নতুন বছরে কানাডার সিনেমা

গ্লোরিয়া ইয়াজদানির ফ্লেমস অব ফিউরি নিয়ে একটি সন্ধ্যা
গ্লোরিয়া ইয়াজদানির ফ্লেমস অব ফিউরি নিয়ে একটি সন্ধ্যা

হলিউড নর্থ নামে পরিচিত কানাডার সিনেমার জগৎটা হলিউডের মতো চোখ ধাঁধানো নয়। তবে খুব পিছিয়েও নেই। র‌্যাঙ্কিংয়ে লস অ্যাঞ্জেলেস ও নিউইয়র্কের পরই কানাডার সিনেমা বাণিজ্য। মূলত ভ্যাঙ্কুভার ও টরন্টো শহর দুটিকে ঘিরেই সিনেমা নির্মাণ ও কেনাবেচার হাট-বাজার। এই রঙিন দুনিয়ায় ডাইভার্সিটি শব্দটি বেশ প্রচলিত। এ কারণে এখানকার এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে ‘পারসন অব কালার’দেরই কাজ করে ভাত খাওয়ার সুযোগ বেশি। ব্যাটে-বলে ঠিকমতো লাগতে যতক্ষণ। বিখ্যাত হওয়ার সুযোগ তো রয়েছেই। সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে কত জনের সঙ্গে পরিচয় হয়। ওদের জীবনের গল্প, সংগ্রামের গল্প, সফলতার গল্প শোনার একটু ফুরসত হয়। ওই গল্প শুনে মনে হয় এ তো আমারই জীবন। কিংবা এই রকমও হয় জীবন!
‘ফ্লেমস অব ফিউরি’ সিনেমার গ্লোরিয়ার সঙ্গে এই পথেই পরিচয়। এই সিনেমার চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনা করেছে সে। আর করেছে প্রধান চরিত্রে অভিনয়। পারস্য বংশোদ্ভূত কানাডার থিয়েটার, টেলিভিশন ও সিনেমার একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনয় শিল্পী গ্লোরিয়া ইয়াজদানি। তার পরিচালিত প্রথম ফিচার ফিল্ম ‘ক্রিমসন স্যান্ডস’ ব্রাজিল, জার্মানি ও কানাডায় সেরা স্বাধীন কাহিনিচিত্রসহ সম্মানজনক অন্যান্য পুরস্কার পেয়েছে। ‘ফ্লেমস অব ফিউরি’ তাঁর দ্বিতীয় ফিচার ফিল্ম। এই ‘ড্রিম প্রজেক্টে’ গ্লোরিয়া এমন একটি গল্প সাজিয়েছেন, যা অনেকগুলো সত্য ঘটনার যোগফল। এই সিনেমায় যাদের দেখেছি তাদেরকে অচেনা মনে হয়নি। ঘটনাগুলোও চেনা-জানা। স্থান ও সময়টাই শুধু ভিন্ন। তাহলে ভালো সিনেমা তৈরির জন্য কী লাগ?
কি কি ফ্যাক্টর ‘ভালো সিনেমা’ হয়ে ওঠার জন্য জরুরি? মাথায় প্রশ্নটা ঘুরছে গ্লোরিয়ার সিনেমার ডিরেক্টরস কাট প্রিভিউ করার পর। প্রশ্নটা ঘুরছে ঘুরুক। এই অবসরে বলি অর্ধসমাপ্ত সিনেমা ‘ফ্লেমস অব ফিউরি’ দেখার কারণ। গ্লোরিয়া ওর বন্ধুদের ও বন্ধুর বন্ধুদের মাধ্যমে অপরিচিত সিনেমাখোর মানুষদের জড় করল এক সন্ধ্যায়, যেখানে সবাই প্রায় সর্বভুক সিনেমার ভোক্তা। এরা সবাই হৃদয়ের সবটুকু নির্মমতা ও মুক্ত মনের আন্তরিকতা দিয়ে রাফ এডিটেড সিনেমাটি দেখে। দেখার পর সততার সঙ্গে কোনো প্রকার রাখঢাক না রেখে শুধু নিজের নামটি গোপন রেখে নির্ধারিত ফরমে সিনেমাটির পোস্টমর্টেম করে। এই পোস্টমর্টেম রিপোর্টগুলো থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিয়ে ছবিটির পরিমার্জন করা হবে। তারপর আরও কিছু যোগ-বিয়োগ করে চূড়ান্ত নির্মাণ শেষ হবে। তারপর সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়া হবে। আর এই যে খরচপাতি হবে, এ বাবদ সেটাও প্রযোজকের পকেট থেকেই যাবে। প্রযোজকদের দেখে মনে হলো যে জীবনে ধন্য হওয়ার মতো অত্যন্ত প্রিয় একটি কাজে তাঁরা যুক্ত আছেন। তাই প্রিভিউ সন্ধ্যায় অতিথি আপ্যায়ন করতে প্রযোজকদেরকেই গরম কফির বাকেট নিয়ে তৎপর হতে দেখি। সিনেমাকে আঁতুড় ঘর থেকেই মানুষের সঙ্গে যুক্ত করার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। পুরো কাজটায় একটা সততা রয়েছে, যেখানে শর্টকাট নেই। আসিতেছে সম্পূর্ণ ‘ভিন্ন স্বাদের, সাসপেন্স, ক্লাইমেক্স, ড্রামায় ভরপুর’, ‘জীবন ঘনিষ্ঠ উপাদানে’, ‘রোমান্সে ঠাসা‘, ‘রহস্যে পরিপূর্ণ’ কিংবা ‘এ রকম সিনেমা জীবনে কেউ কখনো দেখেনি’, ‘এই প্রথম এই দুনিয়ায়’-ইত্যাকার আগডুম বাগডুম আওয়াজ নেই। হোক না সেটা হলিউড, হলিউড নর্থ বা পৃথিবীর যেকোনো সিনেমার জন্মভূমি। সততা ও দর্শক সম্পৃক্ততা সিনেমার জন্মকে স্মরণীয় করে রাখতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।
গ্লোরিয়ার সিনেমাটি শুরু থেকেই দর্শকদের সঙ্গে সংযুক্ত। প্রি প্রোডাকশনের শুরুতেই চিত্রনাট্যটি অভিনয় করে পাঠ করা হয়েছে একটি নাট্যমঞ্চে, যেখানে আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞ দর্শক, সমালোচক ছাড়াও ছিলেন টিকিট কেটে পাঠাভিনয় দেখতে আসা দর্শক। পরপর দুটি প্রদর্শনীতে পাঠাভিনয়ে অংশ নিয়েছিল কানডার থিয়েটার, টেলিভিশন ও সিনেমার অভিনয় শিল্পীরা। সেখান থেকেই শুরু দর্শকদের মতামত নেওয়া, যার মাধ্যমে সিনেমার নির্মাণের ধাপগুলো অতিক্রম করা হয়েছে। তারপর বিভিন্ন চরিত্রে যথাযথ কাস্টিংয়ের জন্য অডিশনের মাধ্যমে প্রফেশনাল শিল্পী চূড়ান্ত করা হয়। অবশেষে চূড়ান্ত শুটিং। তারপর রাফ এডিট করে বিশেষ প্রদর্শনীর মাধ্যমে আবারও মতামতের জন্য দর্শকের মুখোমুখি। কী চমৎকার পরিকল্পনায় এগিয়ে চলেছে সিনেমাটির জন্ম প্রক্রিয়া। যে প্রক্রিয়াতে রয়েছে শুরু থেকেই দর্শকের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার নান্দনিক বাণিজ্যিক কৌশল ও সততার সঙ্গে অন্যের মূল্যায়নকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচনা করে সেই অনুসারে সিনেমাটির ভালোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া। ‘ফ্লেমস অব ফিউরি’ দেখে যখন মতামত লিখে চলেছি, তখন মনে হয়েছে এই সিনেমাটি আমারও। যেখানে আমি সিনেমাটির ভালো লাগা, মন্দ লাগা বা বিশেষ কোনো পরামর্শ জানিয়ে দিয়েছি নিঃসংকোচে, নিরপেক্ষভাবে। সততার সঙ্গে। একটি প্রশ্ন ছিল যে, ‘ফ্লেমস অব ফিউরি’ সিনেমাটি যখন হলে দেখানো হবে, তখন সেটি অন্যকে দেখতে যেতে বলা উচিত কিনা। আমার পরিচিত সব বন্ধুকে, তাদের মাধ্যমে তাদের বন্ধুদের সবার জন্য, সকল দর্শকের জন্যই একটি নতুন সিনেমা ‘ফ্লেমস অব ফিউরি’। আরও কিছু পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শেষে আগামী বছরের প্রথম দিকেই কানাডার বিভিন্ন শহরে রিলিজ হবে। প্রায় দু ঘণ্টার সিনেমাটিতে অন্যান্য চরিত্রে আরও অভিনয় করেছেন শন ডইয়ার, জিওফ মেইজ, মারনা ওলফ ম্যাক্সওয়েল, সারা ডেলভস, লিসা কোভাক, জিমি লিমব, ইসাবেলা ভাসবারজার, ডিন হাজাজসহ অন্যরা। স্বাধীন এ সিনেমার প্রযোজকত্রয়ী মিশেলা কিম, এমিলি বোলানস ও অ্যালিসন মিউলিংস। ইতিমধ্যেই সিনেমাটির চিত্রনাট্য রোম এলিফ্যান্ট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পেয়েছে। নিঃসন্দেহে ‘ফ্লেমস অব ফিউরি’র শুরুটা হলো সুন্দরভাবে।