঝে যারা নিষ্ঠভাবে, নিঃস্বার্থভাবে মানুষের দুঃখ দেখে এগিয়ে আসবে তাদের মাঝে।
বাবা সিলেটে যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত, সেখানে গড়ে উঠেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ। পাশে গড়ে ঊঠেছে শহীদ মিনার। যা সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয় পথচারীকে। অনেকে ভুলে যাই স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে লক্ষ লক্ষ শহীদ পরিবারের অসহায় ও অনিশ্চিত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধের কথা। তাদের কোনো সহায়তা জাতি দিতে পারেনি। এটা আমাদের ইতিহাসের এক দুঃখজনক অধ্যায়। তাদের সবার আত্মত্যাগে আমরা দায়বদ্ধ। শহীদ জায়া যাঁরা বেঁচে আছেন, তাদের আমি সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই। স্বাধীন দেশে মাথা উঁচু করে চলার যারা অধিকার পেয়েছেন, তাঁদের কাছে এই ঋণের অঙ্গীকার হবে শুধু একটুখানি নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম আর মানুষের জন্য কিছু নিখাদ ভালোবাসা। আর কিছু নয়।

লেখক: ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদের ছেলে, ফিলাডেলফিয়া যুক্তরাষ্ট্র