লেবেল ফর প্লেয়িং

.
.

বাংলাদেশে সম্ভবত একটি বাক্য এখন সব আলোচনার মূল বিষয়, তা হলো লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড। গল্ফ ছাড়া খেলার মাঠ সব সময় সমান থাকে তা যে খেলাই হোক না কেন। আমরা এর অর্থ কি বুঝি তা জানার চেষ্টা যদি করি, তাহলে বলতে হয় এটি বেশ রাশভারী এবং সাহেবি ভাষা; যার পরিষ্কার বাংলা হলো “নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ”। এখানে তিনটি শব্দই আলাদা অর্থ বহন করে। যেমন: এক লেবেল, দুই প্লে, তিন ফিল্ড; সঙ্গে নির্বাচন জুড়ে দিলে এ নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না। আমরা বেশি দূর যাব না তবে কিছু বিষয় আলোচনা করলে আমরা জেনে যাব নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড কি জিনিস। যেমন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, এবারের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে বিশ্বে মুখ দেখানো যাবে না। এই প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকার জন্যই কি আপন ভাগনেকে মনোনয়ন পাইয়ে দিলেন? এটা গোলাম মওলা রনি সাহেবের প্রশ্ন, আমার নয়। তাই আশা করছি, মাশরাফি বেশ ভালোভাবে উতরে যাবেন আর এরশাদ সাহেব সারা জীবন গল্ফ নিয়ে ছিলেন বলে তাকে হয়তো হাসপাতালে থেকেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তফসিল শেষে মনোনয়ন বাণিজ্যসহ আসন ভাগাভাগি সম্পন্ন হয়েছে। টিভি টক শোতে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন সাহেবকে বলতে শুনেছি, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখনো দৃশ্যমান নয়। এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ শব্দ যোগ হয়েছে। তা হলে কি দাঁড়ায়, নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ দৃশ্যমান হতে হবে।
জনাব এইচ টি ইমাম যিনি কিনা সরকারের বা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রধান ইমাম, যাঁর কল্যাণে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং খালেদা জিয়ার ননদ–ভাবির মতো ফোনালাপ শুনেছিলাম ও দেখেছিলাম । তাঁকে সংবাদ সম্মেলন করে বলতে শুনেছি কিছু মানুষ নাকি সরকার, রাষ্ট্রযন্ত্র ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে নানা উসকানিমূলক কথা বলছে। ওনার কথাগুলো আমি বেশ কয়েকবার শোনার পর বুঝতে চেষ্টা করলাম ওনার মতো অভিজ্ঞ একজন মানুষ কেমন করে নির্বাচনের সময় কমিশনে বসে তিনটি আলাদা বিষয় এক করে ফেলেছেন। এই এক করে দেখার উল্টোটাই হলো, লেবেল নির্বাচনে রাষ্ট্র ও সরকার হলো আলাদা একটা সততা। তাই পাবলিক যদি উসকানিমূলক কথা বলেও থাকে তাতে তাঁর জ্বলন হওয়ার কোনো কারণ দেখি না। তিনি নাক গলিয়ে সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দিলেন নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন সবই আওয়ামী লীগের। এবার খুব সহজেই অনুমেয়, প্লে করার সুযোগ কতটা বিরোধী দল পাবে। টানা দশ বছরের সাজানো সংসারে না চাইতেও চলে আসা মেহমানরা আপ্যায়ন পাবে তা বোঝার জন্য বড় পণ্ডিত হওয়া লাগে না। দেশে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে, কি নেই জানতে চাইলে আওয়ামী ঘরানার সবাইকে এক বাক্যেই বলতে শুনি রাজাকার-আলবদররা যত দিন এ দেশে নির্বাচনে অংশ নেবে, তত দিন এ দেশের নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে না। ১৯৭১ সালে আমরা ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিজয় পেয়েছি। তাহলে কেন আজও রাজাকার বলে যাঁরা চিহ্নিত তাদের নির্বাচন করবার সুযোগ দেওয়া হয়? আজও কেন আমরা দেখতে পাই রাজাকার আলবদর নামে পরিচিত লোকজন দুই দলেই বহাল তবিয়তে আছেন এবং এবারেও নির্বাচন করছেন ।
নির্বাচন বিষয়ক রিপোর্টিং প্রশিক্ষণে এ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কাজী রকিব মন্তব্য করেন, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্লেটে করে তুলে দেওয়া যায় না। এটা খেলতে খেলতে হয়। দুই দল যদি সমান সমান হয়, আর যদি খেলা শুরু করে তবে ওখানেই ফিল্ড তৈরি হয়।’ওনার কথার সূত্র ধরেই যদি বলতে হয় ২০১৪ সালে বিরোধী দল নির্বাচন করে নাই এবং এমন কোনো উল্লেখযোগ্য আন্দোলনের মধ্যেও তাদের দেখা যায় নাই। তাহলে দশ বছর পর তারা যদি সমান সুযোগ আশা করেন তা কি করে সম্ভব। সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক দলগুলো যদি কাজ করার স্বার্থে এগিয়ে আসে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সে সময়ই লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়ে যায়।

.
.

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের কথা শুনছিলাম, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আমাদের জন্য হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাচ্ছি না। এ ক্ষেত্রে বিএনপি অনেক বেশি সুবিধা পাচ্ছে। কোনো কারণ ছাড়া মিডিয়াতে তারা দিনরাত আমাদের নামে গালাগালি করছে। তিনি বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আমরাও চাই। (বিএনপি) যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চায়, সেটাও নাকি অবৈধ হস্তক্ষেপ। তারা চায়, তাদের দণ্ডিত আসামি বেগম জিয়ার মুক্তি। তা নাকি একেবারেই সম্ভব না। সাধারণ জনগণের বোঝা মুশকিল, তিনি কেমন করে শিউর হলেন বেগম জিয়ার মুক্তি সম্ভব না। কথা সত্য বেগম জিয়া মুক্তি পাননি। সাধারণ ভোটারেরা আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ও সংশয় রয়েছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার হয়রানি করা হচ্ছে। পুলিশ নাকি জঙ্গি খোঁজার নাম করে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করছে। বিরোধী মতাদর্শী ছেলেরা নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে থাকছেন। কেউ কেউ এই সময়টাকে যুদ্ধের সময়ের মতো মনে করছেন। তখন বাড়ি বাড়ি ‘মুক্তি’ খোঁজা হতো এখন খোঁজা হয় জঙ্গি। তাই নির্বাচন কমিশন সিটিগুলোতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করছে না বলে অভিযোগ উঠছে।
প্রত্যেকটি দেশে তার নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ডে নির্বাচন হয়। বাংলাদেশে বাংলাদেশের স্টান্ডার্ডে নির্বাচন হবে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেই কি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়? আমেরিকাতেও নির্বাচন নিয়ে অনেক অভিযোগ উঠেছে সেখানে ৩০ লাখ কম ভোট পেয়ে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী নির্বাচনের সমীক্ষায় যদি দেখেন যে বেশির ভাগ জনগণ একটি দলকে চায়, কিন্তু সেই দল ক্ষমতায় আসতে পারেনি। তাহলে বুঝতে হবে কোনো গন্ডগোল আছে। আর যদি দেখেন যে জনগণ যাকে চায় সে-ই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে, সে ক্ষেত্রে আর প্রশ্ন করার কোনো উপায় থাকবে না। নেতাদের মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, কানাডায় বেগম পল্লি বানানোর রসদ কোথা থেকে আসে তার হিসাব জাতি একদিন ভোটের মাধ্যমেই দেবে। আমজনতার জীবনকে অনিশ্চিত ও অনিরাপদ করে নিজ পরিবার–পরিজনের ভবিষ্যৎ নিরাপদ নিশ্চিত করতে আপনি কতটুকু অন্যায় জাতির সঙ্গে করছেন তার উত্তর পাওয়ার জন্য জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে ভোট দিতে যেতে হবে ।
প্রকৃত অর্থে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বলতে আমরা বুঝতে চাই সব দলের সমান নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ। তাহলে যতই প্রশ্নই থাকুক না কেন, সব দল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংবিধান বা সংবিধানের মূলনীতি-গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তা ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করুক বা না করুক, সব দলের যেহেতু দেশে সমান সংখ্যক ভোটার সেই স্বাধীনতার পর থেকেই তৈরি হয়ে আছে, তাই সব দলেরই সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে। সব দল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় বিশ্বাস করে বা নাই করে, আমরা কি সে সব প্রশ্নে না গিয়ে দেশ নিয়ে ভাবতে পারি না? বিরোধী দল কি মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে বা জাতির পিতাকে মান্য করে অথবা বিএনপি মুক্তিযুদ্ধ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কি না তা নিয়ে আর জাতি ভাবনায় সময় নষ্ট করতে চায় না। জামায়াতকে মিত্র গণ্য করেই কালে কালে জোট বেঁধেছেন সবাই। কাজেই আশা করি, জাতীয় স্বার্থে ঘুষ, দুর্নীতি, দখলবাজি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে সব দলের সমান অংশগ্রহণের দ্বারা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের জনগণের ভোটে একটি সার্থক সুন্দর সরকার গঠন হবে।