আশরাফ আহমেদের 'পাণ্ডুলিপির একাত্তর'

আশরাফ আহমেদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় পঞ্চাশ বছর আগে যখন সে লেখক ছিল না। তখন আমার দুই বছর পর সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন বিভাগের ছাত্র হয়ে ঢুকেছিল। সাম্প্রতিক কালে লেখালেখি শুরু করার পর সে প্রায় প্রতিটি লেখাই আমার কাছে পাঠিয়ে দিত ঠিকঠাক করে দিতে। কাজেই ওর প্রায় সব লেখার সঙ্গেই আমার পরিচয় বেশ গভীর। এক কথায় তার লেখাগুলো একই সঙ্গে খুবই ব্যক্তিগত অথচ নৈর্ব্যক্তিক। লেখার গুণে কোনো ব্যক্তিগত ঘটনা ও অভিজ্ঞতা যখন সবার হয়ে যায় তা-ই হয়ে ওঠে সাহিত্য। ‘পাণ্ডুলিপির একাত্তর’ও এর ব্যতিক্রম নয়, সে কথায় পরে আসছি।
ওর বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাগুলো বিশেষ মন্তব্যের দাবিদার। সায়েন্স ফিকশন নামে সাহিত্যের যে ধারা চালু আছে সেটা কাল্পনিক বিজ্ঞান ও বাস্তব সাহিত্যের মেলবন্ধন। আশরাফ যেটা লিখছে সেটা বাস্তব বিজ্ঞানের সঙ্গে, বিশেষ করে জীব সম্পর্কিত বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের একটি কৌতুক মেশানো মৌলিক সংমিশ্রণ যেটি পড়তে ভালো লাগে এবং পড়ে কিছু শেখা যায়। ‘জলপরি ও প্রাণপ্রভা’ এবং ‘হৃদয়-বিদারক’ তেমনই দুটো বই। ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ বইটি সব পাঠকমনে যেভাবে রেখাপাত করেছিল, ওর লেখা ‘একাত্তরের হজমিওয়ালা’ কিশোর উপন্যাসটিও তেমনিভাবে পাঠককে একাত্তরের প্রতি আকৃষ্ট ও যত্নবান করে তুলবে। একইভাবে সম্পূর্ণ নতুন একটি আঙ্গিকে লেখা আশরাফের ভ্রমণভিত্তিক প্রেমের উপন্যাস ‘মার্তি মণীষের প্রেতাত্মা’ নিছক ভ্রমণ এবং প্রেমের সমন্বয়ই নয়, এতে মিশে আছে বাংলা এবং পর্তুগালের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক।
‘পাণ্ডুলিপির একাত্তর’ একটা বহুমাত্রিক বই। ৩০৪ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশক ঢাকার আগামী প্রকাশনী, ৪৭ মুক্তিসন (২০১৮)। প্রচলিত সংজ্ঞায় সে মুক্তিযোদ্ধা নয় তা স্বীকার করেই আশরাফ আহমেদ বইটি লিখেছে। একাত্তর আমাদের জাতীয় জীবনে শ্রেষ্ঠ কিন্তু সবচেয়ে জটিল একটি সময়। একাত্তর আবেগের বেশি নাকি হিসেবের তা নির্ণয় করা কঠিন। সেই জটিলতায় যে অনেকগুলো সমান্তরাল, বিপ্রতীপ ও তির্যক স্রোত বয়ে চলেছিল তার বিস্তারিত বর্ণনা এখানে আছে অত্যন্ত মনোগ্রাহী সাহিত্যিক মাত্রায়। স্বল্প পরিসরে আলোচনা করলে বইটির প্রতি অন্যায় করা হবে জেনেও শুধু আমার অনুভূতিটুকুই প্রকাশ করছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে যে সখ্য ও সূক্ষ্ম সংঘাত ছিল তা বইটিতে এতই সাহিত্যিকভাবে ফুটে উঠেছে যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকদের এই বইটি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় থাকবে না।
একাত্তরের ওপর অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, যার বেশির ভাগই ঘটনার বিবরণ। কিন্তু কিছু কিছু বই ঘটনা অতিক্রম করে আরও কিছু মাত্রা যোগ করে, ঘটনার ভেতরকার দর্শনটি যোগ করে, ভেতরের আবেগটি যোগ করে, ভেতরের টানাপোড়েনটি যোগ করে। ঠিক সেইভাবে পাণ্ডুলিপির একাত্তরের ক্ষেত্রে ঘটনার বিবরণ ছাপিয়ে ওর যুদ্ধে যাওয়ার বা না যাওয়ার টানাপোড়েনটা উঠে এসেছে। এই ধরনের আরও অনেক দ্বন্দ্ব বইটিকে লেখকের ব্যক্তিগত গণ্ডি অতিক্রম করে একটা সর্বসাধারণের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। একাত্তরে তরুণ আশরাফ ছিল আবেগপ্রবণ, দেশপ্রেমিক কিন্তু যুদ্ধ এবং অনেক কিছুতেই অনভিজ্ঞ। কিন্তু বইটিতে তার তখনকার চিন্তায়, চেতনায়, স্বপ্নে এবং বাস্তব কর্মকাণ্ডে যা উঠে এসেছে তাতে আশরাফ দেশের লাখ লাখ তরুণের কণ্ঠ হয়ে, তাদের প্রতিনিধি হয়ে দেখা দিয়েছে।
এখন বাইরে থেকে আমরা সবাই বলে থাকি যে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করেছি। আশরাফের বইও তাই বলে। সে ছাত্র ইউনিয়ন করত, আমি করতাম ছাত্রলীগ। একাত্তরে একটি পর্যায়ে এই আদর্শগত বিভেদটা যে একেবারে দূর হয়ে গিয়েছিল তা নয়, কিন্তু তার মধ্যে কিছু পরিশীলনের কাজ করেছে ওর বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির। কোনটা তত্ত্ব আর কোনটা বাস্তব সেটা ওর চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ছাত্র ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণ হিসেবে ‘বিভক্তির মাঝেই শুদ্ধতা আছে’ তত্ত্বের সঙ্গে বিরোধী বাস্তবতার উপলব্ধিগুলো খুব সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে।
আরেকটি জিনিস যা খুব ভালোভাবে ফুটে উঠেছে সেটা হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ ভাবে যুদ্ধ করার ব্যাপারটা। ঐক্যবদ্ধ বা ইউনিফিকেশনের দুটো পদ্ধতির একটা হচ্ছে ফেডারেশন, আরেকটা ফিউশন। অক্সিজেনের একটি অণু হাইড্রোজেনের দুইটা অণুর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পানি তৈরি করার পর অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের কোনো অস্তিত্ব থাকে না—এটা হচ্ছে ফিউশন। আর ফেডারেশনের উদাহরণ হচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন না করে, নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখে অনেকগুলো পাপড়ি ঐক্যবদ্ধ ভাবে একটা ফুলকে ফুটিয়ে তোলা। আমাদের একাত্তরটা আসলে ফিউশন হয়নি, ওটা সম্ভবও নয়। আমাদের হয়েছিল ফেডারেশন। আমরা বিভিন্ন মতের পার্থক্য বজায় রেখেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম যে আমাদের স্বাধীনতা চাই, কিছু কুলাঙ্গার ছাড়া। তা এই যে ব্যক্তিগত গণ্ডি ও দর্শন যখন ব্যক্তিকে অতিক্রম করে সাধারণের হয়ে যায়, ইটার্নাল বা শাশ্বত হয়ে যায়, তখন সেটা শুধু সাহিত্য হয়ে ওঠে না, সেটা ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকের অত্যন্ত দরকার হয়ে পড়ে।
বইটিতে তারপর আছে একটি যন্ত্রণাক্ষত মন-আমি কিছু করতে চাচ্ছি কিন্তু করতে পারছি না। সেই মনের সেই ইচ্ছেটার রূপটা কী রকম? আবাবিল পাখি যেমন কাবাশরিফ দখল করতে আসা ইয়েমেনের রাজা আবরাহার সৈন্যদের বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল, কল্পনায় সেরকম ইচ্ছায় আশরাফ আবাবিল পাখি হয়ে বিশাল পাখির দল নিয়ে ওপর থেকে পাখির মুখ থেকে হাজার হাজার বোমা, বুলেট, বা পাথর ছুড়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করে। এটা একটা অবাস্তব কল্পনা, হাস্যকরও। কিন্তু এটা তার ইচ্ছার প্রতিফলন। প্রগাঢ়, গভীর একটা প্রচণ্ড ইচ্ছার প্রতিফলন। তারপর এ রকম ইচ্ছার আরেকটাও দেখতে পাই ১৬ই ডিসেম্বরের কাছাকাছি সময়ে ঢাকার আকাশে সে যখন যুদ্ধবিমানের ডগ ফাইট দেখছিল। তখন কল্পনায় নিজেই সে বৈমানিক হয়ে যায়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণের পর আক্রমণ করে এবং কল্পনায় একসময় তার নিজের বিমানটাও গুলিবিদ্ধ হয়। তা এই যে কল্পনাটা, কল্পনাকে খুব শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলে সেটা বাস্তব হয়ে ওঠে। আবার বাস্তবকেও খুব শক্ত করে অনেক আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরলে সেটা কল্পনার মতো মনে হয়।
এই বিভিন্ন মাত্রা বা ডায়নামিকস, সবাই স্বাধীনতাকামী হলেও তাঁদের মাঝে আবেগের সখ্য ও সংঘাত এই বইতে খুবই স্পষ্ট। বইটিতে আছে মানুষের বদলে যাওয়ার কথাও। একটা মানুষ একসময় স্বাধীনতার পক্ষে ছিল, সে স্বাধীনতার বিপক্ষে চলে গেল। কিংবা বিপক্ষে গেল অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে। কিংবা একজন স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, অত্যাচার দেখে সে স্বাধীনতার পক্ষে চলে এসেছে। এই সমীকরণগুলো এই বইতে এত স্পষ্ট যে আমি আর কোথাও তেমনটি দেখিনি।
একাত্তরের বিরাট ক্যানভাসের ওপর আশরাফ আহমেদ একক কোনো ব্যক্তি নয়। বাঙালির বিভিন্ন অংশ নিজেদের পার্থক্য বজায় রেখেই ঐক্যবদ্ধ ভাবে যুদ্ধটা করেছে। আশরাফ ছিল বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির ধারক। পুরোটা মুক্তিযুদ্ধ দেখলে মনে হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধটা ডানপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু আসলে তা ছিল না। সমস্ত জাতি, ডান, বাম, ওপর-নিচ, দশটা দিক একসঙ্গে হয়ে এই যুদ্ধটা করেছিল বলেই আমরা জিতেছিলাম। আমার মনে হয় এই দিক দিয়ে এই বইয়ের আঙ্গিকটা এত জরুরি, এবং এত কম বইতে তা প্রকাশ পেয়েছে যে ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকদের এই বইটা খুব দরকার হবে, দরকার হবে সমীকরণগুলো মেলানোর জন্য। মোটা দাগের জিনিস তো সব জায়গাতেই পাওয়া যায়, কিন্তু সূক্ষ্মতর সমীকরণ, জাতির মানসিকতা বা মাইন্ডসেট বুঝতে হলে এই বইটা অত্যন্ত উপযোগী, একেবারে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে বলে আমার বিশ্বাস।

টরন্টো, কানাডা
০৮ জানুয়ারি, ৪৯ মুক্তিসন (২০১৯)