স্বপ্ন দেখাব বলে...

স্নেহজিৎ লাহিড়ীর গল্পের শুরুটা ছিল এমন—যখন স্বপ্ন দেখলে ঝাপসা হবে চশমার কাচ, তখনই বুঝবে তুমি স্বপ্নের বাস্তব হওয়ার অতি নিকটে। স্বপ্নের এতটা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমি আগে পাইনি বলেই হয়তো ওপরের কথাগুলো আমার পক্ষে বোঝা কষ্টকর। তবে, আমার ভাবনা খোলে নিউইয়র্কের পাতাল রেলের অভ্যন্তরে। অনেক গল্পের প্লট কিংবা গানের শুরু কাজে যাওয়ার পথে পাতাল রেলের ছন্দময় দোলার মধ্যে থাকতে থাকতে পেয়ে গেছি। অথচ এখন যে গল্প বলব, তার উৎস ভাটির দেশের এক সুকন্যা সুরমার উত্তর পাড়ে। কেমনে সামলাই সেই গল্প বলার লোভ।
২০১৪ সালে যখন দেশে গিয়েছিলাম দুজন সুহৃদ বললেন, ভাই চলেন, আমরা এক জায়গায় যাচ্ছি। আপনিও সঙ্গে চলুন, আপনার ভালো লাগবে আশা করি। জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায়? উত্তরে ভাইয়েরা জানালেন, নদীর অপর পারের এক শিক্ষালয়ে। ভাবলাম শিক্ষালয় যখন নিশ্চয় শিক্ষণীয় কোন বিষয় পেতে পারি। রাজি হয়ে গেলাম কোনো অজুহাত না দেখিয়ে।
দিনক্ষণ ঠিক করে একদিন তরুণদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। ওদের সঙ্গে আলাপচারিতার শুরুতে টের পেলাম, সাধ্য মত সময়, সুযোগ ও নিজস্ব শ্রম দিয়ে ভালো কিছু করার দারুণ আগ্রহ আছে ওদের। নিজেরা পুরোপুরি সচ্ছল নয়, তবে স্বপ্নচারী। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। চিন্তা–চেতনায় রয়েছে নানা ভালো ভালো বিষয়। পাড়ার উপাসনালয়ের সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে গরিব মেধাবীদের বিদেশে পড়ালেখার সুযোগ করে দিতে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত তারা।
নির্দিষ্ট দিনে যাত্রার শুরুতে নদী পারাপারে সাক্ষাৎ হলো প্রতিভাবান এক অন্ধ গায়কের সঙ্গে। দোতারা হাতে দেহতত্ত্বের গানের সঙ্গে আবেগের ভীষণ মাখামাখি, যা আমাকে অন্য এক জগতে নিয়ে গেল। মনে ধরেছিল সেই গায়কের কথা। তবে চলতি পথে দেখা সেই প্রতিভাবানের জন্য কিছুই করতে না পারার আফসোস নিয়ে আজও চলছি নিরন্তর। নদী পেরোনোর পর আধুনিক ব্যবস্থার সঙ্গে সাক্ষাৎ। গতিময় দ্বিচক্রযান, মানে ঝকঝকে নতুন মোটর সাইকেল—দুই আসন বিশিষ্ট যানে চালক ও যাত্রীর একসঙ্গে চলার ব্যবস্থা। অসমতল বেমক্কা ঝাঁকুনির সঙ্গে ছুটে চলছি গন্তব্যের দিকে। দুজনের একজন আবার আলোকচিত্রী। সবুজ ফসল, খালের সাইজে চিলতে নদী, চকচকে ঢেউটিনের বাড়ি কিছুই বাদ পড়ছে না। শুধু ক্লিক, ক্লিক আর ক্লিক। যেতে যেতে এক চৌরাস্তায় থামলাম। ৩০ বছর আগে এই চৌরাস্তায় এক গ্রীষ্মে ক্লান্ত পথিক হয়ে খড়ের ছাউনি দেওয়া ছোট ঘরে পান করেছিলাম শীতল পানি। পরে ছোট ছোট কাচের গ্লাসে গ্লুকোজ বিস্কুট দিয়ে গুড়ের চা। পাশেই গ্রামবাসীদের তাসের জটলা। কেউবা গাছতলায় দশ পঁচিশের চৌকোনা কাপড়ের বোর্ড বসিয়ে খেলছে আর হাতের মুঠোতে চৌকোনা নানা সংখ্যা আঁকা দান ছেড়ে দিতে দিতে হাঁক দিয়ে বলছে, আইলো রে, আইলো রে! ফঁচিশ আইলো রে! এবার এসব কিছুই চোখে পড়ল না। সারি সারি দোকান, কোনটি মোবাইলের, কোনটি আবার এনজিওদের শাখা অফিস। চারদিক অনেক ফাঁকা ফাঁকা।
নানা বয়সী আড্ডায় মেতে থাকা লোকজন কোথায়? সঙ্গী একজন বললেন, ভাই এখন আর কাউকে এভাবে পাবেন না। সবাই আজকাল বড্ড ব্যস্ত। হঠাৎ চোখে পড়ল, খাজা বাবা ইঞ্জিনিয়ারিং শপ। ইঞ্জিনিয়ারিং শপ? যে বাজারে সাইকেল সারানোর দোকান ছিল না সেই বাজারে ইঞ্জিনিয়ারিং শপ?
চালককে বললাম, থামো ভাই। বিষয়টি একটু বুঝতে দাও। হেঁটে গিয়ে দেখতে পেলাম, নানা জাতের পাওয়ার টিলার মেশিনের লোহার চাকা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে।
পাশে ধান মাড়াইয়ের কয়েকটি মেশিন সারিবদ্ধ করে রাখা। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, মালিকের বাড়ি চট্টগ্রামে। আলাপচারিতায় জানালেন, ব্যবসা ভালোই চলছে এখানে। বেশির ভাগ স্থানীয় কৃষকেরা কৃষি যন্ত্রপাতি নিয়ে আসেন সারাই করাতে, নয়তো সার্ভিসিংয়ের জন্য। আনমনা হয়ে মনে মনে ভাবছি, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল কারিগর তা হলে এই কৃষক কুল, মানে কৃষক সমাজ। আর সঙ্গে যোগ হয়েছে এসব স্বপ্নবাজ মানুষ। বাহ, বেশতো! সব শুনে আর দেখে মন খুশিতে ভরে গেল। সঙ্গীর ডাকে বাস্তবে ফিরে এলাম। বলছে, ভাই এসে গেছি, নেমে যান। সুন্দর সবুজ পরিবেশ চারদিকে। সারি সারি ইউক্যালিপটাসের গাছে ভরা কলেজ প্রাঙ্গণ। সবগুলো ছায়া দেয় গাছ। কলেজ কর্তৃপক্ষের সবিনয় আন্তরিক সম্ভাষণে আনন্দ পেলাম।
সঙ্গের দুই তরুণের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী পরিকল্পনা তোমাদের? মনে হলো, কোন বড় বিপদের মুখে পড়ছি! উত্তরে বললেন, অসুবিধা নাই, আমরা আছি। ঘাবড়াবেন না। প্রথমে পরিচয় হলো দারুণ মিশুক মেধাবী একজন তরুণ প্রভাষকের সঙ্গে। পরিচয় দিলেন, চিনে নিলাম, অনুমান সত্য। শিক্ষার পরিবেশের ছোঁয়া পাওয়া মাটির সন্তান। নাম প্রভাষক মসিউর রহমান। ভীষণ আমুদে ও আলাপচারিতার মানুষ। এরপর একে একে এলেন কলেজের অধ্যক্ষসহ অন্যান্য শিক্ষক। কিছুক্ষণ পর অধ্যক্ষের সঙ্গে গেলাম বিরাট একটি হলরুমে। আনুমানিক ৪০০ ছাত্র–ছাত্রী। একপাশে ছেলেরা, অন্যপাশে মেয়েরা সারিবদ্ধভাবে বসা। পেছনে ব্যানারে আধুনিক শিক্ষার ওপর দিক নির্দেশনামূলক কিছু একটা লেখা। এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না।
ছাত্রছাত্রীদের দিকে মুখ করে বসা এই প্রথম। সঙ্গের এক তরুণ শুরু করলেন শুভেচ্ছা বক্তব্য দিয়ে। অনেক কিছুই বললেন। ভাবছি, যদি আমাকে কিছু বলতে বলে তাহলে কী বলব! তখনই শুনলাম তরুণ বলছেন, আমেরিকাপ্রবাসী অমুক ভাইজান, আপনাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন। আমি তরুণের দিকে তাকিয়ে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তাকালাম সামনের দিকে। উচ্চ মাধ্যমিক ও বিএ ক্লাসে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। সবাই বসে আছে চোখে মুখে অনেক আগ্রহ নিয়ে। চোখ দুটোতে হাজারো জিজ্ঞাসা। কী বলব ওদের? কী-ই-বা শোনাব? রক্ষা হলো নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নির্ধারিত ছিল না। তা না হলে হয়তো বেকায়দায় পড়ে যেতাম।
সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজে কিইবা এমন জানি যে, ওই আগ্রহী তরুণ-তরুণীরা আমার কাছ থেকে জেনে নেবে। আবার তাকালাম ওদের দিকে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, বুদ্ধিমান বক্তা প্রথমে শ্রোতাদের পরিমাপ করে তারপর বিষয় নির্ধারণ করেন।
আমার লাগোয়া ডানদিকের সারিতে কয়েকজন যুবক। তাদের দেখেই মনে হল, জানার আগ্রহ ওদের খুব বেশি। বাম দিকে প্রথম সারিতে ৭/৮ জন তরুণী। তাদের মধ্যে একজন পুরো হিজাব পরা। তবে খোলা চোখ দুটোতে দেখলাম বুদ্ধিমত্তার ছাপ। দুজনের পরই কপালে চিলতে সিঁদুর দেওয়া একজন শ্যামাঙ্গিনী। দেখেই মনে হল, জানার চ্যালেঞ্জ নিয়েই আজ সে আমার মুখোমুখি বসে আছে। পরক্ষণেই ভাবলাম, ওদের সামনাসামনি না হয়ে তাদের মধ্যে চলে গেলে কেমন হয়। তাই করলাম। মাইক্রোফোন হাতে চলে গেলাম ওদের মাঝখানে। কী বলব? স্বীকার করি, আমি পাঁচ–দশজনের মধ্যে ভালো গল্প বলিয়ে হতে পারি। তাই বলে ৪০০ ছাত্র-ছাত্রীর সামনে গল্প বা কিছু একটা বলার ক্ষমতা আমার নেই।
পরক্ষণেই ত্বরিত একটি বিষয় মনে এল। ভীষণ একটি হৃদয়ছোঁয়া বিষয়। স্বপ্ন, ঠিক মতো যদি বিষয়টি নিয়ে কিছু বলা যায় তাহলে হয়তো বাজিমাত হতে পারে! প্রথমে গুছিয়ে নিয়ে তারপর ধীরে ধীরে, কখনো উদাত্ত আহ্বানে, কখনো নিজের জীবনের পাওয়া না–পাওয়ার ছবি সাজিয়ে বলতে শুরু করলাম। কোন সময় বলা থামিয়ে তরুণ-তরুণীদের নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি। কেউ উত্তরে জীবন অভিজ্ঞতার কথা বলে, কেউ বা এড়িয়ে যায়। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমার থেমে থেমে বলা, স্বপ্নমাখা কবিতা শুনছে আর স্বপ্ন দেখছে। কেউবা আবার স্বপ্নের অদেখা রথে চড়ে স্বপ্নালোকে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। মূলত সহজ ভাষায় যা বলেছি তা হলো, একমাত্র শিক্ষা আর জ্ঞানই তোমাদের সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। তা-ই হবে স্বপ্ন সফল করার চাবিকাঠি।
শেষ পর্যন্ত দেখি, আমি বেশ ভালোই উতরে গেছি। আয়োজকেরা খুশি, তেমনি আমার কাঁধে বিষয়টি চাপিয়ে দেওয়ার মূল পরিকল্পনাকারী দুই সহচর। স্বপ্নের এই কথামালার যখন ইতি টানলাম, পুরো হলভর্তি ছাত্রছাত্রীদের বিরামহীন করতালি। মাইক্রোফোন রাখতে গিয়ে চোখে পড়ল সেই হিজাব পরা তরুণীকে। কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কোন স্বপ্ন আছে? উত্তর এল, মানুষের জন্য নিজেকে তৈরি করার স্বপ্ন। কপালে চিলতে সিঁদুর দেওয়া তরুণীর দিকে তাকাতে সে বলল, ইচ্ছা আছে একদিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করার। কয়েক সেকেন্ড নির্বাক হয়ে ভীষণ মায়াবী চেহারার শ্যামাঙ্গিনীর দিকে অপলক নেত্রে চেয়ে রইলাম। তা হলে ওরা স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছে! বাইরে এসে দাঁড়াতেই শুরু হলো ফটোসেশন। তা শেষ করে বিদায় নেব। তখনই এক শিক্ষক পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ওরা আপনাকে সমস্বরে কিছু বলতে চায়। বললাম ঠিক আছে, শুনে যাই। ওরা কী বলে। তখনই সবদিক ছাপিয়ে বিরাট একটি আওয়াজ।
সালাম স্যার, আমরা স্বপ্ন দেখব। অন্যদেরও স্বপ্ন দেখাব। চোখের কোণ ভিজে উঠল। ভাবলাম, আমি কি এর যোগ্য? ঝাপসা হলো চশমার কাচ। চোখ মুছে ফিরতে যাব, শুনলাম সুমধুর নারীকণ্ঠ, ‘আদাব স্যার, দেখা হবে কোনোদিন স্ট্যাচু অব লিবার্টির পাদদেশে নোনাজলের হাওয়ায় ভেসে বেড়াবার কালে। চেয়ে দেখলাম কপালে চিলতে সিঁদুরের রং আরও লাল, আরও জ্বলজ্বলে।