কানাডায় স্প্যানিশ ফ্লু'র শতবর্ষ

কানাডার গ্লোবাল নিউজ গত অক্টোবর মাসে স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে প্রচারিত প্রতিবেদনে দেখিয়েছে শত বছর আগের সেই ভয়াবহ চিত্র। প্রশ্ন তুলেছে ভবিষ্যতে তেমন একটি ফ্লু থেকে নিজেদের রক্ষা করতে আমার কতখানি সমর্থ হয়ে উঠেছি।
কানাডার গ্লোবাল নিউজ গত অক্টোবর মাসে স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে প্রচারিত প্রতিবেদনে দেখিয়েছে শত বছর আগের সেই ভয়াবহ চিত্র। প্রশ্ন তুলেছে ভবিষ্যতে তেমন একটি ফ্লু থেকে নিজেদের রক্ষা করতে আমার কতখানি সমর্থ হয়ে উঠেছি।

পাঁচ বছর স্থায়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এক কোটি সত্তর লাখ মানুষের মধ্যে নিহত কানাডীয় সৈনিকের সংখ্যা ছিল ষাট হাজার। যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মানুষ নিহত হওয়ার ক্ষত দূর হতে-না-হতেই পৃথিবীজুড়ে শুরু হয়েছিল নতুন আরেক যুদ্ধ। সারা পৃথিবীকে গ্রাস করতে চাইল এক মরণব্যাধি। নতুন ধরনের সেই ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯১৮ সালের ৪ মার্চ— কানসাসের আমেরিকান সেনাসদস্যদের মধ্যে। তত দিনে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্যরা ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। হেমন্ত কাল বা আগস্ট মাস আসতেই ঝড়ের গতিতে ছড়াতে শুরু করল সেই জ্বর। বয়স নির্বিচারে আক্রান্ত হলেও বেশি প্রকোপ যেন দেখা গেল ২০ থেকে ৪০ বছরের যুবা বয়সীদের মধ্যে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে আক্রমণ হলেও সারা পৃথিবীর কোনো দেশই বোধ করি মুক্তি পায়নি এই জ্বরের ছোবল থেকে। ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামের সেই মহামারিতে পরের দুই বছরে সারা পৃথিবীতে মানুষ মারা গেল চার কোটির বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যদিও বলছে সংখ্যাটি আসলে পাঁচ কোটি। কারণ ভারতবর্ষে যে এক কোটি মারা গিয়েছিল তা রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কোনো কোনো গবেষকের মতে, মৃতের সংখ্যাটি প্রকৃতপক্ষে ১০ কোটির মতো হবে।
কানাডাতে প্রথম আক্রমণ হয় মন্ট্রিয়েলে। ৮ সেপ্টেম্বর। এক সপ্তাহের মধ্যেই ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। শুধু কানাডাতেই মারা যায় পঞ্চান্ন হাজারের বেশি। সদ্যসমাপ্ত যুদ্ধে যেখানে প্রতিদিন গড়ে মারা গিয়েছিলেন এক শত কানাডীয়, সেখানে ১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসে কানাডায় ওই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন মারা গেছেন এক হাজার জন। বলে রাখা যেতে পারে, আমেরিকাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৬ লাখ পঁচাত্তর হাজার। শুধু নিউইয়র্কেই সংখ্যাটি ছিল উনিশ হাজার। মন্ট্রিয়েলে মৃতের সংখ্যা এত বিশাল ছিল যে ট্রলি কারে লাশ বোঝাই করে শহর থেকে সরাতে হয়েছে। বলে রাখা যেতে পারে যে, স্প্যানিশ ফ্লু’র প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল ১৯১৮ সালে ফল ঋতুতে। পরেরটি আসে ১৯১৯ এর স্প্রিঙে। কোনো কোনো জায়গায় তৃতীয়বারের ধাক্কাও এসেছিল—আর সেটার সময় ছিল ১৯২০ সালে।
কানাডার ইতিহাসে ওই সংক্রমণ একটি বিশেষ অধ্যায়। ইতিহাসে অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে ২০০১ সালে টরন্টোর ডাবলডে প্রকাশনী থেকে অসাধারণ একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। ‘স্টোরি অব অ্যা নেশন: ডিফাইনিং মোমেন্টস ইন আওয়ার হিস্ট্রি’ শিরোনামের সেই গ্রন্থে কানাডার বরেণ্য সাহিত্যিক টিমোথি ফিন্ডলের একটি প্রবন্ধ আছে। কানাডার ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত নিয়ে মার্গারেট অ্যাটউড, আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েল, ডিয়োন ব্যান্ড, ডেভিড ম্যাকফারলেন বা টমাস কিঙের মতো প্রথিতযশা লেখকেরা লিখলেও টিমোথি লিখেছেন স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে। জানিয়েছেন কীভাবে যুদ্ধে তার কাকা মারা গেলেন; আর কীভাবে ফ্লুতে তার মামা মারা যান। কীভাবে ওই মৃত্যুর স্মৃতি পুরো পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে চলেছে। একপর্যায়ে টিমোথি লিখছেন:
The war was over. No one rejoiced.
Yes, they all went into streets. The bells rang. Everyone sang. There were fireworks. People climbed to their roofs and sat there, waving flags. A loud, long cheer went up. But no one rejoiced. On the third day of peace, there was silence.
Another war had begun. A war for survival.
কানাডার শহরে শহরে ঘোষণা দিয়ে স্কুল, কলেজ, থিয়েটার, চার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ওই সময়ে। সর্বত্র জনাসমাগম নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। চতুর্দিকে আতঙ্কময় সেই সময়ে এমনও দেখা গেছে একজন সকালে অফিসে গেছেন, কিন্তু বিকেলে বাড়িতে ফিরতে পারেন নাই — অফিসেই জ্বর ও মৃত্যু। এমনকি মৃত মানুষদের শবযাত্রায় ঘনিষ্ঠজন ছাড়া অন্যদের না থাকার জন্য পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।
ইতিহাস বলছে শুধু টরন্টোতেই মারা গিয়েছিল বারো শত জনের বেশি। ২০০৯ সালের ২ মে তারিখের ‘টরন্টো স্টার’ পত্রিকায় বলা হয়েছে, টরন্টোতে স্প্যানিশ ফ্লু’র প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর। দিন দশেকের মধ্যে শহরের একটি হাসপাতালে রোগটির প্রথম বলি হয় এক স্কুলছাত্রী। এক সপ্তাহের মধ্যে শহরের জেরার্ড স্ট্রিট ইস্টে অবস্থিত মিলিটারি-বেজ হাসপাতালে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ শত।
শতবর্ষে বিভিন্নভাবে জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে ভয়ংকর সেই রোগটির ভয়াবহতা। সারা বছর ধরে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে শত শত প্রবন্ধ-নিবন্ধ। ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখে সিবিসিতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে নিউ ফাউন্ডল্যান্ড এবং ল্যাবরাডরের ইনুইট জাতিগোষ্ঠীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু ঘটে সে-সময়। সে-সময়ে সেইন্ট জনসে মারা যান স্বেচ্ছাসেবী এথেল ডিকিনসন (১৮৮০Ñ১৯১৮)। তারিখটি ছিল ২৬ অক্টোবর। ১৯২০ সালে ৩৮ বছর বয়সী এথেলের মারা যাওয়ার দিনে তাঁর স্মৃতিতে শহরে একটি স্মারক নির্মাণ করা হয়।
২০০৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে টরন্টো স্টারে প্রকাশিত আরেক প্রবন্ধে হেলেন ব্রান্সওয়েল লিখেছেন, যদি অমন একটি ফ্লু’র আক্রমণ এখনকার সময়ে হয় তবে পৃথিবীর মোটামুটি ১৮ থেকে ৩৭ কোটি মানুষের মৃত্যু হবে। আর তাই এ বছর যখন বছরব্যাপী বিভিন্ন আয়োজনে শতবর্ষ আগের ভয়াবহ ফ্লু’র কথা স্মরণ করা হয়েছে, তখন একই সঙ্গে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ভবিষ্যতে এমন একটি রোগের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা থেকে আমরা কি সত্যি সত্যি শতভাগ নিজেদের মুক্ত করতে পেরেছি? ওই মহামারির শতবর্ষে এসে ডিফাইনিং মোমেন্টস কানাডা নামের একটি সংগঠন একটি উদ্যোগ নিয়েছে যেখানে অনলাইনে স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে অনেক অনেক তথ্য, গবেষণা, ছবি ইত্যাদি দিয়ে সমৃদ্ধ করা হচ্ছে।
টরন্টোতে বিধ্বংসী এই রোগের অসামান্য একটি বিবরণ পাওয়া যায় ‘ইফ আই ডাই বিফোর আই ওয়েক’ উপন্যাসে। দিনলিপির ঢঙে লেখা সে-উপন্যাসটি আসলে ফিওনা ম্যাকগ্রেগর নামে বারো বছরের এক কিশোরীর বয়ান। দিনলিপি শুরু হয়েছে ১৯১৮ সালের ৩ আগস্ট — ফিওনার জন্মদিনে। শেষ হয়েছে ১৯১৯ সালের ২২ মার্চ। ফিওনা বা ফি কিন্তু টরন্টো শহরেরই বাসিন্দা। স্প্যানিশ ফ্লু’র সময়ে ফি’র পরিবারের মানুষেরা আক্রান্ত হয় ওই ভয়ানক জ্বরে। ১৯১৮-১৯ সালের সেই ভয়ানক সময়কে বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে। বলে রাখা যেতে পারে, উপন্যাসের ফি কিন্তু সেই স্কুলেই পড়ে যে স্কুলের একজন ছাত্রী ওই জ্বরে টরন্টোতে প্রথম মারা গিয়েছিল।
নির্মম সে-জ্বরের সঙ্গে টরন্টো শহরের সম্পর্ক চিহ্নিত করে রাখতে ডিয়ার কানাডা থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত নন্দিত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক জ্যাঁ লিটলের সে-উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ফলকে উৎকীর্ণ করে জনসমাগমের জায়গায় স্থাপন করা হলো গত ১০ ডিসেম্বর। উদ্দেশ্য হলো পথচারীরা যেন জানতে পারেন এই শহরে এক শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সেই ঘটনার কথা — পড়তে আগ্রহ বোধ করেন ইতিহাসের ভয়াবহ সেই সময় নিয়ে রচিত অসামান্য গ্রন্থটি।