অফিস যাত্রা

খাও খাও, গেল গেল! এসব শব্দের ঝংকারে ঘুম ভাঙল। বাচ্চাগুলোও পারে বটে। পারলে সারা দিন খাবার মুখে রেখে দেবে, তবুও গিলবে না। এই জন্যই গিন্নির কণ্ঠে ‘খাও’, ‘গেল’ শব্দের ঝংকার। বেচারি সেই কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে গরম-গরম নাশতা তৈরি করে এখন গেলানোর মিশনে নেমেছে। খুবই কঠিন মিশন, অনেকটা ‘মিশন ইম্পসিবল’–এর মতো। আমি বলি খাবার সামনে রেখে দাও, খিদে লাগলে আপনি আপনি খাবে। গিন্নি সেটা করে না, করতে পারে না, মায়া লাগে নাকি! বাচ্চাগুলো কানাডায় জন্মেছে, কিন্তু কানাডীয় হতে পারেনি। যদি পারত তাহলে আর এই জ্বালা পোহাতে হতো না।
আমি কাঁচুমাচু করে ঘুম থেকে জাগি। ঘড়ির অ্যালার্ম বাজার এখনো ঠিক পাঁচ মিনিট বাকি। শুধু শুধু পাঁচটা মিনিট ঘুম নষ্ট হল। কী এত দরকার খাওয়ার তাগাদা দেওয়া? বিছানা থেকে উঠে লিভিং রুমে উঁকি দিই। ছোট মেয়ে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত আর বড় জন ব্যস্ত টিভি নিয়ে, মুখে তাদের খাবার। আগে সকালে উঠে গুড মর্নিং বলতাম। ইদানীং আর বলি না, কারণ উত্তর দিতে গিয়ে ওরা পড়বে মহা ফ্যাসাদে। ফুড়ুৎ করে মুখের খাবার বেরিয়ে গিয়ে মোবাইল আর জামাকাপড়ের বারোটা বাজিয়ে দেবে। এই সাত সকালে কী দরকার বাড়তি ঝামেলা পোহানোর? আমি আলগোছে কিচেন থেকে একগ্লাস পানি খেয়ে চলে যাই শেভ আর গোসল করার জন্য।
নাশতা শেষে রেডি হয়ে আমরা সবাই একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ি যার যার গন্তব্যে। আমাদের এক একজনের গন্তব্য এক এক জায়গায়। আমি যাব অফিসে, গিন্নি কলেজে আর বাচ্চারা ডে কেয়ারে। এই দেশে রিকশা-সিএনজি নেই। তাই আমাদের চার চাকার গাড়িটাই ভরসা। এই সময়টায় উপলব্ধি হয় গাড়ি এখানে আভিজাত্যের বিষয় নয়, বরং নিত্যব্যবহার্য জিনিস। অফিস আর কলেজ খুব সকালে শুরু হওয়ায় বাচ্চাদের কিছু সময়ের জন্য ডে কেয়ারে রাখতে হয়। আমাদের বাসার পাশেই এই ব্যবস্থা আছে। ডে কেয়ার চালায় এক বৃদ্ধ মহিলা। খুবই অলস প্রকৃতির এই মহিলা। ওর ওখানে যাওয়ার আগে টেক্সট করে জানাতে হয় ‘আমরা আসছি’। একদিন ভুলে টেক্সট দিইনি। বেচারি টেক্সট না পেয়ে আরামে ঘুমাচ্ছিল আর এই ঘুম থেকে ওঠাতে আমাদের পাক্কা পনেরো মিনিট নষ্ট হয়েছে। এরপর থেকে সকালে তাড়াহুড়ায় অন্য কিছু ভুলে গেলেও তাঁকে টেক্সট করতে ভুল হয় না।
দরজা খুলে বাইরে পা রেখেই দেখি সাদা কার্পেটের মতো কিছু বিছানো আছে সিঁড়িতে। অবাক হওয়ার বিষয়। মানুষ কোঁথাও গিয়ে পৌঁছানোর আগ মুহূর্তে গালিচা সংবর্ধনা পায় আর আমরা কিনা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গালিচা সংবর্ধনা শুরু হল। ব্যাপারটা কী? লাল গালিচার কথা শুনেছি ও দেখেছি। এখন তো দেখছি সাদা গালিচা সংবর্ধনাও আছে। আশে পাশে একটু তাকাতেই ভুল ভাঙল। শুধু সিঁড়িতেই নয়, চারদিকে সাদা শুভ্র জিনিস দিয়ে ঢাকা। শীতকাল সবে শুরু হয়েছে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি স্নো বর্ষণ করবে ভাবিনি। তেমন বেশি পড়েনি আজ। হালকা একটা আস্তরণের মতো পড়েছে। এখনো একটু একটু পড়ছে। হাতটা একটু বাড়িয়ে দিলে কেমন একটা তুলতুলে স্পর্শ পাওয়া যায়। পবিত্র পবিত্র মনে হয়। সাগুর দানার মতো উড়ে উড়ে পড়ছে অবিরাম। ছোট মেয়েটা আবার মুখে দিয়ে টেস্ট করছে কেমন স্বাদ।
বাচ্চাদের নামিয়ে এবার গন্তব্য গিন্নির কলেজ। যাওয়ার পথে এখানকার জনপ্রিয় টিমহরটনের কফি খাওয়াটা অনেকটা নিয়মে দাঁড়িয়েছে। নিয়মের চেয়ে বড় কথা এইটাই মোক্ষম সময় তা না হলে কফির সময় পাওয়া মুশকিল। ডাবল ডাবল কফি আমাদের পছন্দ। এক কাপ কফিতে দুই চামচ দুধ আর দুই চামচ চিনি। কানাডায় আসার প্রথম দিকে এই কফি জিনিসটা এমন বিশ্রী লাগত যে কারও পাল্লায় পড়ে একাবার খেলে আর দ্বিতীয়বার খাওয়ার কথা চিন্তাও করতাম না। আর এখন সেই কফি ছাড়া সকালটা ভালোভাবে শুরু হয় না। ড্রাইভওয়ে দিয়ে অর্ডার দিলেই সুবিধা। গাড়ি থেকে নামতে হয় না আর কফিও পাওয়া যায় দ্রুত। কফি খেতে খেতে গাড়ি চালিয়ে যখন ওর কলেজে পৌঁছাই কাপের তলানিতে খানিকটা কফি তখনো থেকে যায়।
গিন্নিকে কলেজে নামিয়ে এখন আমি শেষ গন্তব্য আমার অফিসের পথে। কাপের তলানিতে পড়ে থাকা কফিতে চুমুক দিতে দিতে রেডিওটা অন করে দিই। লোকাল খবরের চ্যানেলটা শোনার এইতো সময়। অন্যসময় বাচ্চাদের ক্যাঁচক্যাঁচানিতে অন্য চ্যানেল দিতে হয়। অফিস আর বেশি দূরে না। খানিকটা লোকাল ধরে হাইওয়ে ধরে কিছুক্ষণ ড্রাইভ করলেই আমার অফিস। কিছুটা দেরি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। আজ আবার মিটিং আছে। হাইওয়ে ওঠার পর দেখি রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অত্যধিক। উভয় পাশে আটটা করে লেন থাকার পরও গাড়িগুলো পা টিপে টিপে চলছে। একটু এগিয়ে যাওয়ার পর আইন ভঙ্গ করে ওভারটেক করে মনের সুখে ড্রাইভ করছি। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর টের পাই যে লাল নীল হলুদ কমলা রঙের বাতি জালিয়ে ঝিকমিক ঝিকমিক করে কেউ একজন আমাকে ফলো করছে। বুঝে ফেলছি এটা পুলিশ ছাড়া কেউ নয়। এই পুলিশগুলো না ওত পেতে থাকে, যেই কেউ অনিয়ম করবে আর খাবলা দিয়ে ধরবে। সাদা ড্রেসের পুলিশ যেমন দেখে বোঝা যায় না, তেমনি এই পুলিশের গাড়িগুলো রংবেরঙের বাতি না জ্বালালে বোঝা খুবই মুশকিল।
পুলিশের সিগন্যাল পেয়ে রাস্তার পাশে গাড়ি থামালাম। মনে মনে ভাবছি, পুলিশ আর সময় পেল না। আজকে আমার সভা আছে, আজকেই কেন আমাকে ধরতে হবে? আমি তো এই পথ দিয়ে সারা বছরই আসা–যাওয়া করি এবং এই ধরনের অনিয়মও করি সুযোগ পেলে। আমাকে ধরার সময় কি ফুরিয়ে গেছে? জরিমানা আজ দিতে হবে আমাকে। কিছু পয়েন্ট কাটবে আর কয়েকশ ডলার জরিমানা হবে নিশ্চিত। এখানকার যে পুলিশ! রফাদফা করা সম্ভব নয়। জরিমানা ছাড়া আজ রেহাই নেই। এই ভাবতে ভাবতে পুলিশ এসে আমার গাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল। আমি জানালার গ্লাস খুলতেই পুলিশ বলতে লাগল যে ওভারটেক করাটা আমার ঠিক হয়নি। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার ভুল স্বীকার করে বললাম ‘দুঃখিত’।
পুলিশ আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আর গাড়ির মালিকানার কাগজপত্র চাইল। আমি এগুলো পুলিশের হাতে দিলাম। সে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে পুলিশের গাড়ির ভেতর গিয়ে ঢুকল। এই সময়টায় পুলিশ তাদের কম্পিউটারে ড্রাইভারের ডেটাবেইস চেক করে আগের কোন হিস্ট্রি আছে কিনা দেখে এবং পরিশেষে অনিয়মের রকমভেদে চালকের জন্য জরিমানার টিকিট ইস্যু করে। আমি অপেক্ষায় আছি কত টাকা জরিমানা করে তা দেখার জন্য। খেয়াল করলাম, খুব দ্রুতই সে ফিরে এল। আমার হাতে কাগজপত্রগুলো দিয়ে বলল, এভাবে আর গাড়ি চালাবে না। কোন টিকিট ইস্যু করলাম না, তোমাকে সতর্ক করে দিলাম। পরের বার কিন্তু টিকিট ইস্যু করে দেব। আমি ওকে ধন্যবাদ দিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম আর মনে মনে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
আরও ১০ মিনিট ড্রাইভের পর অফিসে পৌঁছলাম। ঘড়িতে দেখি পাঁচ মিনিট দেরি। হন্তদন্ত হয়ে সভাকক্ষে ঢুকলাম। ব্যবস্থাপক আমাকে দেখে বলতে লাগল, ‘এইতো আপনি এসে গেছেন। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’