সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা নিয়ে আলোচনা

‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’এর নিয়মিত মাসিক ৯৭তম আসরে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়
‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’এর নিয়মিত মাসিক ৯৭তম আসরে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়

মহান বিজয় দিবসের প্রতি যথাযথ সম্মান জানিয়ে ‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক’এর নিয়মিত মাসিক ৯৭ তম এবং বছরের শেষ আসরটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ২৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। আসরে সদ্য পরলোকগত কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।
এবারের আসরে আলোচনায় অংশ নেন হাসান ফেরদৌস, ফেরদৌস সাজেদীন, তমিজ উদদীন লোদী, হোসাইন কবির, কাজী আতীক, সোনিয়া কাদের প্রমুখ।
হাসান ফেরদৌস বলেন, শিল্প তৈরি হয় আড়াল থেকে। লুকিয়ে থাকার মধ্যেই শিল্প থাকে। আজকের আসরে যাদের স্বরচিত কবিতা শুনেছি, তাদের বেশির ভাগ কবিতায় তেমন আড়াল খুঁজে পাইনি।
মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের কথা বলতে গিয়ে তিনি দু’দুটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, এভাবে নারীদের একাত্তরে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে দেশের স্বাধীনতার জন্য। একাত্তর আসলে এতটা ব্যাপক যা আমাদের সাহিত্যে এখনো বিশদভাবে আসেনি।
ফেরদৌস সাজেদীন আবেগঘন হয়ে বলেন, মধ্য সত্তরে যুক্তরাষ্ট্রে এসে বাংলা কবিতা, নাটক, গান, সাহিত্য এসব কিছুই দেখিনি। অথচ এখন বাংলা গান, কবিতা, নাচ, নাটক, সাহিত্য এ দেশের সর্বত্র যখন দেখতে পাই তখন মনে হয় বিজয় দেখছি! কোনো বিশেষ মিলনায়তনে অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে শেষ আসনটাও যখন দখল হয়ে যেতে দেখি তখন মনে হয় বাংলাদেশের বিজয় দেখি! প্রতি মাসের শেষ শুক্রবার সাহিত্য একাডেমিতে এসেও সে একই বিজয় দেখি!
নির্ধারিত বিষয় ‘বাংলা সাহিত্যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’র ওপর আলোচনা করতে গিয়ে তমিজ উদদীন লোদী বলেন, বিশ্বের সব যুদ্ধ নিয়েই সাহিত্য রচিত হয়েছে। যুদ্ধ মানুষকে কীভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত করে তার আনুপর্বিক বর্ণনায় তিনি এরিখ মারিয়া রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এর প্রসঙ্গ টানেন। সেখানে তিনি জার্মান সৈন্যটির চরম মানসিক ও শারীরিক বৈকল্যের কথা তুলে ধরেন। তিনি লিও টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ ও ‘ফর হুম দ্য বেল টুলস’ এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন এসবেই নানাভাবে যুদ্ধের নারকীয় ও বীভৎস ঘটনা বিধৃত হয়েছে । এমনকি নানা পুরানে যুদ্ধের কথা এসেছে, তিনি ইলিয়াড ও অডিসি, মহাভারত, রামায়ণে বর্ণিত যুদ্ধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন কালে কালে যুদ্ধের কথা, তার বীভৎসতার কথা নানা সাহিত্যে এসেছে। বাংলা সাহিত্যেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিস্তর লেখা হয়েছে। গদ্য, গল্প, উপন্যাস সাহিত্যের সব শাখায় কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। তিনি বিভিন্ন লেখকের গল্প ও উপন্যাসের উদাহরণ টেনে বলেন এগুলোয় নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধ প্রতিফলিত হয়েছে। কবিতায় পল্লিকবি জসিম উদ্‌দীন থেকে শুরু করে প্রায় সব কবির কবিতায় কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা এসেছে। বাংলাদেশ যত দিন বেঁচে থাকবে তত দিন সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের কথা আসবেই। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এটি বিস্তৃত হতে থাকবে।
হোসাইন কবির বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুধু কতিপয় মানুষের নয়। যে মা রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছিলেন তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। কবি ও লেখকদের সাহিত্যকর্মে এই গণমানুষের কথা বলতে হবে। কালোকে কালো, সাদাকে সাদা বলা উচিত। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে চট্টগ্রাম শহরকে বলা হয় কবিতার শহর। তদ্রূপ নিউইয়র্ক শহরে যেভাবে বাংলা সাহিত্যের চর্চা হচ্ছে এই শহরটাকেও বাংলার কবিতার শহর বলা যেতে পারে! আমি প্রায় প্রায় নিউইয়র্ক শহরে আসি। আজ নিবিড় ভাবে সবার পড়া শুনেছি। আগের থেকে কবি, লেখকদের লেখায় অনেক উন্নতি হয়েছে বলে মনে করি।’
কাজী আতীক সবাইকে বিজয়ের মাসের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের বিজয় একদিনে আসেনি। ১৯৭১ সালের আগে ১৯৪৮ সাল থেকে বিভিন্ন আন্দোলনে যাঁদের আত্মত্যাগ ছিল তাঁদের সকলকে তিনি সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস হারিয়ে যেতে বসেছিল। এখন আবার তা সঠিক ধারায় ফিরে এসেছে।
সোনিয়া কাদের বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন ভয়াবহ স্মৃতির কথা মনে উঠলে এখনো গা শিউরে ওঠে। আমি তখন চৌদ্দ বছরের কিশোরী ছিলাম। রাজাকার, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়ে অনেক সময় মা আমাকে পুকুরে কচুরিপানা দিয়ে ডুবিয়ে রাখতেন।
ইউ, এস বাংলা পত্রিকার সম্পাদক আবু সাঈদ রতন বলেন, সাহিত্য একাডেমির ৯৭ তম আসরে কবিতা শুনে সবাইকে আগের থেকেও বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ যাঁরা দেখেছেন তাঁদের লেখায় ঘটনাগুলো ফিরে আসুক। সত্যকে সত্য হিসেবে সবার তুলে ধরা উচিত।
এবিএম সালেহ উদ্দীন সবাইকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের সকলের আগামী দিনগুলো যেন আরও সুন্দর ও চমৎকার হয়।’
এ ছাড়া বিপা’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এ্যানি ফেরদৌস, ছড়াকার শামস চৌধুরী রুশো, মো. আলী বাবুল সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানান।
এবারের আসরে যাঁরা কবিতা, ছড়া পড়েছেন তাঁরা হলেন: শামস আল মমীন, মনজুর কাদের, লুৎফা শাহানা, তাহমিনা সাঈদ, উইলি মুক্তি, বেনজির শিকদার, ইশতিয়াক রুপু, আহম্মেদ হোসেন বাবু, জেবুন্নেসা জ্যোৎস্না, সুরীত বড়ুয়া, স্বপ্ন কুমার, শাম্মী আক্তার হ্যাপি, মাসুম আহম্মেদ, রিমি রুম্মান, আব্দুস শহীদ, সৈয়দ আহম্মেদ জুয়েদ, কামরুন নাহার রীতা, আবুল বাশার, মিশুক সেলিম, ছোট্ট বন্ধু তামান্না আহম্মেদ শান্তি, পলি শাহীনা প্রমুখ।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্মরণে আসরে তাঁর কবিতা পাঠ করে শোনান ফেরদৌস সাজেদীন, রানু ফেরদৌস ও মনিজা রহমান।
এ ছাড়া এবারের আসরে আরও যাঁরা আবৃত্তি করেন তাঁরা হলেন, পারভীন সুলতানা, লুবনা কাইজার, গোলাম মোস্তফা, শুক্লা রায়, তাহরিনা পারভীন প্রীতি, সেলিম ইব্রাহীম।
আসরে আরও উপস্থিত ছিলেন বাফার ফরিদা ইয়াসমিন, পপি কুলসুম, রাহাত কাজী শিউলি, আহমদ মাযহার, খালেদ সরফুদ্দীন, শামসাদ হুসাম, পারভীন হোসেন, নাসরিন চৌধুরী, মেরিনা রহমান, জাকির মিয়া, কানু দত্ত, শাহ জালাল চৌধুরী, সানি আলম, রাব্বানী, মো. মনিরুল ইসলাম, আল মাসুন জীবন, জাফর ফেরদৌস, জসিম সরকার, এম কে আলম, শেখ সোহেব সাজ্জাদ, নাসির শিকদার প্রমুখ।
উপস্থিত সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও খ্রিষ্টীয় নতুন বছরের আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে আসরের সমাপ্তি টানেন পরিচালক মোশাররফ হোসেন।