জাতি হিসেবে আমরা কৃতজ্ঞ

বেশ কদিন আগে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠেই পড়লাম যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটা দল, প্রায় ২৫ জন অফিসার সপত্নীক গিয়েছে ভারতে, সরকারের অতিথি হিসেবে। খবরটা পড়েই মনের পর্দায় সেই সকাল থেকেই ভেসে উঠল অনেক স্মৃতিময় ছবি। সেই ১৯৭১ এর কালো দিনগুলো থেকে সিলেটের বর্তমান ক্যাডেট কলেজে ১৯৭২ সালে দেওয়া বিদায় বড়খানার স্মৃতি । ’৭২ সালে বরইগ্রাম -জকিগঞ্জ- করিমগঞ্জ- বাড়াক নদী গাঁ ঘেঁষে সরু সরীসৃপের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে মুক্তি বাহিনীর বেডফোরড ট্রাকে বা ছি’-যে সিক্স জিপে করে ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর মাছিমপুর ক্যান্টনমেন্ট হসপিটালে যাওয়ার কথা-প্রতি সপ্তাহেই সিলেটের বর্তমান ব্লুবার্ড স্কুল, যা নাকি বাংলাদেশ ফোর্সেস (মুক্তিবাহিনীর) ৪ নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টার ছিল গাড়ি যেত মাছিমপুরে রেশন ও ফ্রেশ আনতে । আর আমি যেতাম প্রত্যেক সপ্তাহে আমার জন্ডিস চেক আপ করাতে । আজও ভুলতে পারি না তাঁদের চিকিৎসা । নয় মাস রিফুজি ক্যাম্পে থাকতে থাকতে আরও কত প্রকার রোগে যে আক্রান্ত হয়েছিলাম সে গল্প অন্য দিন না হয় করব।
১৯৭১ সালে আমাদের রিফুজি ক্যাম্পের সামনে দিয়েই নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে শুরু হলো ইন্ডিয়ান আর্মির যুদ্ধ যাত্রা আর যুদ্ধের প্রস্তুতি। সারা রাত সারা দিন রাস্তা দিয়ে যেতে শুরু করল আর্মির গাড়ির বহর, ট্যাংক আর কাফেলা, কামানের ট্রাক—এত বড় লম্বা আর্টিলারি কামান জীবনেও দেখি নাই। হাজার হাজার গাড়ি, কয়েক হাজার সৈন্য শিখদের পাগড়ি পরা, ঝাট সৈন্যদের বিশাল গোঁফ, চাকমাদের মতো দেখতে গোর্খা সৈন্য জলপাই রঙের পোশাকে হাত নেড়ে আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ করত। নিজে নিজেই ভাবতাম নিয়তির কি নির্মম পরিহাস খাকি উর্দিপরা পাপিষ্ঠ পাকিস্তানি পাঞ্জাবিগুলোর হাতে নিহত হওয়ার ভয়ে পালালাম আর অন্য আরেক দেশের আর্মি আমাদের বাঁচানোর জন্য যুদ্ধে যাচ্ছে- কি আশ্চর্য? আমাদের দেশ স্বাধীন করার জন্য ওরা ওদের নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত! এ যে কত বড় মহানুভবতা তা প্রকাশ করার ভাষা আমার তখনো ছিল না, আর আজ ৪৬ বছর পরেও নেই।
ডিসেম্বর মাসে আমি আর আমাদের বর্তমান আইনমন্ত্রীর অনুজ, আমার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু রনি জয়বাংলা পত্রিকা আগরতলা-আখাউড়া রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিলি করতাম আর করুন চোখে তাকিয়ে দেখতাম শত শত মৃত, আহতদের—পা উড়ে গেছে, চক্ষু ফুটো হয়ে লাল রক্ত নির্গমন করছে—একের পর একে ট্রাক, সবুজ রঙের ভারতীয় আর্মির অ্যাম্বুলেন্স, রিকুইজিশন করা সিভিল লরিতে করে ওই সব ভারতীয় সৈন্যকে নিয়ে আসা হচ্ছে আখাউড়া যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে। আগরতলা পলো গ্রাউন্ড, জি বি হসপিটাল, কুঞ্জবন, অভয়নগর, নন্দনগর এলাকায় অস্থায়ী হাসপাতালে তিল ধারণের জায়গা ছিল না—আহত, মৃত ভারতীয় সৈনিকে ভরা থাকত। তখনই মনে ভয় জাগত আবার মনে হয় আমার পালা পিতা হারানোর। কি জানি আজ ক্যাম্পে গিয়েই শুনব আব্বা সিলেট সেক্টরের অমুক এলাকার অমুক যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু শত্রুর আক্রমণ ও গোলাগুলির জন্য বাবার মৃতদেহ আনতে পারে নাই। সারাক্ষণ মনটা এই ভয়েই ভীত থাকত। কিন্তু একবারও ভাবতাম না যে ভাই জানকে হারাব।
আমাদের এক সাগর আর ইন্ডিয়ান আর্মির এক নদী রক্ত বয়ে গিয়েছিল বাংলার নদ, নদী, খাল, বিল, হ্রদ ও হাওর দিয়ে। ওই রক্ত ঝরা ১৯৭১ আমাদের স্বাধীনতা এনেছে। আমাদের দেশ, আমাদের মা, আমাদের স্বপ্ন, আমাদের মাটি কে পাকিস্তানি হানাদার রক্ত পিপাসু ঘাতকদের হাত মুক্ত করতে। ১৯৭২ সালে ইন্ডিয়ান আর্মি সিলেট-কুমিল্লা সড়কের ব্রিজ, ক্বিন ব্রিজ, শাদিপুর, শেরপুর ফেরি, ছাতক-সুনামগঞ্জ রোডের ফেরি চালু করা, খাদিমনগর থেকে মাইন পরিষ্কার করা, শালুটিগড়ে রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলে বন্দী বীরাঙ্গনাদের শিখ সৈন্যদের মাথার পাগড়ি খুলে আবরু ঢাকার ব্যবস্থা করে ওদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া, সিলেট বিমানবন্দর মাইনমুক্ত করে একদিন বিদায় নিল বাংলাদেশ থেকে অশ্রুসিক্ত নেত্রে।
নিজের চোখে দেখা এই ইতিহাস। আমি এর নীরব সাক্ষী। সিলেট-তামাবিল রোডের হরিপুরে রাস্তার ১১ নম্বর মাইল পোস্টের পাশে কবরে শায়িত হাবিলদার গোলাম রসুল বীর বিক্রম ও ওর সাথিরা - ওরা আমার বাবার ট্রি উইং ইপিআর কোম্পানির সৈনিক সেই ২৭ ই মার্চ শমশেরনগর প্রথম বিদ্রোহীকারী কোম্পানির সহযোদ্ধা। সিলেট যুদ্ধে ওই হাওরে আমার বাবার পজিশন থেকে তিন ফুট দূরে পাকিস্তানিদের গুলিতে ইন্তেকাল করল ওরা চারজন। ওই যুদ্ধের গল্প বাবা আমাকে সারা জীবন বলতেন আর এও বলতেন যে ওই দিন ওনারও জান নিয়ে ফেরত আসার কোনো উপায়ও ছিল না—চারদিকে ঘিরে ফেলছিল পাকিস্তানিরা। ঠিক ওই মুহূর্তে বাবা ওয়ারলেসে গোর্খা রেজিমেন্টকে পজিশন জানাল। অকুতোভয় ৫ম গোর্খা রাইফেলের অভিযান চালাল বাবার কোম্পানিকে বাঁচানোর প্রয়াসে। বাবা সব সময় বলতেন সেই দিন ফিফথ গোর্খা তাঁদের রেসকিউ করতে না এগিয়ে এলে আমরা হয়তো ওনাকে আর কোনো দিন দেখতে পেতাম না। সম্মুখ যুদ্ধে হাওরের মধ্যে অবস্থিত মাজার কমপ্লেক্সে পাকিস্তান আর্মির প্লাটুনকে পরাজিত করে আমার বাবার দলকে বিপদ মুক্ত করেছিল সেই সাহসী ফিফথ গোর্খা; যাদের ডাকা হয় ভিশি পল্টন (ভিক্টোরিয়া ক্রস) রেজিমেন্ট। এ ঋণ আমি কেমনে শোধ করব তা আমার জানা নেই। তাই লিখে জাতিকে জানাতে চাচ্ছি, আমরা তাঁদের কাছে কতটা ঋণী।
জান্তাদের ভাগানোর পর আবার ঘাড়ে সওয়ার আরেক জগদ্দল পাথর-দেশীয় জান্তা। আর ওই জান্তাদের তল্পিবাহকেরা ক্রমে মস্তিষ্ক ধৌত করে করে ভুলিয়ে দিল বন্ধুকে। আর বানিয়ে দিল ওদের আমাদের শত্রু। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! আজ এত বছর পর ওই দিনগুলোর কথা রোমন্থন করতে গিয়ে আমি অশ্রুসিক্তপ্রায়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নতুন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এই উদ্যোগের স্থপতি এবং এটা তাঁরই একটি মস্তিষ্ক শিশু। আমার কাছে কোনো বাক্য নাই; যা দিয়ে আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাব। নীরবে, নিভৃতে তিনি সূচনা করেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে একটা নতুন অধ্যায়ের। বাংলাদেশি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে সৃষ্ট এই সম্প্রীতির প্রতি রইল আমার অবারিত অভিনন্দন। বিজয়ের মাসে বিজয় ত্বরান্বিত করার সহায়ক ভারতীয় সেনা বাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমানবাহিনী এবং বিএসএফের সব সদস্যকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। আমরা তোমাদের ঋণ কখনোই শোধ করতে পারব না। জাতি হিসেবে আমরা তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ।

ইমরান এ চৌধুরী লেখক ও পাবলিক স্পিকার