আশায় বুক বাঁধি

শেষ রাতে দরজা খুলে দেখি বছরের শেষ পূর্ণিমার চাঁদ, ক্রমশ নিচে নেমে আসছে। ভাষাহীন, তবু নীরবে যেন বলছে, ‘ভুলে যেয়ো যা কিছু অমাবস্যার অন্ধকার, আমি আবার আসব আঁধার শেষে একটু একটু করে পূর্ণিমার আলো নিয়ে, পূর্ণ করে দিতে তোমাদের ভুবন’। চারদিকে তীব্র শীতল বাতাস, এই শহরের তাপমাত্রা সেন্টিগ্রেড স্কেলে শূন্য ছাড়িয়ে গেছে। দাঁড়ানোর উপায় নেই, তার মাঝে নগ্ন চাঁদ যেন অপরূপ সুন্দর বা সুন্দরী প্রেমিকের মন। মনে হয় একবার ছুঁয়ে দিলেই জীবনের সব অপূর্ণতা মুছে যাবে। এ মানবজীবন শেষ হয়ে যায় কত অপূর্ণতা নিয়ে, তা হয়তো আমরা যারা বেঁচে আছি তারা এখনো জানি না। কারণ প্রতিদিন আমরা নতুন এক আশা নিয়ে জেগে উঠি।
সত্যিকার অর্থে হিসাব করলে জীবনটা খুব ছোট ও অনিশ্চিত ভ্রমণ। কিছু আশা পূর্ণ হবে, কিছু রয়ে যাবে। আমাদের অনেক অপ্রাপ্তি, সমস্যা সবকিছু একদিন মুছে যাবে, সবকিছুর সমাধান হবে, দেহের অক্ষমতা জয় হবে, আমরা ভুলে যাব, রাতে ঘুমে দেখা দুঃস্বপ্ন। ভোরের আলোর মতো এক সূর্য উঠবে, ছুটব সামনে সূর্যের আলোর দিকে। আমরা তো আশার ওপর ভরসা করেই বাঁচি, তাই ভালো কিছুর আশায় থাকতেই পারি। আজকের কোন দুঃসংবাদ আগামী বছর হয়তো আরও গভীর দুঃসংবাদ হিসেবে ধরা দিত। তাই এ ক্ষেত্রে দুঃসংবাদকেও সাধুবাদ জানাতে হয় যে, সে অল্প থাকতে দেখা দিয়েছে। উল্টো হিসাব করলে অনেক নেতিবাচকের মধ্যেও আমরা ইতিবাচক ইঙ্গিত পাব। যেখানে শূন্যতা আর নিঃসঙ্গতা ছাড়া কিছু নেই, সেখানে হঠাৎ করেই জীবন বদলে গেছে। আমাদের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি আমাদের প্রিয়জনদের নিয়ে। যখন আনন্দ ভাগ করি প্রিয়জন নিয়েই করি, যখন দুঃখে কাঁদি তাদের নিয়েই আমরা কাঁদি। সবকিছুর মূলে পরিবার-পরিজন, স্বদেশ। আমি শুধু আমি নই, আমাদের নিয়েই আমি। আমাদের নিয়েই আমাদের কমিউনিটি, আমাদের দেশ। প্রিয়জনের কেউ ভালো না থাকলে আমরাও ভালো থাকতে পারি না। নিজের দেশ ভালো না থাকলে, তাও আমাদের কষ্ট দেয়। যত বড় দেশে আমরা থাকি না কেন, আমাদের অস্তিত্বে দেশ আগে কথা বলে।
সীমাবদ্ধতা, সমস্যা পদে পদে মানুষের জীবনে। উন্নয়নশীল দেশে গরিবি আছে, আমেরিকার মতো স্বপ্নের দেশেও যে মানুষের অভাব থাকতে পারে, তা অনেকটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। মধ্যবিত্ত সব সময় মধ্যবিত্ত। এ দেশে অনেকে আছে, বড়দিনে ইচ্ছে থাকলেও মনের মতো বড় উপহার প্রিয় মানুষকে দিতে পারে না। পরিবার-পরিজনই শুধু নয়, আশপাশের সবাইকে উপহার দেওয়া তাদের যেন একটা বাধ্যগত রীতি। ছোট্ট একটা উপহার দিয়ে বলে দেন, তার এখানে ভালোবাসার পরিমাণ অনেক বেশি। বছর শেষে এখানেও পড়ে অনেক অপূর্ণতার সাধ। আটপৌরে জীবনের কানায় কানায় মানুষের মাঝে দুঃখের দীর্ঘশ্বাস। তারপরও সবাই আগামী দিনের স্বপ্ন দেখে, এ বছর হয়নি তো আগামী বছর হবে—এমন আশা নিয়ে বছর শেষ হবে। সময়ের পাতায় ঢাকা পড়ে যাবে অপ্রাপ্তির দুঃখ। নতুন দিনের সঙ্গে আমরা আবার নতুন পরিকল্পনা তৈরি করব, এটাই তো মানব জীবন।
আশা-নিরাশার দোলায় চড়ে দিন যায়, দিন আসে। বছর শেষে যদি হিসাব করতে বসি, তবে দেখা যাবে অনেক আশার মৃত্যু হয়েছে। এ বছর যা পাওয়ার কথা ছিল, তা পাইনি আবার উল্টোটাও হয়েছে। হয়তো অনেক কিছু পাওয়ার ছিল না, তবু পেয়েছি। যা যা করব বলে বছরের শুরুতে একটা রোজনামচা করেছিলাম, তা কি আর আদৌ করা হলো? অনেক কিছুই আমাদের পরিকল্পনা মাফিক হয় না। আনন্দ-বেদনার ঝড় হঠাৎ করে জীবনটাকে এলোমেলো করে দেয়। কারও হয় তো বছর শুরু হতে না হতে চলে গেছেন প্রিয় কেউ, কেউ হারিয়েছেন মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী-সন্তান, ভাইবোন—এমন কোন না কোন প্রিয়জন। তাদের কাছে খুব স্বভাবতই স্মরণীয় হয়ে থাকবে দুঃসহ বেদনাময় বছরটি। তেমনি স্মরণীয়-বরণীয় আনন্দধ্বনি নিয়েও জীবনের শুরু অনেকের। কারও নতুন ঘরে নতুন মানুষ ঘর বেঁধেছে স্বপ্ন নিয়ে। কারওবা নবজাতকের উচ্ছলতায়, কান্নার শব্দেও আনন্দ বয়ে চলে। কারও একটা ভালো চাকরি বদলে দিয়েছে জীবনের অর্থ। যার কাছে সোনার হরিণের মতো কিছুই ধরা দেয়নি, সে আবার নতুন বছর নতুন করে কিছু স্বপ্ন বুনবে। আমরা মানুষ, আমাদের সহজে হার মানলে তো চলবে না। আমরা চেষ্টা করব, এ বছর হয়নি তো কি হয়েছে? আগামী বছর হবে।
সুন্দর নীল আকাশও ঢেকে যায় মেঘে। যে সূর্যের আলো পড়ে ঝলসে উঠে পৃথিবী, সে আলোও বাঁধার সম্মুখীন হয় মেঘ নামের দুঃখের সংঘর্ষে। ঘূর্ণিঝড়, তুষার ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়, বিধ্বস্ত মৌসুমের পর বসন্ত মৌসুমি রূপে নিজেকে বদলায়, ফুলে ফলে ভরে তোলে আঙিনা। আমরাও ঠিক তেমন আঘাত দুঃখ-দুর্দশার পর জেগে উঠতে পারি, জেগে উঠি। আমাদের শুধু প্রয়োজন একটু মনোবল আর দৃঢ় বিশ্বাস—আমি পারব, আমাকে পারতে হবে। আমরাও সেজে উঠি ও উঠব কোন দুঃখ-ব্যথা-বেদনা পারবে না আমাদের পরাজিত করতে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, সে পারে মুছে দিতে জীবনের ঝড়গুলোকে, গাছের নতুন পাতার মতো রোগ শোক দুঃখগুলোকে ঝেড়ে ফেলে পারে নবজন্ম নিতে।
পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্ব এখন আমাদের হাতের মুঠোয়, বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে সভ্যতাকে আরও সভ্য করতে। রোগ-শোক পরাজিত করতে সদাই চলছে নতুন গবেষণা। যে চাঁদের আলোয় আমাদের দুঃখ ভুলে যাই, সেও যে তেমন কিছু নয়, তাও আমরা জানি। তবুও আমরা মুগ্ধ হই এই চাঁদের মায়াবী আলোয়। কিছুক্ষণ আমাদের মনকে শান্ত করে তোলে ভালোবাসা, ভালোলাগায় ভরিয়ে দেয়। তেমন অনেক প্রিয় মুহূর্তও অপ্রিয় হয়ে ওঠে, জীবনের মানে বদলে যায়। সব বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও বদলাব, আমরাও দুঃখ জয় করব। কিছু না থাক, আমাদের আছে আলাদিনের এক আশ্চর্য প্রদীপ, তার নাম আশা। সেই আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখব, কোন ঝড় যাতে একে নিভিয়ে দিতে না পারে। সব বাধা অতিক্রম করে আমি, আমার দেশ—সবাই বেঁচে থাকব আশার প্রদীপ জ্বেলে। বছর শেষে এটাই বলতে চাই পুরোনো জড়তা, রোগশোকের গ্লানি, অসফলতা—সব ভুলে আমরা আবার বাঁচার মতো বাঁচব। ভালো না থাকার মাঝেও ভালো থাকব। আশার আলো খুঁজে দেখে নিতে হবে অন্ধকার পথ।