রূপালী আঁধার

নদী-নালা, খাল-বিল, ঝিল আর অবারিত খোলা মাঠ ছিল ঢাকা শহরে। চার শ বছরের পুরোনো ঢাকার কোথাও না কোথাও আজও সে সবের নিদর্শন আছে। যেমন মতিঝিলের পেছনে ঝিলের সামান্য একটু ধারা এখনো বহমান। সেখানে নৌকায় সকাল–সন্ধ্যা যাত্রী পারাপার হয়। টিকাটুলি থেকে রিকশায় শাপলা চত্বর ১৫–২০ টাকার কমে যাওয়া যায় না। কিন্তু সেই ঝিলের গুদারা ঘাটে দুই টাকা জমা দিয়েই ১০ মিনিটের মধ্যেই খেয়া নৌকা এপার–ওপার করা যায়। ওই সময়টুকুতে কয়েকটি টুকরো টুকরো দৃশ্যে চোখ যায়। দল বেঁধে রাজহাঁস রোদ পোহায় ঢিবিতে। বুড়ো মতো একজন মানুষ নতুন নৌকায় আলকাতরা মাখে। গুদারা ঘাটের মাচায় বসা লোকটি খেয়াপারের মানুষদের কাছ থেকে দুই টাকা রেখে ভাংতি গুনতে গুনতে বিড়ি কিংবা বেনসন টানে। শহরের শ্রমজীবী আর বস শ্রেণি, ধোঁয়ার নেশায় কখনো কখনো বেনসন আর বিড়িতে একাকার হয়ে যায়। কোনো প্রবলেম মনে করে না। একের অভাব অন্যটিতে পূরণে কোনো সংকীর্ণতা নাই। সাধ আর সাধ্যেরও টানাটানি নাই। ওপাশের বিশালাকৃতির দরগা–সংলগ্ন উটের খামার। সেখান হতে মাইকে শাহ বাবার গুনকীর্তন করা সুর ভাসে মতিঝিলের বাতাসে। ব্যাকগ্রাউন্ডে সেই সুরকে বিদায় জানিয়ে নৌকা থেকে নেমে ঝিলের ওপারের অগণিত গাড়ি, বাস, রিকশার জ্যাম পেরিয়ে নাগরিক মানুষের দল গন্তব্যে চলে যায়।
ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। কলকাতা গঙ্গার তীরে। ম্যানহাটনের চারপাশে হাডসন। টরন্টো শহরের দিগন্ত জুড়ে লেক অন্টারিও। সবগুলো শহরের জলাশয়ের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা হয়েছে। কোথাও পরিব্রাজক রূপে, কোথাও অধিবাসী। ভূপেন হাজারিকার গঙ্গা অথবা পল রবসনের মিসিসিপির বিস্তীর্ণ দু’পারের অজস্র মানুষের ভিড়ে মিশে গেছি। বহুদিন বহুযুগ বহুকাল ধরে বয়ে চলা সেই নদীর কেউ কেউ আজ মরে গেছে। অথবা বলা চলে, হন্তারকের হাতে নিহত হয়েছে সেই সব নদী। বুড়িগঙ্গা ও গঙ্গার শ্রাদ্ধ ঘনিয়ে এল প্রায়। সেই মৃত নদীর বুক চিরে একদিন নৌকা পার হয়েছি। কালো জলের ঢেউগুলি, আহা কে তাদের অমন সর্বনাশ করেছে! অমন অলৌকিক ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত হতে চেয়েও পারেনি সে নদীর জলেরা। অবশিষ্ট মাছ ও মানুষ সেই কালো নদীতে বিলীন হয়ে যেতে আর খুব একটা সময় নেবে না।
নব্বইয়ের দশকে সাভার যেতে হতো প্রতিদিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রাপথে দু’পাশে দিগন্ত জোড়া জলমহাল। গাবতলীর গরু মহিষের, ট্রাকের, ইট বালুর জিওগ্রাফি বদলে হঠাৎ সবুজ আর সবুজ, খোলা মাঠ, বর্ষায় সেই খোলা মাঠের বদলে হাওর, তারপর কর্ণ নদী পেরিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সেবার বন্যায় যখন দু’কুল ছাপিয়ে গাবতলীর এই দিকের আরিচা সড়ক ডুবে গেল তখন ক্যাম্পাসের সবুজ বাস ধরতো আশুলিয়ার রাস্তা।
সেই প্রথম আশুলিয়ার রূপ দেখি। দেখি আর দেখি। নয়ন না জুড়ায়। মন না ভরে। ইলিশ মাছের পেটে পিঠে রোদ লেগে যেমন চিকচিক করে, চাঁদপুরের ফিশারিজ ঘাটে যেরকম দেখেছিলাম—তেমনি রাশি রাশি পানি রুপার মতো চিকচিক করে আশুলিয়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে আশুলিয়াকে ভূস্বর্গ বানিয়ে রেখেছিল। গাবতলী রুটের পানি সরে রাস্তা ঠিকঠাক হলেও ক্যাম্পাসের বাসের মামারা রোমান্টিক স্টুডেন্টদের আবদারে হার মানত আর আশুলিয়ার সৈকতের পথ ধরে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতো।
তারপরের ইতিবৃত্ত- ভূমিদস্যু, ডেভেলপার আর দখলের ইতিহাস। তুরাগের দুই তীরে আজ আবাসন প্রকল্প আর দখলের উৎসব। আশুলিয়ায় শুধু বালির ড্রেজার, ভরাট প্লট, প্রকল্পের সাইনবোর্ড। ড্রয়িং রুমে সাজানো শোপিসের মতো পাঁচিল ঘেরা কৃত্রিম গাছপালায় শোভিত শহর উপশহর। কর্ণ নদী তীরের বিরাট কাশবনের চরটিতে আজ আকাশছোঁয়া বসতি। অতিকায় অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্ট। দম আটকে রাখা ঘিঞ্জি ঘুঁজির মতো সেই অ্যাপার্টমেন্টের জঞ্জালের পাশে কর্ণ নদী যেন অ্যাপার্টমেন্টের ফিটনেস পিপাসু নারীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডায়েট করতে করতে শুকিয়ে যাচ্ছে। তা শুকিয়ে যাক, সরু হতে হতে মরে যাক। আসল কাজ তো হচ্ছে। নগরায়ণ।
ওই যে দেখা যায়, অন্টারিওর আকাশে গাঢ় চাঁদ। এ চাঁদ যেন আবার দেখি নানা বাড়ির আকাশে। পিতামহের গ্রামে, আব্বা আম্মা যেখানে ঘুমায় সেই গোরস্থানের ওপরে। সেখান থেকে নিয়নের আলোর মতো জ্যোৎস্নার ধবল আলোর ঝরনায় যখন হৃদয়ের একূল–ওকূল ভেসে যায় তখন সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন। থাকুক না কিছুটা অন্ধকার। নানাদের সবুজে ঘেরা, মাছে ভরা পুকুরটিতে কেন হাতছানি দেয় নগরায়ণ। কেন লোল জিহ্বা মেলে দাদুর গ্রামটাকে গ্রাস করতে আসছে ভূমি দস্যুরা দলে দলে। কোনো আলো জ্বলবে সেই সর্বগ্রাসী নগর প্রকল্পে। যেখানে থাকবে না কোনো রুপালি আঁধার। রইবে না আর মুখোমুখি বসিবার, বনলতা সেন।

৮ জানুয়ারি, ২০১৮
টরন্টো, কানাডা