নবজাতকের জন্ম ও বাবার দায়িত্ব

সন্তান তুতুনকে নিয়ে মডেল হয়েছেন টেক্সাসে বসবাসরত জয় রহমান
সন্তান তুতুনকে নিয়ে মডেল হয়েছেন টেক্সাসে বসবাসরত জয় রহমান

‘শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা-
শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধ-ভরা,
বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়,
আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিয়ো।’
বাংলা সিনেমা, নাটক, গল্প-উপন্যাসে ‘এই তুই বাবা হয়েছিস’ বা ‘এই তোর ছেলে হয়েছে’—টাইপের যে এক-দুই মিনিটের সিকোয়েন্সের সঙ্গে আমরা পরিচিত, বাস্তবে বাবা হওয়া মোটেই সে রকম নয়। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তিন মাস আগে আমাদের প্রথম সন্তান আমাদের কন্যা আমিরা জন্ম নিয়েছে নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে। এ এক অনির্বচনীয় অনুভূতি, এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। এক হিসেবে যে রাতে সে ভূমিষ্ঠ হলো, সেই তারিখে আমি বাবা হয়েছি। কিন্তু আসল পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব শুরু হয় তার অনেক আগে; যখন ভ্রূণের জন্ম হয়। তখন আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বাইরেও দায়িত্ব ও নিয়মানুবর্তিতা শুরু হয়। সেই ভ্রূণের যত্নের প্রতিও বাবাকে খেয়াল রাখতে হয়। ভ্রূণের যত্ন অর্থাৎ সন্তানের মায়ের যত্ন নেওয়া, তাকে শারীরিক ও মানসিক সহায়তা দেওয়া।
ইংরেজিতে একটা মজার কথা আছে, Children are emotionally priceless but financially worthless. অর্থাৎ, আবেগের দিক থেকে সন্তানরা অমূল্য কিন্তু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একেবারে মূল্যহীন। এটা কৌতুক করে বলা কথা। কিন্তু নিজের সন্তানের জন্য পরিশ্রম করে এবং অর্থ ব্যয় করার পর কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছি আমাদের বাবা-মায়ের আত্মত্যাগ, দিবস–রজনী জেগে থাকা, সন্তানের জন্য তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আমি কাছের অনেককে বলেছি, এই তিন মাসে বাবা হিসেবে আমি সন্তানকে যে সেবা করেছি, তার অর্ধেকও যদি নিজের বাবা-মাকে করতাম, এত দিনে আমার নামে স্বর্গ নিশ্চিত হয়ে যেতো। এসব কারণে আমি মনে করি, বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা খুব কাছ থেকে নেওয়া প্রতিটি পুরুষের জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা।
বাবা হওয়ার পর পৃথিবীর তাবৎ নারীর প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পাল্টে গেছে, শ্রদ্ধাবোধ এক সম্পূর্ণ ভিন্ন স্তরে চলে গেছে, অনন্য মাত্রা পেয়েছে। আমরা গানে কবিতায় মায়ের কথা শুনে বা পড়ে কেঁদে বুক ভাসিয়েছি অনেকবার। কিন্তু, বাবা হওয়ার ফলে একজন মায়ের যে আত্মত্যাগ দেখেছি, তার উপলব্ধির গভীরতা নিয়ে পেছন ফিরে তাকালে মা-জাতির প্রতি পূর্বের সব আবেগকেও হাস্যকর লাগে, ভান বলে মনে হয়।
প্রথম যখন একটি শিশু জন্ম নেয়, তার পাশাপাশি আরও দুটি শিশু জন্ম লাভ করে। বাকি দুটি শিশুর একজন মা এবং অন্যজন বাবা। সেই হিসেবে বাবা-মাও বয়সে তাদের নবজাত শিশুটির সমান। কিন্তু, বাস্তবতা হলো, এই আনকোরা বাবা-মায়ের ঘাড়েই বর্তায় নবজাত শিশুটিকে দেখভাল করার দায়িত্ব। এটি শুনতে খুব কঠিন শোনালেও আশার কথা যে, মানব জাতির উন্মেষ থেকেই এটি হয়ে আসছে এবং আমরা পারি। আমি পেরেছি।
এই দূর পাশ্চাত্যে শুধু মা হওয়া নয়, বাবা হওয়াও চ্যালেঞ্জের বিষয়। বিশেষ করে আমার মতো প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য, যাদের নিকটাত্মীয় বা বন্ধু-স্বজন কাছাকাছি বাস করে না। আমার স্ত্রী যেহেতু কর্মজীবী নন, তাই তিনি মাতৃত্বকে একভাবে পেয়েছেন। যে মায়েরা ঘর ও বাইরের কাজ দুই-ই সামলান তাঁদের জন্য মাতৃত্ব নিশ্চিতভাবেই ভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। আমার সন্তান জন্মের ঠিক এক বছর আগে অফিসের নারী সহকর্মী লরেনের সন্তানের জন্ম হয়। তার মাতৃত্বকালীন সময় ব্যবস্থাপনাটি আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। এই দুই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মাতৃত্বকালীন মুড সুইংয়ের বিষয়টি, যা পরিকল্পিতভাবে ঘটে না বরং খুব স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণে হয়ে থাকে—সেটিকে স্বামী বা সহকর্মী প্রত্যেকেরই যত্ন ও সহানুভূতির সঙ্গে দেখা উচিত। শুধু অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানোই নয়, তার পাশাপাশি মা ও সন্তানের দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক-মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্যও সেটি খুবই জরুরি। তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হলো সঙ্গীর মর্নিং সিকনেসের বিষয়টিও মাথায় রাখা।
গর্ভবতী হওয়ার খবর পেলে নতুন মায়ের জন্য ফি’র বিনিময়ে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াও, ফ্রি-ফ্রি নানা উপদেশ আসতে থাকে চারিদিক থেকে। মুরুব্বি শ্রেণির আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশী বা হোক ভবনের প্রহরী—প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু বলার থাকে। একে খুব ইতিবাচকভাবে নেওয়াই সমীচীন। পক্ষান্তরে, একজন নতুন বাবার জন্য আলাদা করে পরামর্শের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়। সবাই কেবল তাকে তার কর্তব্য সম্পর্কেই সচেতন করতে থাকে। এটিকে আমি একটি সামাজিক সমস্যা বলে মনে করি। কারণ, একজন বাবারও সহানুভূতি, পরামর্শ ও সদুপদেশের প্রয়োজন আছে, যার মাধ্যমে তিনি জানতে পারবেন কী বিশাল পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে তার জীবনে এবং এ জন্য কীভাবে ধাপে ধাপে প্রস্তুতি নিতে হবে। 

এ ক্ষেত্রে একজন আমাকে বলেছিল, সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হলো নিজেকেও গর্ভবতী ভাবা। এই উপদেশ আমার বেশ কাজে এসেছে। এর ফলে শুধু নিজের প্রস্তুতি নয়, আমার স্ত্রীর চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পরীক্ষার ফল পর্যালোচনা করা, খাদ্য পরিকল্পনা, হাঁটাহাঁটি-ব্যায়াম-বিশ্রাম ইত্যাদি থেকে এমনকি তার বাম পাশ ফিরে শোওয়া ইত্যাদি সবকিছু সম্পর্কে সার্বক্ষণিক ওয়াকিবহাল থাকাই শুধু না, এতে সহযোগিতা করতে সুবিধা হয়। এ ক্ষেত্রে কখনো আমার ভূমিকা ছিল প্রশিক্ষকের, কখনো মেন্টরের। ডাক্তার বা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির দেওয়া বুকলেটগুলো ছাড়াও বেবি সেন্টারের মতো বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং ইউটিউব ভিডিও খুব কাজে লেগেছে। বাইরের পরামর্শ গ্রহণ-বর্জন সম্পর্কে বলব, আমাদের কৌশল ছিল চিকিৎসকের পরামর্শকে প্রাধান্য দেওয়া। যেমন, এক বন্ধু আমাকে উপদেশ দিয়েছিল, তোমার স্ত্রীকে বলবে ইয়োগা করতে। চিকিৎসককে সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, ‘যেহেতু গর্ভবতী হওয়ার আগে সে ইয়োগা করত না, তাই এখন আমি তাকে ইয়োগা করতে পরামর্শ দেব না’। আমরা ডাক্তারের পরামর্শই শুনেছিলাম। ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে আমার স্ত্রী হাঁটাহাঁটি করত। এতে আমার একটা বড় পরিবর্তন আসে। আমি সকালে তার সঙ্গে পার্কে যেতাম। সে আধঘণ্টা হাঁটত আর আমারও সকালের মুক্ত আবহাওয়ায় দৌড়ানো হয়ে যেতো।
আফ্রিকান একটি প্রবাদ আছে—It takes a whole village to raise a child. সন্তান জন্মের পর প্রথম দিকে যখন আমার কন্যাটি রাত–বিরাতে হঠাৎ জেগে প্রাণপণ চিৎকার করত, তখন সারা পাড়া জেগে যাবে ভেবে খুব লজ্জা পেতাম। ভালো পাড়া-প্রতিবেশী থাকা তাই একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাদের দু–একটা উৎসাহব্যাঞ্জক কথা শুনলেও তখন ভালো লাগে। আমার স্ত্রীর আগে থেকেই আমি বাচ্চাকে খাওয়ানো, তার ডায়াপার পরিবর্তন করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা—সব বিষয়ে নিজের আগ্রহেই করেছি। হাসপাতালে নবজাতককে ব্রেস্ট-ফিড করানোর যে প্রশিক্ষণ হয়, সেটি ওর মায়ের পাশাপাশি আমারও হাতে–কলমে শিখে নেওয়াটা খুব কাজে লেগেছিল। এর ফলে বাচ্চার পজিশন এবং কমফোর্টের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো ছিল আমার নখদর্পণে।
শিশুর জন্মের প্রথম এক সপ্তাহ খুব কঠিন সময়। মা–বাবা দুজনই ভয়াবহ বিধ্বস্ত থাকে। দুজনেরই বিশ্রাম ও ঘুম প্রয়োজন হয়, বিশেষ করে রাতে। উপরন্তু তখন আমার অফিসে জরুরি প্রকল্প চলছে, তাই সেখানেও হাজিরা দিতে হচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে শিশুর খাওয়া ও পরিচর্যার জন্য বিশ্বস্ত তৃতীয় কারও সার্বক্ষণিক উপস্থিতি খুব প্রয়োজন। আমার স্ত্রীর মা ও বোন সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন। তবে প্রত্যেকেরই নিজস্ব পরিবার ও রুটিন থাকে, সে কারণে সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা থাকে। তাই যত কষ্টই হোক—২৪ ঘণ্টার জন্য যে চূড়ান্ত দায়িত্ব-কর্তব্য, শেষ পর্যন্ত তা মা-বাবার ওপরই বর্তায়।
শিশুর জন্মের পর মা ও শিশুকে শুশ্রূষা পরিচর্যার পাশাপাশি বাইরের অনেক দায়-দায়িত্ব রাতারাতি এসে পড়েছিল আমার কাঁধে। নিয়মিত দুধ, ডায়াপার, ওয়াইপস, ওষুধ ইত্যাদি সময়মতো কেনাকাটা থেকে আরম্ভ করে ফিডার, বাচ্চার কাপড়চোপড় ধোয়া-শুকানো ইত্যাদি অনেক কাজ আমি জীবনে প্রথম করেছি। বাচ্চা ও মাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা এবং পরে ডাক্তারের কাছে আনা–নেওয়ার জন্য গাড়িতে কেমন করে কার-সিট ফিট করতে হয়, তা আমাকে প্রথম শিখতে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ইউটিউব ভিডিও এবং নিরাপত্তা সতর্কতার নিয়মাবলি খুব উপকারে এসেছে। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে ডাক্তার-হাসপাতাল সংক্রান্ত তথ্যাদি সরবরাহ করতে হয়েছে। আবার বাচ্চার জন্মের পর জন্মসনদ, সোশ্যাল সিকিউরিটির জন্য তথ্যাদি সঠিকভাবে পাঠাতে আমাকে উপস্থিত থাকতে হয়েছে।
এতকিছুর পরও অনেক কিছুই অন্যরকম ও অপ্রত্যাশিত হতে পারে। হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সদের সহযোগিতা, অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি কোনো কিছুই পূর্ব-পরিকল্পনা বা আপনার প্রত্যাশিত মান অনুযায়ী হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সে ক্ষেত্রে পূর্ব-পরিকল্পনা করাও সম্ভব নয় বরং ঘাবড়ে না গিয়ে সব পরিস্থিতির জন্য মানসিক প্রস্তুতি থাকা জরুরি, বিকল্প ব্যবস্থা রাখা উচিত। হাসপাতালের বাইরে আমি অন্য কারও ওপর কোনো বিষয়ে নির্ভর করিনি। আমি জানতাম, আমার আশপাশে যারা সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক তাদের সন্তান লালন-পালনের অভিজ্ঞতা কমপক্ষে ৩০-৩৫ বছরের পুরোনো। তাদের সহযোগিতার দিকে না তাকিয়ে বরং নিজেই সবকিছু করার প্রস্তুত থেকেছি। এ দেশে ইংরেজিতে ভালোভাবে এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারাটা মা–বাবা উভয়ের জন্য যে কত জরুরি, তা সন্তান জন্মের সময় আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশন সম্পর্কে সজাগ থাকা জরুরি। সন্তান জন্মের পর মায়ের শারীরিক ও মানসিক রিকভারি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার এক বান্ধবী বছর দু–এক আগে মা হয়েছে। তার একটা উপদেশ আমার স্ত্রীর জন্য বেশ উপকারে এসেছে। সে বলেছিল, ভুলে যেওনা কত মাস ধরে তুমি সন্তানকে পেটে ধরে রেখেছে। ধীরে-ধীরে শরীরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সুতরাং যে পরিবর্তন হয়েছে ৯-১০ মাস সময় ধরে, তোমার শরীর ও মনের ফিটনেস আগের জায়গায় ফিরে যেতে অন্তত সেটুকু সময় দিতে হবে।
পাশাপাশি আরও একটি কথা বলব। আমি বাবা হয়েছি এবং এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়েছি বলেই বুঝেছি, শুধু যে মায়েদেরই পোস্ট-পার্টাম ডিপ্রেশন হতে পারে তা নয়, বাবাদেরও হয়। প্রত্যেকের মনে রাখা জরুরি, একজন বাবা এ সময় ভীষণ স্ট্রেস ও ট্রমার ভেতর দিয়ে যায়। তার জন্য এই দায়িত্ব, অভিজ্ঞতা, সবকিছুই একেবারে নতুন যা মানিয়ে নিতে হয়। বাইরে থেকে শক্ত-সামর্থ্য দেখালেও একজন পুরুষ মানুষেরও ভারবহনের সীমা আছে, সে-ও একসময় ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে পড়ে। তাকে অবর্ণনীয় মানসিক ও শারীরিক ধকল সহ্য করতে। সুতরাং, প্রতিটি বাবাকে নিজের শরীর স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখা জরুরি। কেননা, নিজে সুস্থ থাকলেই স্ত্রী-সন্তানের যত্ন নেওয়া সম্ভব। আশপাশের মানুষেরও তার দিকে সজাগ ও সহানুভূতিশীল থাকা জরুরি। আমি সে জন্য যারপরনাই কৃতজ্ঞ আমার অফিসের সহকর্মীদের প্রতি যারা আমাকে বুদ্ধি, পরামর্শ, সহযোগিতা, সাহস, শুভেচ্ছা সবকিছু দিয়ে সব সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।