রক্তে যাঁর রাজনীতি

আসা এবং যাওয়া। আসার সময় সিরিয়াল মানতে হয়, যাওয়ার সময় না। আজ বৃহস্পতিবার, সকাল থেকে মনটা ভালো নেই। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি, সৈয়দ আদিলের পোস্ট করা একটি ছবি। আনা ভাইয়ের রুহের মাগফিরাত কামনায় বনগাঁওয়ে কোরআন খতম হচ্ছে। বনগাঁও আমার শ্বশুর বাড়ি। আনা ভাই আমার সম্বন্ধী। স্ত্রী হাসিকে বললাম। হাসি বলল, তা কি করে হয়। তাঁর ভিসা হয়েছে, সিলেটে গেছেন বিদায় নিয়ে আসতে। নাশেদা (তাঁর মেয়ে) সঙ্গে আছে। ফোনটা হাতে নিয়ে হাসি ম্যাসেজ দেখলো। ‘অবিশ্বাস্য’ বলে মৃদু আর্তনাদ করে দোয়া কালাম পড়া শুরু করল। আনা ভাই আমার প্রিয় মানুষ। সদা হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত। আমাকে ছোট বোনের স্বামী হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবে দেখতেন। নিউইয়র্কে নাশেদা ও মাশুকের আপস্টেটের বাসায় হাসি ও আমি তাঁর সঙ্গে আনন্দঘন সময় কাটিয়েছি। ওই মুহূর্তগুলো ভোলার নয়। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। কিছুদিন আগেও মৃত্যু চিন্তায় বিষণ্ন থাকতাম। ছয় সাতবার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে খানিকটা কুঁকড়ে যাই। নানা অসংগতি দেখা দেয়। পরে ধরে ধীরে তা কেটে যায়।
যেকোনো সময় যেকোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকি। এটাকে জীবনের অংশ ভাবি। এই ভাবনা নিজেকে অনেকটা হালকা করে রাখে। শুরুতে বলছিলাম আসা-যাওয়ার কথা। আসার সময় সিরিয়াল মানতে হয়, যাওয়ার সময় না। এক দোয়া মাহফিলে ইমাম সাহেবের দেওয়া বক্তৃতার অংশবিশেষ মনে পড়ল, ভাবলাম শেয়ার করি। মানুষ পৃথিবীতে আসে ক্রমিক বা সিরিয়াল মেনটেইন করে অর্থাৎ প্রপিতামহের পর পিতামহ, পিতামহের পরে পিতা, পিতার পরে পুত্র বা কন্যা, এরপর নাতি নাতনি, এরপর…। কিন্তু যাওয়ার সময় এই নিয়মে যায় না। আগে-পিছে যে কারও মৃত্যু হতে পারে। এই ইমাম সাহেবের বক্তৃতার আরেকটা অংশও মনে পড়ে। তিনি বলছিলেন, আমাদের ধর্মে মৃত্যুকে বলে ‘ইন্তেকাল’। ইন্তেকাল আরবি শব্দ, এর অর্থ স্থানান্তর। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া। আমাদের মৃত্যুটা হচ্ছে স্বল্পকালীন এক ছোট্ট জগৎ থেকে অনন্ত এক বৃহৎ জগতে প্রবেশ।
আজকের এই লেখাটি আমার ফোনে আমারই হাতে করা প্রথম টাইপ। মনে হলো, একটা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলছি। এটি পারলাম যাদের সহায়তা ও প্রেরণায়, তাঁরা হলেন প্রথম আলোর ইব্রাহিম চৌধুরী খোকন, আহমাদ মাযহার এবং আমার ছেলে–মেয়ে, বউমা ও জামাই। আমি কৃতজ্ঞ তাঁদের কাছে।
প্রথম টাইপের লেখায় জীবনের কোনো জয়গান নেই, বলছি মৃত্যু ও বিষণ্নতার কথা। আসলে সব নিয়েই তো জীবন। কখনো সুখ, কখনো দুঃখ। জীবনেরই দুটি অংশ। একের পর এক, কখনো পাশাপাশি, কখনো বেশি, কখনো কম। জীবন থেমে নেই। এবার জীবনেরই এক গল্প বলি। সত্তরোর্ধ্ব এক প্রবাসী। নিউইয়র্কে থাকেন, বাড়ি সিলেটে। বাংলাদেশে এখন নির্বাচন। উৎসব আর উত্তেজনা। চারদিক সরগরম। নির্বাচনে অংশ নিতে প্রবাস থেকেও যাচ্ছেন অনেকে। কেউ প্রার্থী হতে, কেউ আত্মীয় বা দলের হয়ে প্রচারণা চালাতে, কেউবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে। নিউইয়র্কে আমার ঘনিষ্ঠজন ড. এ কে আবদুল মোমেন, এম এম শাহীন ও আবদুল মোসাব্বির রয়েছেন। কেউ দলের হয়ে, কেউ ব্যক্তিগতভাবে লড়বেন। রাজনীতি আমাদের অনেকের জীবনের অপরিহার্য অংশ। রক্তে যেন মিশে আছে। জীবনাচরণে রাজনীতি, ধমনিতে রাজনীতি, চিন্তায় কর্মে রাজনীতি। যেসব দেশে বাঙালি আছেন, সঙ্গে আছে দেশীয় রাজনীতিও। সব জায়গায় দলের শাখা–প্রশাখা। সভা সমাবেশ। আছেন হাজারো নিবেদিত নেতা–কর্মী। তারা কয়জন জীবনের হিসাব মিলিয়ে দেখেছেন? কী তারা পেলেন অথবা কী পেল দেশ তার হিসেব নেওয়ার ফুরসত কি তারা পেয়েছেন? রাজনীতির নেশা যখন ধমনিতে, এ সব অঙ্ক কষার সময় কোথায়। তাই শুধু ত্যাগ আর ত্যাগ। দেওয়ার মাঝেই সব আনন্দ। আমাদের আলোচ্য প্রবাসী এই দলে। শুধু দিতে চান। দিয়ে দিয়েই জীবনটা পার করছেন। যত দূর জানা যায়, তিনি সব নির্বাচনেই উপস্থিত থাকেন। দু–একবার নিজে প্রার্থী হয়েছিলেন। বাকি সময় দলের বা পছন্দের প্রার্থীর জন্য নিজেকে উজাড় করে দেন। আদর্শপ্রিয় মানুষ। আদর্শের জয় চান। সিকি শতাব্দীর বেশি সময় নিউইয়র্কে আছেন। এখান থেকেই সব নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এবার বয়স হয়েছে, শরীরে নানা অসুখ–বিসুখ। পরিবার ও শুভানুধ্যায়ীদের ইচ্ছা, এবার যেন তিনি না যান। কিন্তু রক্তে যেখানে রাজনীতি, তাকে কে আটকায়? প্রার্থী তাঁর অপেক্ষায় আছেন, তাঁকে যে যেতেই হবে!

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।