এই দেশ, এই দল আমারও

নিউজার্সির সাবেক গভর্নর ক্রিস্টিন টাড হুইটম্যান
নিউজার্সির সাবেক গভর্নর ক্রিস্টিন টাড হুইটম্যান

আমেরিকার নিউজার্সির গভর্নর ছিলেন ক্রিস্টিন টাড হুইটম্যান। অনেকটা প্রিন্সেস ডায়ানার মতো দেখতে। ডেমোক্র্যাটদের রাজ্য হিসেবে পরিচিত নিউজার্সিতে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। রিপাবলিকান দলের উদারনৈতিক ঘরানার এ নেতা প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের কেবিনেটে যোগ দিলেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর-পরবর্তী বুশ প্রশাসনের নীতির সঙ্গে তাঁর বিরোধ শুরু হলো। নিজেই পদত্যাগ করলেন। জর্জ বুশের তখন যুদ্ধংদেহী রাষ্ট্রনীতি। 

ক্রিস্টিন হুইটম্যান তাঁর বিখ্যাত বই ‘দিস ইজ মাই পার্টি টু’ (এটি আমারও দল) প্রকাশ করলেন। রিপাবলিকান দল যে শুধু জর্জ বুশ আর তাঁর অতিরক্ষণশীলদের পার্টি নয়, এ কথাই বলেছিলেন ক্রিস্টিন হুইটম্যান। রিপাবলিকান দল অনেক ডানে সরে গেছে। মূলনীতি থেকে সরে যাচ্ছে। এ দলের নীতি-আদর্শ যাঁরা এগিয়ে নিতে চান, তাঁদের ক্রমেই অপাঙ্‌ক্তেয় করে দেওয়া হচ্ছে—এমন কথাই ছিল ক্রিস্টিন হুইটম্যানের বইয়ে। বইটি ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর বেস্ট সেলার হয়েছিল। আমেরিকার রাজনীতিতে সাড়া জাগিয়েছিল ক্রিস্টিন হুইটম্যানের বইটি।

এরপর জল অনেক গড়িয়েছে। কঠিন সময়ে রিপাবলিকান ভাবধারা নিয়ে আমেরিকার রাজনীতিকে যাঁরা এগিয়ে নিয়েছিলেন, নেতৃত্ব তাঁদের হাত থেকে ফসকে গেছে বেশ আগেই। ২০০৫ সালে ক্রিস্টিন টাড হুইটম্যান তাঁর খেদ প্রকাশ করেছিলেন ‘দিস ইজ মাই পার্টি টু’ লিখে। আজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়ের রিপাবলিকান পার্টি আর এর কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্রিস্টিন টাড হুইটম্যান কী ভাবেন, তা খুব জানতে ইচ্ছে হয়। রিপাবলিকান দলের বর্তমান অবস্থা দেখে হুইটম্যান কি আজও বলেন, ‘এটি আমারও দল।’ না, অভিমান করে দূরেই থাকেন। একসময়ের তারকা রাজনীতিবিদ ক্রিস্টিনকে আজকাল আর দেখাই যায় না।

দেশের নির্বাচন নিয়ে চরম উৎকণ্ঠিত এক প্রবাসীর কথা ক্রিস্টিনের বইয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। ম্যানহাটনে ছোট ব্যবসা করেন প্রবাসী ফখরুল ইসলাম। বললেন, ‘দেশটা আমারও। দলটাও আমার।’ দেশে তাঁর ভোট নেই। ফলে নিজের দল আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে পারছেন না বলে খুব মন খারাপ তাঁর।
খেদের সঙ্গেই বললেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন এক ভিন্ন দল। যাঁরা আওয়ামী লীগ করেন, দল চালান, তাঁরা এখন আওয়ামী লীগের মালিক মনে করেন নিজেদের।’ মধ্যরাতে নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারে দাঁড়িয়ে এ প্রবাসী বললেন, ‘জীবনে প্রথম স্লোগান দিয়েছি “জয় বাংলা” বলে। আজও এই স্লোগানে শরীরে শিহরণ ওঠে। আজও বঙ্গবন্ধুর দরাজ আহ্বান কানে বাজে।’

আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের প্রতীক। অসাম্প্রদায়িক, উদার, গণতান্ত্রিক মনের মানুষের কাছে এ দলের কোনো বিকল্প নেই। অথচ যাঁরা দলের মধ্য পর্যায়ের নেতা, পাতিনেতা, তাঁদের অনেকে মনে করেন তাঁদের চেয়ে বড় কোনো আওয়ামী লীগার নেই, এটাই মানতে পারেন না ফখরুল। যেমন মানতে পারেন না, রাজাকারের গাড়িতে লাল-সবুজ পতাকা। বললেন, দেশে রাজাকারদের গাড়িতে যেদিন পতাকা উঠেছিল, মনে হয়েছিল আত্মহত্যা করি।

ফখরুল বললেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথাবার্তা শুনে তাঁর মন প্রবাসে বসেও খারাপ। খুব খারাপ। তিনি বিশ্বাস করতে চান না কোনো খারাপ কিছু। বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। সাধারণ মানুষ থেকে পুলিশ, সৈনিক, সরকারি কর্মচারী-সবাই “জয় বাংলা” বলে দেশকে স্বাধীন করেছে। এ দেশ “জয় বাংলা” স্লোগান আর একাত্তরের মহান চেতনা ধারণ করে এগিয়ে যাবে।’ কপটতা আর হিংসার পথে নয়, প্রতিহিংসা আর আক্রোশের পথে নয়। বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতায় নিজের দল আর নিজের দেশ আলোকিত থাকবে—এ প্রত্যাশা তাঁর।

দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য অসম্ভব ভালোবাসায় আপ্লুত মানুষটির কথা ভাবতে ভাবতে হল্যান্ড টানেলের দীর্ঘ সুড়ঙ্গ পাড়ি দিচ্ছি। নিউইয়র্ক আর নিউজার্সির সংযোগের আলো-আঁধারি এ সুড়ঙ্গের ধীরে চলমান গাড়িতে বাজছিল, ‘দিস ইজ মাই কান্ট্রি টু’ গানটি। আমেরিকার চল্লিশের দশকের বিখ্যাত এ দেশাত্মবোধক গানটি রচিত। কার্টিস মেয়ফিল্ডের গাওয়া এ গানের পঙ্‌ক্তিমালা এ রকম, This is my country/ Land of my birth/ This is my country/ Grandest on Earth (এটা আমার দেশ/ আমার জন্মভূমি/ এটা আমার দেশ/ পৃথিবীতে সেরা দেশ...।

This is my country/ Land of my choice/ This is my country/ Hear my proud voice (এই আমার দেশ/ আমার ভালোবাসার দেশ/ এই আমার দেশ/ আমার অহংকারের আওয়াজ শোনো...।
গাড়িতে বসে ক্রিস্টিন টাড হুইটম্যান, প্রবাসী ফখরুল ইসলাম আর শিল্পী কার্টিস মেয়ফিল্ডের ভাবনা আর আর্তি একাকার হয়ে উঠে আমার কাছে।

ইব্রাহীম চৌধুরী: আবাসিক সম্পাদক, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা
[email protected]