মরার নির্বাচন

ডাউন টাউন খুলনা।
ভোট দিন, ভোট দিন, কম্বল মার্কায় ভোট দিন। ভোটের নির্বাচনী গণসংযোগ মিছিল।
দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভাতিজাকে কোলে নিয়ে জানালার গ্রিল দিয়ে দেখছিল নীলু। মিছিলের লম্বা লাইন। কিছুদিন পরেই সংসদ নির্বাচন। যে দিকেই তাকায় শুধু কম্বলের পোস্টার, আর পোস্টার। অন্য দলের পোস্টার নেই কেন? এটা কী শুধু কম্বলের নির্বাচন? নীলুর কৌতূহলী জিজ্ঞাসা?
নীলু, আদরের সঙ্গে পড়ার ঘর থেকে আবার টেনে টেনে ডাক দেয় নী......লু ও নীলু।
জি ভাইয়া, আমায় ডেকেছ?
এক কাপ চা দিতে পারিস? বোন।
রাস্তা দিয়ে নির্বাচনের মিছিল যাচ্ছে, বাবু আর আমি তা দেখছি।
তোর ভাবি কই?
আচ্ছা, ভাবিকে বলছি।
দরজায় হঠাৎ ঘণ্টার আওয়াজ। নীলু দরজা খুলতেই ঘাড়ে বিশাল ক্যামেরা ঝোলা এক যুবক তাকে এক রকম ধাক্কা মেরে সরিয়ে ঘরে ঢুকে সে নিজেই দরজা বন্ধ করে দৌড়ে গিয়ে শৌচাগারে ঢুকে পড়ল। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলল, ‘প্লিজ, দরজা খুলবেন না, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’
আগন্তুকের এমন কারবার দেখে নীলু ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সেও দৌড়ে গেল তার ভাইয়ের রুমে। বড় ভাই জজ কোর্টের উকিল মিজানুর রহমান তার পড়ার ঘরে বসে আইন শাস্ত্রের বই-পুস্তক নাড়াচাড়া করছিলেন। বিবরণ শুনে তিনিও কিছুটা ভীত হলেন। চা বানানো ফেলে রেখে ভাবি, বাড়ির ঝি একে একে সবাই জড় হলো পড়ার ঘরে। বাড়িতে কেমন একটা ভীতসন্ত্রস্ত নীরবতার সৃষ্টি হলো।
-ভাবি ভাইয়াকে বলল, শোন, পুলিশ কল কর। পরে শৌচাগার থেকে বের হয়ে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটায়ে বসে বা সেখানে কিছু ঘটে, তা হলে তো সব দোষটা আমাদের ঘাড়েই এসে পড়বে।
-পুলিশ? আরে না, না, ওদের ডেকে কাজ নেই। ওরাই বড় সন্ত্রাসী। প্রবাদ আছে ‘বাঘে ছুলে সাত ঘা,আর পুলিশে ছুলে চৌদ্দ ঘা।’
-হয়তো নিরপরাধ বেচারা কারও তাড়া খেয়ে এসে পালিয়েছে। যাদের ভয়ে এসে পালিয়েছে তাদের কিছু হবে না উল্টো ওকে ধরে নিয়ে যাবে। নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দেওয়া ফরজ, পুলিশে সোপর্দ নয়। বড় কথা, ‘সে তো আমাদের কোনো ক্ষতি করছে না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর দেখা যাক কী হয়? বললেন অ্যাডভোকেট মিজান।
-এমন সময় সবার নীরবতা ভেঙে যুবকটি বেরিয়ে এল শৌচাগার থেকে। করজোড়ে মিনতি করে বলল, ‘আমায় মাফ করবেন, আমার এ অনধিকার চর্চার জন্য। জীবন বাঁচাতে আমাকে এমনটি করতে হয়েছে। অনুমতি নিয়ে আপনাদের ঘরে ঢোকার এতটুকু সময় ছিল না আমার।’
-কিন্তু এই অনধিকার প্রবেশের কারণ কী ? জিজ্ঞেস করলেন অ্যাডভোকেট মিজান।
-কতিপয় দুষ্ট ছেলে আমার পিছু নিয়েছিল। বাগে পেলে তারা হয়তো আমাকে খুনই করে ফেলত। আমার মোটরসাইকেলটার সামান্য ত্রুটি দেখা দেওয়ায় সেটা মেরামতের জন্য একটি গ্যারেজে দিয়ে হেঁটে হেঁটে খুলনা প্রেসক্লাবে গিয়েছিলাম। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে গ্যারেজের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন টের পেলাম কেউ আমাকে ফলো করছে। তখন আমি আমার গন্তব্য পরিবর্তন করে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকি। আরও দুটো বাড়িতে ঢুকতে চেয়েও ঢুকিনি। শেষে আবার বাড়িওয়ালাদের ওপর হামলা হয়? আপনাদের গেটে নামফলকে লেখা দেখলাম এটা উকিলের বাড়ি। মনে করলাম এ বাড়িতে ওরা ঢুকতে সাহস পাবে না। সত্যিই আমার এ উপস্থিত বুদ্ধিটা কাজে লেগেছে। থ্যাংকস গড, এখনো আমি বেঁচে আছি।
-কিন্তু যুবক তুমি কে? কী তোমার পরিচয়?
-আমি একজন সংবাদ কর্মী। একটি পত্রিকায় কাজ করি।
গত পরশু গগন বাবু রোডে দু’জন বয়স্ক লোক গোলপাতার পোস্টার লাগাচ্ছিল। এ সময়ে ক’টা ছেলে তাদের সে কাজে বাঁধা দেয়। তাদের কাছে থাকা পোস্টার, আঠার বালতি, মই সব তছনছ করে নর্দমার ময়লা পানিতে ফেলে দেয়। সে সময়ে তারা উত্তেজিত কণ্ঠে তাদের জামায়াত রাজাকার বলে গালি দিতে দিতে চড় থাপ্পড় মারতে থাকে।
আমি নিজ চোখে দেখলাম এক বৃদ্ধ তাদের দিকে হাত জোড় করে বলছে, ‘বাবারা আমার নাম কার্তিক এবং সে সুদেব। আমরা হিন্দু মানুষ। জামায়াত রাজাকার নই, দিনমজুর। ইলেকশনের চাপে কোথাও কাজ কর্ম নেই। এক ভদ্রলোক এই সব সরঞ্জামাদি দিয়ে বললেন, পাড়ার দেয়ালে দেয়ালে, গাছে-গাছে লাগিয়ে দিতে। লাগানো শেষ হলে আমাদের এক হাজার টাকা দিবে।’
অন্যজন বলে উঠলেন, ‘দু’দিন আগে কম্বলের মিছিলে ডেকেছিল সেখানেও আমরা অংশ গ্রহণ করলাম।’
বেশতো, কম্বলে ডাকলে সেখানে যাবি।
কম্বলের মিছিলে গেলে চিড়া-মুড়ি খাওয়ায়ে বিদায় দেয়। বাড়িতে বউ বাচ্চাদের খাওয়াব কী?
শালা, শুয়োরের বাচ্চা তোর জামায়াতিরা টাকা দেয় এই বলে ক্রুদ্ধ হয়ে একজন এসে বৃদ্ধকে লাথি মেরে নর্দমায় ফেলে দিয়ে হন হন করে স্থান ত্যাগ করল।
আমি দূর থেকে সেই নির্যাতনের দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করি। গতকাল সেই নির্যাতনের দৃশ্যসহ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে আমাদের পত্রিকায়। আমাকে যারা আক্রমণ করতে এসেছিল তাদের মধ্যে আমি একজনকে চিনতে পেরেছি। ওই দিনের অকুস্থলে সে ছিল।
-এতো সিরিয়াস ব্যাপার! বললেন অ্যাডভোকেট মিজান।
-জি ভাই, সত্যিই সিরিয়াস। আমাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তা না হলে এতক্ষণে হুমায়ূন কবির বালুর মতো রাস্তায় লুটোপুটি খেতাম।
-না, না। ঠিক আছে। তোমাকে খুব নার্ভাস লাগছে। চলো আমরা সামনে বৈঠক ঘরে গিয়ে বসি।
-না, বসব না আমাকে এখনই বের হতে হবে।
-তা কেমনে হয়? তোমার জীবনের ওপর দিয়ে যে বিপদ কেটে গেল। একটু বিশ্রাম নিয়ে পরে না হয় যাও। ‘চলো চলো’ বলে মিজান সাহেব যুবকের হাত ধরে বৈঠক ঘরের দিকে যেতে যেতে ডাক ছাড়লেন নীলু? তোর ভাবিকে বল সে যেন আমাদের জন্য কিছু চা নাশতা পাঠায়।
-নীলু? কে নীলু? বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল যুবকটি।
-আমার ছোট বোন। কেন তুমি তাকে চেন নাকি?
-তেমন চিনি না। তবে এ নামটা আমার খুবই পরিচিত।
খুলনা পাবলিক কলেজের ছাত্রী নীলু। সেদিন আকাশটা ছিল মেঘলা রাস্তা ঘাটও বেশ ফাঁকা। কলেজ ছুটি শেষে রিকশায় চড়ে বাসায় ফিরছিল সে। খুলনা রেডিও স্টেশন পার হয়ে জোড়া গেটে আসতেই দেখলাম এক দুর্বৃত্ত তার রিকশার চালককে ঘুষি মেরে ফেলে দিয়ে তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া করছে। মেয়েটিও ভয়ে চিৎকার করছে। কয়েকটা রিকশা চলে গেল তার পাস দিয়ে। তার আর্তচিৎকারে কেউ এগিয়ে এল না। যে যার মতো চলে যাচ্ছিল ওই দৃশ্য দেখেও। আমিও যাচ্ছিলাম সে দিন ওই রাস্তা দিয়ে। আমি তখন আমার মোটরসাইকেলটি থামিয়ে রুখে দাঁড়ালাম দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে। আমি যখন রুখে দাঁড়ালাম আমার দেখাদেখি কয়েক জন পথচারীও এগিয়ে এল। তখন দুর্বৃত্তরা পালিয়ে গেল। পরে আমার মোটরসাইকেলে তাকে খুলনা নিউ মার্কেটে তার এক আত্মীয়ের দোকানে পৌঁছে দিয়ে আমি আমার গন্তব্যে চলে যাই। তার সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না।
-তাই নাকি, অপলক নেত্রে তাকাল অ্যাডভোকেট মিজান? তোমার নাম কী রুবেল?
-জি। কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?
-তুমি যে নীলুকে দুর্বৃত্তের কবল থেকে রক্ষে করছিলে সেই নীলুই আমার বোন।
-বলেন কী?
-সেদিন তুমি ফিল্মের রুবেলের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার বোনকে উদ্ধার করেছিলে। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের যে মহাউপকার তুমি করেছ তার জন্য আমরা তোমার কাছে সত্যিই কৃতজ্ঞ।
নীলু, রেবা তোরা কই? তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। এসে দেখ। আমাদের ঘরে কে ঢুকেছিল? উচ্চস্বরে বোন নীলু ও স্ত্রী রেবাকে ডাক দেয় অ্যাডভোকেট মিজান।
ঘরের ভেতর থেকে রেবা সাড়া দেয় কে?
-রুবেল। জবাব দেয় মিজান।
-কোন রুবেল, গো?
-সেই রুবেল যে নীলুকে দুর্বৃত্তের কবল থেকে রক্ষা করেছিল।
-বল কী!
-তবে আর বলছি কী?
নীলুর চিৎকার শুনে সবে যেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে জড় হয়েছিল এ বার তারা ভাইয়ের ডাক শুনে সবে উল্লসিত হয়ে জড় হলো। এ যেন কল্পনাও করা যায় না। যেখানে ভীতি সেখানেই উল্লাস।
মিজানের ডাক শুনে রেবা, নীলু কাজের মেয়ে একে একে সবাই সেখানে হাজির হলো।
-ভাবি রেবা নীলুকে জিজ্ঞেস করল ইনি কি সেই রুবেল?
-হ্যাঁ ভাবি। আমার তো তা–ই মনে হয়। আমার সে দুর্ঘটনাটার বছরখানেক হয়ে গেল না? ক্ষণিকের দেখা সেই মানুষটির চেহারাটা যেন একটু অস্বচ্ছ হয়ে গেছে। তা ছাড়া ওনাকে দেখার সময় আমি পেলাম কই? উনি তো আমাকে ধাক্কা মেরে নিজের জীবন বাঁচাতে ছিলেন ব্যস্ত। বলল নীলু।
ভাবি নীলুর দিকে তাকিয়ে বললেন, রান্না ঘরে ট্রেতে চা বিস্কুট সাজিয়ে রেখেছি নিয়ে আসো তো।
ভাবি রুবেলের কাছে এসে বসে বলল, ‘আপনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমার ননদের জীবন বাঁচিয়েছেন তা আমরা কোনো দিনও ভুলতে পারব না। আপনাকে যে আমরা এতটুকু আপ্যায়ন করতে পারব আমি কখন কল্পনাও করতে পারিনি। আমার সাহেব আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছে। আপনার ঠিকানা জানা না থাকায় তা সম্ভব হয়নি।’
-আপনি কি শুধু সাংবাদিকতা করেন? নাকি অন্য কিছুও করেন?
-সাংবাদিকতার পাশাপাশি আমি ল’ কলেজে পড়ি। সাংবাদিকতা আমার পেশা নয়, নেশা। ল’টা পাস করতে পারলে এসব ছেড়ে দেব। দেশের যে অবস্থা চাকরি–বাকরি তো কোথাও নেই। তাই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এসব করছি আর কী?
-আপনি ল’ পড়ছেন কোথায়?
-হ্যাঁ পড়ছি। খুলনা সিটি ল কলেজে।
-ও আচ্ছা । তা বেশ ভালো।
এমন সময় দই মিষ্টি কলা চানাচুর ভর্তি বড় একটা ট্রে নিয়ে হাজির হলো নীলু। মুখে আবার জিজ্ঞেস করল আপনি কী পছন্দ করেন কফি, না চা?
চোখ তুলে তাকাল রুবেল। যেন ওই দিকের করিডোর থেকে ফ্লাশ লাইটের তির্যক আলো এসে রুমটি আলোকিত করে ফেলল। দুধে আলতা মেশানো গায়ের রং, হরিণী ডাগর টানা টানা চোখ যেন পাকা টস টসে ফ্লোরিডার কমলা। আহা কী সুন্দরী মেয়েটি! সে দিনের বৃষ্টিতে ভেজা ভয়ে জড়সড় মেয়েটি আর এ মেয়েটি কী একই? দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল তার ভাবির দিকে সে কী দেখে ফেলেছ না কী তার চাহনি? আরেক বার তার দিকে তাকিয়ে বলল, চা কফি একটা হলেই হবে। কিন্তু এত খাবার কে খাবে?
-আরে ভাই, শুরু করেন। আপনি না পারলে আমরা তো আছি। বললেন ভাবি রেবা।
-চা নাশতা খেয়ে বিশ্রাম করুন। আপনার জন্য আমি রান্না করি চারটা ডাল, ভাত খেয়ে যাবেন।
-না, না। আমার বেশ তাড়া আছে। আমাকে এক্ষুনি উঠতে হবে। আগামীকাল সকালে সার্কিট হাউস মাঠে গোলপাতার জনসভা। সেখানে গোলপাতার আহ্বায়ক মোহাম্মদ দলিল উদ্দিন বক্তব্য দেবেন। রাতে সার্কিট হাউসে ওনার সঙ্গে সাংবাদিকদের কনফারেন্স আছে। সেখানে আমাকে থাকতে হবে।
আপনাদের বাড়ি চিনে গেলাম আরেক দিন না হয় এসে খেয়ে যাব। আমার আজকের এ নিমন্ত্রণটা তোলা থাকল। বলে রুবেল উঠে পড়ল। যাওয়ার আগে একটা পার্সোনাল কার্ড দিয়ে গেল রুবীর হাতে। সুন্দর ঝকঝকে অপসেট প্রিন্টে ছাপা ‘কামরুজ্জামান রুবেল, স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক আসমান জমিন’।
সেদিন দুপুর। হঠাৎ আকাশে মেঘ জমে বিদ্যুৎ চমকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। টিনের চালে গাছের ডালে রিম ঝিমিয়ে ছন্দে ছন্দে। বৃষ্টির এই সময়ে ছেলেটিও ঘুমিয়ে পড়ছে। মিজান সাহেব কোর্ট থেকে ফিরবেন সে বিকেল পাঁচটায়। এক নিরিবিলি পরিবেশ, বাইরে বের হওয়ারও সুযোগ নেই। ননদ ভাবি বসে বসে লুডু খেলছে আর গল্প করছে।
-হ্যাঁরে নীলু ,তুমি কি নিজের সংসার নিজে গড়ার চিন্তা করছ? বলল ভাবি।
-তার মানে?
-তুমি এখন বড় হয়েছ। বিয়ে থা করতে হবে না? এটাই তো জীবনের বাস্তবতা। লেখাপড়া তো প্রায় বাদই দেওয়ার উপক্রম। ভালো একটা পাত্রে বিয়ে হলে হয়তো পড়ালেখাটাও চালিয়ে যেতে পারবে। রুবেল ছেলেটাকে আমার বেশ পছন্দ হয়। বেশ স্মার্ট, মাস্টার্স পাস করে এলএল বি পড়ছে। একদিন পাসও করে যাবে। তোমার ভাই আজ বাসায় এলে ছেলেটা সম্পর্কে খোঁজ–খবর নিতে বলব।
রুবেলের কথা উঠতেই নীলু লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল। যেহেতু সেও মনে মনে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। আরও ভাবল সে যে চুপে চুপে তাকে ভালোবাসে তার ভাবি তা জানল কী করে? মেয়েরা মা জাতি ওরা মানুষের মুখ দেখলে অনেক কিছু বুঝতে পারে। তুমি যে কী বলো ভাবি। এ বলে দৌড়ে ঘর থেকে ছুটে গেল নীলু।
ভাবি উচ্চস্বরে ডাক দেয়, এই নীলু যাও কোথায়, আর খেলবে না। “দুষ্টের শিরোমণি লঙ্কার রাজা, চুপিচুপি খাও বুঝি চানাচুর ভাজা।” ঠিক আছে , তোমার ভাই এলেই তাঁর কাছে কথাটা পাড়ব ক্ষণ।
মিজানের টেলিফোন পেয়ে চমকে গেল রুবী।
-কী ব্যাপার ? এইমাত্র কোর্টে গেলে। যেয়েই টেলিফোন, কিছু ফেলে গেছ কী? তোমার শরীর খারাপ করেনি তো?
-না,আমার শরীর খারাপ করেনি। আর কিছু ফেলেও যাইনি। তবে খবর শুনেছ?
-কী গো?
-কোর্টে এসেই পত্রিকায় দেখলাম, গতকাল বিকেলে মিছিলের ছবি তুলতে গিয়ে রুবেল আহত হয়েছে। তাকে সংকটজনক অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমি ওদের পত্রিকা অফিসেও টেলিফোন করেছিলাম তারা জানাল তার অবস্থা সংকটজনক। হেলিকপ্টারে ঢাকায় নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। তুমি তৈরি থেক, আমি এক্ষুনি বাসায় আসছি। ছেলেটাকে দেখতে হাসপাতালে যেতে হবে। নীলু যদি যেতে চায়, তাকেও তৈরি হতে বলো, কেমন। কথাগুলো বলেই মিজান টেলিফোনটা রেখে দিল।
প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে পত্রিকায় লিখেছে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে খুলনায় কম্বল ও গোলপাতা সমর্থকদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। গতকাল বিকেলে স্থানীয় শহীদ হাদিস পার্কে এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশের বরাত দিয়ে পত্রিকা জানায়, শহরের বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগের মিছিল শেষে কম্বল প্রতীকের একদল কর্মী শহীদ হাদিস পার্কে বিশ্রাম নিয়ে চিড়া–মুড়ি খাচ্ছিল। এমন সময় বাংলাদেশ ব্যাংক হয়ে গোলপাতা প্রতীকের অন্য একটি দল সেখানে ঢোকার চেষ্টা করে। পার্কে আগে অবস্থান করা কম্বলের কর্মী সমর্থকদের মুখোমুখি হলে একে অপরের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। এ নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে প্রথমে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। একপর্যায়ে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। সংঘর্ষে উভয়পক্ষই হাত বোমা, ককটেল একে অপরের দিকে নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ উভয়পক্ষের অন্তত ১০/১২ জন আহত হয়।
সংঘর্ষের ছবি তুলতে গিয়ে দৈনিক আসমান জমিনের স্টাফ রিপোর্টার কামরুজ্জামান রুবেল বোমার আঘাতে মারাত্মক হলে তাঁকে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তাঁকে দ্রুত খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
অ্যাডভোকেট মিজান পরিবার নিয়ে যখন হাসপাতালে পৌঁছাল, তখন সবই শেষ। হেলিকপ্টারে তাঁকে ঢাকায় নেওয়ার আর প্রয়োজন নেই। দেহ থেকে আত্মাটা ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছে। দেখতে পেল বেশ কিছু সাংবাদিক ও লোকজন কালো চাদরে ঢাকা একটা কফিন কাঁধে নিয়ে হাসপাতালের দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নীচে নেমে আসছে।
নীলু স্তদ্ধ হয়ে হয়ে গেল। লজ্জাবতী সেই মেয়েটি তার ভাবিকে জড়িয়ে ধরে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলল, “ভাবি এ কী হলো! আমি তাঁকে জানাতেও পারলাম না যে আমি তাঁকে ভালোবাসি।”
নীলুকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা ভাবির ছিল না। শুধু মনে মনে সে বলল, ‘মরার নির্বাচন!
হায় আল্লাহ! নির্বাচনের নামে একি সহিংসতা? সহিংসতায় প্রেমিক তার প্রেমিকা হারাবে, মা তার সন্তান হারাবে। এ কেমন নির্বাচন? এ সহিংসতার শেষ কোথায়?

আটলান্টা। ৩১/১২/২০১৮