ভিনদেশে কর্মজীবী বাঙালি বধূ

মায়ের সঙ্গে শুক্লা রায়
মায়ের সঙ্গে শুক্লা রায়

বিদেশে কর্মজীবী বাঙালি নারীর দ্বৈত ভূমিকা কেবল চাকরি আর ঘরকন্না নিয়ে নয়। যদিও তার সময়ের প্রায় পুরোটাই মূলত এই দুই বিপরীতমুখী জগতেই কাটে। চাকরি আর ঘরকন্না ছাড়াও তার জীবনে রয়েছে আরও বহু রকমের টানাপোড়েন। প্রতি মুহূর্তে তাকে যেসব জটিলতা ও দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে হয়, তার মূলে রয়েছে পরস্পরবিরোধী কতগুলো বিষয় বা শক্তি, যেমন-প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, ঘর-বাইরে, স্বামী-সন্তান, বাংলা ভাষা-বিদেশি ভাষা, ভাত-মাছ-হ্যামবার্গার, ফ্রেঞ্চফ্রাই ইত্যাদি। এসব সংঘাতের কারণ কখনো আর্থসামাজিক, কখনো মনজাগতিক। কখনো বাহ্যিক, কখনো অন্তর্গত। কখনো বা কেবলই একাকিত্ব বা নিভৃতির সংকট।
কর্মজীবী বিবাহিত নারীর চিরন্তন সমস্যার কথা বহুকাল ধরেই বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়ে আসছে প্রাচ্য, পাশ্চাত্যের সর্বত্র। এ সংকট সবারই জানা। বাঙালি নারীর জন্য এই সমস্যার রকম আরেকটু ভিন্ন এবং তার তীব্রতা আরও বেশি প্রকট। কারণ, বাঙালির পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক আবহাওয়া নারীর ওপর আলাদা কতগুলো দায়িত্ব ও প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে দেয়, যা অন্য সংস্কৃতি বা অন্য দেশে বিশেষ করে পাশ্চাত্যে এতটা প্রবল নয়। এর ওপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো চেপে বসে প্রবাসজীবন। প্রবাসী বাঙালি চাকরিজীবী গৃহিণীর সমস্যার অন্ত নেই।
প্রবাসজীবনে এ ধরনের সমস্যার অন্যতম কারণ হলো—এ দেশে অধিকাংশ বাঙালি পরিবারই প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী। প্রায় সবাই বিদেশে এসেছেন ভাগ্যান্বেষণে, অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনের প্রত্যাশায়। প্রবাসী জীবনের মৌলিক কতগুলো সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা দেশে বসে ভোগ করতে পারলে প্রায় কেউ–ই এদেশে থেকে যেতেন না। ফলে বিদেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে স্থায়ীভাবে বসবাস, কর্মজীবনে সারা দিন পশ্চিমাদের সঙ্গে ওঠাবসা করলেও বাঙালির পারিবারিক জীবন বিশেষ করে দাম্পত্য জীবন যেন আজও ঠিক স্বদেশের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। অথচ দেশের মতো ঘরের কাজের জন্য কোনো সাহায্য সহযোগিতা এখানে একান্তই দুর্লভ।
কর্মজীবী নারীর জীবনের চেহারা অনেকখানি পাল্টে দিতে পারে একজন গৃহকর্মী। দিন শেষে কর্মক্লান্ত দেহটাকে ঘরে টেনে আনার পর এক কাপ তৈরি গরম চায়ের পরিবেশনা কতটা উদ্দীপক, যারা দেশে–বিদেশে দুজায়গাতেই কাজ করেছেন, তারা ভালোভাবেই তা বুঝতে পারবেন। গৃহকর্মী ছাড়াও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু–বান্ধবের অভাব এই প্রবাসের সংগ্রামী জীবনকে করে তোলে আরও কঠিন, একঘেয়ে ও আনন্দহীন। ইচ্ছে হলেই দুই দিন মা, বোন বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে আরাম করে আসা যায়, এ সম্ভাবনাও অনেক মানসিক ও শারীরিক শ্রান্তি দূর করে দেয়। কখনো কখনো প্রকৃত অর্থে সেটা দূরও হয় স্বদেশে, যা এখানে প্রায় অসম্ভব। ইচ্ছে হলে দুপদাপ করে কোনো বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দরজায় টোকা দেওয়ার রেওয়াজ নেই এখানে। সেটা দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা এবং মূল্যবোধের পার্থক্য—এই দুই কারণেই হয়ে থাকে।
অধিকাংশ বাঙালি স্বামী প্রবাসে চারদিক দেখে–শুনে–বুঝেও বাইরের জগৎকে বাইরে ফেলে রেখে ঘরে ঢুকে আবহমান বাঙালি জীবন ও সংসারের প্রত্যাশা করেন। অর্থাৎ দুজনেই একই সঙ্গে সারাদিন বাইরে কাজ করে এলেও ঘরে এসে স্ত্রীকেই গার্হস্থ্য কর্মকাণ্ডের সিংহভাগ দায়িত্ব বহন করতে হয়। উপার্জন করে যে স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করে নারী, প্রাত্যহিক জীবনের হাড়ভাঙা খাটুনি ও অতি ব্যস্ততার কারণে তার আস্বাদ পুরোপুরি নিতে সমর্থ হয় না সে। তার ওপর আজকাল বড় বড় শহরে ইলিশ, শোল শুধু নয়, কচুর লতি, এচোঁর থেকে শুরু করে মোচা, পটল, সাতকড়া—সবই যখন পাওয়া যায়,

বেড়ানোর জন্য একটু সময়
বেড়ানোর জন্য একটু সময়

তাহলে সারা দিন খাটুনির পরে একটু ভালো–মন্দ রসিয়ে রসিয়ে খেতে দোষ কি? দোষ শুধু এখানেই যে মুখরোচক, পরিচিত ও কাঙ্ক্ষিত সে সব খাবার আস্বাদনের সবটাই করতে হয় ঘরের কর্ত্রীকেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বড় জোর বাজারটা এনে দিতে পারেন গৃহস্বামী। সব সময় আবার সেটাও হয় না। যেহেতু বাজার করার পয়সা আছে গৃহিণীর হাতে, গাড়ি চালাতেও জানে সে, তাহলে দেখে শুনে বাজারটাও করে আসলে ক্ষতি কি! বিশেষ করে ওই পথেই তাকে যখন ছেলেকে পিয়ানো শিক্ষা শেষে নিয়ে আসতে হয়।
সন্তানদের যারা এ দেশে জন্মেছে বা বড় হয়েছে, তাদের খাদ্যের রুচি ও চাহিদা বাবা–মায়ের থেকে আলাদা বলে সপ্তাহে অন্তত দু–তিন দিন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের—দুই ধারার রান্নার ব্যবস্থা করতে হয় গৃহকর্ত্রীকে। খাবার–দাবার তৈরি ও পরিবেশন ছাড়াও ঘরে প্রায় সারাক্ষণই চলে স্বামী ও সন্তানদের বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সমঝোতা বিধান ও তাদের ভিন্ন ভিন্ন আকাঙ্ক্ষা মেটানোর প্রাণপণ চেষ্টা। স্বামী চায় আধুনিক বাংলা গান শুনতে অথবা মাধুরী দীক্ষিত বা ঐশ্বরিয়ার সিনেমা দেখতে। সন্তান চায় লর্ড অফ দ্য রিংস দেখতে অথবা ব্রিটনি স্পিয়ার্সের গান শুনতে। বাড়ি বড় হলে প্রত্যেকের আলাদা ঘর ও যন্ত্রপাতি থাকলে তেমন সমস্যা হয় না, তা না হলে সংঘাত অনিবার্য। এ ছাড়া সপ্তাহান্তে সন্তানদের লিটল লীগ বেসবল অথবা ব্যান্ডের নাচের স্কুলে নিয়ে যাওয়া অথবা জন্মদিনের পার্টি আয়োজন কিংবা সন্তানদের বন্ধুদের জন্মদিনে উপহার কেনা, তার বাঁধাছাঁদা করা—সবই মায়ের দায়িত্ব। যদিও অনেকে বলবেন, এসবই ছোটখাটো ব্যাপার। গৃহকর্তার মূল্যবান সময় অপচয় করার জন্য এসব কাজ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়।
প্রবাসী কর্মজীবী নারী সন্তান ধারণ, সন্তান প্রসব, সন্তান লালনপালনের মতো জীবনের মৌলিক অথচ গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো পার করেন নিকট আত্মীয়স্বজনের অনুপস্থিতিতে, ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর উষ্ণ সান্নিধ্য ছাড়া। ঘরের সাহায্য কর্মীর সহযোগিতা ছাড়া কর্মজীবী নারীর পক্ষে এসব মানবিক ও জৈবিক দায়িত্ব পালন করা শুধু শারীরিক ধকল সহ্য করার ব্যাপার নয়, মাঝে মাঝে গভীর মানসিক পীড়ারও কারণ হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অবুঝ দুগ্ধপোষ্য শিশুকে বেবি সিটার বা ডে কেয়ারে রেখে যখন মাকে কাজে যেতে হয়, তখন মায়ের মধ্যে যে প্রচণ্ড অপরাধবোধের সৃষ্টি হয়, কাজ শেষে ঘরে ফিরে এসে সারারাত ধরে শিশুর অনিদ্র-সেবা করলেও তা লাঘব হয় না। প্রবাসী চাকরিজীবী নারী জীবন ধারণ করতে গিয়ে তাই হিমশিম খায়। ভেবে পায় না, সন্তান সামলাবে না চাকরি সামলাবে। অতটা নিপুণভাবে না পারলেও অবশেষে জীবন ও জগতের প্রয়োজনে দুটোই সামলায় সে। কিন্তু দিন শেষে তাঁর নিজের জীবন বলে কিছু থাকে না। কোনো বিনোদন, ভালো লাগার বিষয়, দূরপাল্লায় কোথাও বেড়াতে যাওয়া, সিনেমা-নাটক-কনসার্ট-খেলা দেখে নিজেকে সপ্তাহান্তে চাঙা করা তার হয়ে ওঠে না। এভাবেই চলতে থাকে জীবন।