প্রতীক্ষা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শৈলী একমনে বাবুলকে দেখছে।

বাবুলের একটু অস্বস্তি হয়। নিজে থেকেই সে বলে, কখন যে ঘুমায় গেছিলাম, টের পাইনি। তাই দেরি হলো।

শৈলী হাসে। বাবুল কেন দেরি করল সেটা নিয়ে তার প্রশ্ন নেই। রাগও নেই। বাবুলের দিকে তার এই মুহূর্তে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে, তাই তাকিয়ে আছে। এটা বাবুল জানে। বাবুলের যত অস্বস্তি এখানেই। এই অস্বস্তিটুকুও শৈলীর ভারী মিষ্টি লাগে।

: শিঙারা আর মিষ্টি দিতে বলি? শৈলী জানতে চায়।

: বল। মিষ্টি আমাকে অল্প একটু ভেঙে দিয়ো। বেশি খেলে মাথা ধরে। যা চিনি দেয় এরা মিষ্টিতে!

: তোমার জন্য অমিষ্টি মিষ্টি বানাতে হবে। শৈলী দুষ্টুমি করতে ছাড়ে না।

একটা বয় দুই হাত জড়ো করে ছয় সাত গ্লাস পানি এনে ধাম করে টেবিলে রাখে। কিছুটা পানি ছলকে চারপাশে পড়ে। দুজনের জন্য এত পানি দেয় কেন কে জানে!

দুই মাস হলো গার্লস স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিটা পেয়েছে শৈলী। স্কুল ছুটি হলে মাঝে মাঝে ছোট টিনের ছাপড়ার এই হোটেলে বাবুলের সঙ্গে দেখা করে সে। ছোট এই শহরে কোথাও তারা একটু শান্তিতে কথা বলতে পারে না। সবখানেই ওদের বিভিন্ন রকম নজরদারিতে থাকতে হয়। হাড় জিরজিরে বুড়োগুলো রাগ চোখে তাকায়। ফ্রিতে কিছু উপদেশ ও শাসন অফার করার ব্যাকুলতা তাদের চোখেমুখে। গাল ভাঙা রোমিওরা দূর থেকে টুকরো প্রেম ছুড়ে দেয়। দল ধরে হাসে। ছোট ছেলেমেয়ে ও নারীরা তাদের দিকে আতঙ্ক নিয়ে তাকায়। যেন তারা ফাঁসির আসামি। এখুনি তাদের ধরে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। হৃদয়বিদারক কোনো দৃশ্য দেখতে হবে তাদের। এতসব দৃষ্টি উপেক্ষা করে তারা এই ছাপড়ায় দেখা করে। বিকেলে এখানে লোক তেমন হয় না।

শৈলী বয়কে মিষ্টি আর শিঙাড়ার অর্ডার দেয়। তারপর ব্যাগ খুলে ছোট একটা প্যাকেট বের করে বলে, এই দ্যাখ রিমি কী করছে! আমাকে একটা কলম গিফট করছে!

রিমি শৈলীর এক ভক্ত ছাত্রী। এই দুই মাসেই এত বড় ভক্ত কীভাবে তৈরি হলো কে জানে!

বাবুল দেখে কালো চকচকে একটা পার্কার পেন। ঢাকার দু-একটা দোকানে এটা কিনতে পাওয়া যায়। আগে এমন একটা কলমের বেশ শখ ছিল বাবুলের। কেনার সাধ্য হয়নি এখনো। যা দাম!

: এ তো মেলা দাম! বাবুল উলটে পালটে কলমটা দেখে বলে।

: হুম, রিমির মামা রোম থেকে আসছে। ওর জন্য কালো আর নীল দুই রঙের পার্কার নিয়ে আসছে। এখন কালোটা আমাকে দিছে। নেওয়াই লাগবে, কান্নাকাটি হুলুস্থুল।

শৈলী হাসে। শৈলী শ্যামা, তন্বী। ছোট্ট নাকটির জন্য তার চেহারায় কিছুটা ট্রাইবাল লুক এসেছে। ওড়না দিয়ে সে কপাল ও নাকের ঘাম মোছে। পড়ন্ত বিকেলে অবসন্ন শৈলীর ছোট্ট মুখটায় প্রশান্তির ঝিলিকটুকু বাবুলের বড় ভালো লাগে।

: কী দেখ। শৈলী চোখ নাচায়।

বাবুল মুগ্ধতাটুকু লুকোতে চায়—তোমার চাপা নাক দেখি। তুমি শৈলী-পাহাড়ি মেয়ে। নামের প্রভাব মারাত্মক হয়। নামের প্রভাবেই তোমার নাক চাপা হইছে মনে হয়!

: এত দিনে আমার নামের রহস্য বের করলা! তা তোমার নামের প্রভাব কী? শৈলীর গলায় কৌতুক।

: বাবুলের আবার কী মানে! কোনোই মানে নাই। প্রভাবও নাই।

: উহু, বাবুল হচ্ছে খোকা বাবু! তাই তুমি ছোট্ট। বড় হবা না কোনো দিন। শৈলীও কম যায় না ফোড়ন কাটায়।

ওরা চুপচাপ শিঙারা, মিষ্টি খায়।

: শোনো, কলমটা তুমি নাও। শৈলী খুব সংকুচিতভাবে বলে।

: কেন? বাবুল খুব অবাক হয়।

: আমি দিলাম তাই।

: না, না তা হয় না। বাবুল জোর আপত্তি জানায়।

: ভালো জিনিসে তোমার খুব শখ। ওটা তুমি নাও প্লিজ। অনুনয় ঝরে শৈলীর গলায়।

বাবুল কখনোই তার কোনো শখের কথা কাউকে বলে না। শৈলীকেও না। তবু শৈলী সব বুঝে যায়। সব বুঝে যাওয়া কী ভালো! ভালো না। বাবুলের খুব অস্বস্তি হয়।

: দেখ অতটুকু মেয়ে তোমাকে কলমটা দিল। তুমি এটা সব সময় ইউজ করবা। ও দেখলে খুশি হবে! বাবুল খুব নরম করে বলে।

শৈলী কলমটা বাবুলের হাত থেকে নিয়ে আবার ব্যাগে রাখে।

: বিসিএসের রেজাল্টটা যেন কবে বের হবে? শৈলী খুব মৃদু স্বরে জানতে চায়।

: শোনাতো যাচ্ছে এই বুধবারই বের হবে। বাবুলের কেমন যেন ভাবলেশহীন উত্তর।

: তোমার এবার চাকরি ঠিক হবে দেখ। শৈলী বাবুলকে চিয়ার আপ করতে চায়। মৌলি কী বলে জানো? বলে, এবার ভাইয়ার চাকরি হবেই। চাকরি হলেই তিন মাসের ভেতর আপুর বিয়ে, এক বছরের মধ্যেই তার নিজের বিয়ে। তার লাইন ক্লিয়ার করার জন্যই নাকি তোমার চাকরিটা এবার হবে। বেচারীর খুব বিয়ের শখ!

বাবুল কিছু বলে না। তাদের দুই বোনের আশ্বাসে শুধু ম্লান একটু হাসে।

শৈলীর একবার ইচ্ছে হলো বাবুলকে জানায়, তার চাচা, মামারা বিভিন্ন বিয়ের সম্বন্ধ আনছেন। তাদের বাড়িতে বাবুল কখনো যায়নি। কিন্তু বাবুলের কথা বাড়িতে সবাই জানে। কিন্তু যোগ্য ও ভালো কিছু হিসেবে জানে না। তাই চাপ বাড়ছে। বাড়িতে রাতদিন এখন তার বিয়ে ছাড়া আর কোনো কথা নেই।

বাবুলের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে শৈলী কিছু বলতে পারে না। শুধু ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ফেলে।

দুই.

সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাবুলের আব্বা টিভি অন করেন। তারপর বাবুলকে ডাকেন। তিনি একা টিভি দেখতে পারেন না।

বাবুলের ঘুমোতে প্রায়ই বেশ রাত হয়। এত সকালে সে উঠতে চায় না। ডাকলে রাগ করে। তখন তার আব্বা একা একাই টিভি দেখেন।

আজ ঘুম ভেঙে ও ঘরে গিয়ে দেখে তার আব্বা রুটি-সবজি খাচ্ছেন। খুব দ্রুত খাচ্ছেন। অফিস ধরতে হবে তার। ডায়বেটিসে ভেঙে গেছে বাঘের মতো সেই চেহারা। শীর্ণ শরীরে কতটুকু শক্তি পান বোঝার উপায় নেই। কিন্তু চোখ তার আগের মতোই জ্বলে ওঠে ধক করে। জেদ তার এতটুকুও কমবার নয় জীবনে।

: আব্বাজান ঘুম কেমন হলো? বাবুলের আব্বা হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করেন। বাবুল যেন পাশ করে বেরোনো নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের কোনো বেকার যুবক নয়। যেন সচ্ছল বাড়ির আদুরে কোনো কিশোর। বেকারত্বে তার আদর একটুও কমেনি।

: ভালো হইছে আব্বা। বাবুলও হেসে উত্তর দেয়।

: গুড। কালকে তৃতীয় মাত্রা তো দেখলে না। আমি অফিস যাচ্ছি। আবার দেখাবে একটু পর। দেখ। দেশের ভেতরের ব্যাপারগুলো গভীরভাবে জানবে। বাবুলের আব্বা খুব উৎসাহের সঙ্গে বলেন।

: আব্বা, এই বুধবার আমাদের বিসিএসের রেজাল্ট। কোনো রকমে বলে বাবুল।

বাবুলের আব্বা, বাবুলের কাঁধে হাত রাখেন। তোমার চাকরি হবে। নিশ্চয়ই হবে!

বাবুল ভরসা পায় না। বলে, দেশের যে অবস্থা, কীভাবে হবে চাকরি! একটা বেসরকারি কোনো ফার্মে যদি ঢুকে যেতাম! বাবুল অনুযোগ করে।

এখানে বাবুলের আব্বার প্রবল আপত্তি। তিনি তার ছেলেকে তার হিসেবে সেরা কোথাও দেখতে চান। কম্প্রোমাইজ কী জিনিস তা তিনি জানেন না!

: বাপজান, আমি থাকতে তোমার কোনো চিন্তা নাই। তোমার এবার চাকরি যদি নাও হয়, আমি আছি! আমার যে স্বাস্থ্য তাতে আরও দশ বছর বাঁচতে পারব। তোমাকে সাপোর্ট দিতে পারব। কিন্তু তোমাকে ভালো কোথাওই যেতে হবে। নাছোড়বান্দার মতো বাবুলের আব্বা সেই পুরোনো কথাই বলে যান!

বাবুলের আব্বা অফিসের জন্য রেডি হন। বহু ব্যবহারে জীর্ণ শার্ট-প্যান্ট, অনেক সেলাই করা জুতার ওপর যখন সেকেন্ড হ্যান্ডে কেনা ব্লেজার আর উলেন হ্যাট চাপান, দীর্ঘ ঋজু শরীর ও দীপ্ত চাহনির তাকে যেন অভিজাতই লাগে। পরিবারের শতেক গ্লানি যেন তাকে ছোঁয় না। বড় বড় ধাপে তিনি সকল মালিন্য, অপমান, বঞ্চনা পেছনে ফেলে অফিসে রওনা হন।

কিন্তু বাবুল জানে তার আব্বার চাকরিটা বড় অনিশ্চিত। টাকা ঠিকমতো পাচ্ছেন না। পরিশ্রম অত্যন্ত বেশি। শরীরের এই অবস্থায় তার বিশ্রাম দরকার। বাবুলের এত দিনে একটা কোথাও ঢুকে যাওয়া দরকার ছিল। কিন্তু সেই একটা যদি প্রাইভেট ফার্ম হয়, তার আব্বা খুব রেগে যাবেন। তিনি রেগে গেলে একেবারেই অনর্থ বাধাবেন। আব্বার রেগে যাওয়াকে বাবুল খুব ভয় পায়। পরিবারের সবাই পায়। তিনি কোনো মতেই ছেলের পরিণতি নিজের মতো দেখতে চান না।

টিভিতে আবার তৃতীয় মাত্রা শুরু হয়েছে। বাবুলের আম্মা রুটি, ডিম, সবজি আর আগের দিনের মাছের তরকারি, খেজুরের গুড় সবকিছু এগিয়ে দেন বাবুলের দিকে। রুটি অনেক কিছু দিয়ে খেতে বাবুল খুব ভালোবাসে।

: আম্মা আমার যদি এবারও বিসিএস না হয়! বাবুল খুব অনিশ্চিতভাবে বলে।

: না হলে, না হবে! ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। বাবুলের মায়ের নিশ্চিন্ত উত্তর। মলিন শাড়িতে, ক্লান্ত মুখে তাকে বুঝি খানিকটা অসহায় দেখায়।

ভাগ্য এই পরিবারকে নিয়ে খেলেছে এত দিন। স্বামীর মতো অত মনের জোর তার নেই। মা তিনি। সব ভয়কে উড়িয়েও দিতে পারেন না। একটা খুশির দিনের হালকা আশায় আর অনেকটা আশঙ্কায় তিনি দিনগুলো পার করছেন দাঁতে দাঁত চেপে। কিন্তু বাবুলকে এটা বুঝতে দিতে চাইছেন না।

তিন.

আজ বুধবার। বিসিএসের রেজাল্ট বেরোবে। এই রেজাল্টের দিকে সে তাকিয়ে আছে অনেক দিন। তাকিয়ে আছে তার জীবনে যারা জড়িয়ে আছে তারা সবাই। আব্বা, আম্মা, শৈলী, মৌলি। চাকরি যদি হয়, তাহলে সে কী কী করবে, ভালো মতো ভেবে দেখেনি কখনো। ভেবে দেখার জন্যও তার সময় দরকার। একা থাকা দরকার বেশ খানিকটা সময়।

যদি না হয় চাকরিটা, তবু তার একা থাকা দরকার। প্রবল আশাভঙ্গে সে নিঃসাড় হয়ে যায়। সেই তাৎক্ষণিক ভেঙে পড়া চেহারা কাউকে দেখাতে চায় না সে। কারও সান্ত্বনা সে চায় না।

বাবুল সকালেই বাসা থেকে বের হয়েছে একটু বেরোবে বলে। আসলে সে বাসে চেপে চলে এসেছে পাশের শহরে। এখানে তাকে কেউ চিনবে না। তার সব প্ল্যান করা আছে। পেপার কিনে সে রেলওয়ে মাঠে বসে রেজাল্ট দেখবে।

যদি চাকরিটা হয়, এখানেই সে প্ল্যান করে ফেলবে সামনের দিনগুলোর। যদি না হয়, এখানেই বসে থাকবে সে ততক্ষণ, ভাঙা মনটা শান্ত করতে লাগে যতক্ষণ। এখানে কেউ তাকে বিরক্ত করতে আসবে না।

কিন্তু পেপার তো এখনো আসছে না স্টলে! বাবুলের মনে ঘুমের স্বপ্নের মতো কত টুকরো ছবি এলোমেলো ভেসে উঠে, সেগুলো জোড়া লেগে নানান আকার পায়। আবার টুকরো হয়ে ভেঙে যায়।

শৈলীর বাড়ির চাপের কথা সে জানে। শৈলীর অজান্তে মৌলি তাকে সবই বলেছে। শৈলীকে নাকি এক কলেজশিক্ষকের খুবই পছন্দ হয়ে গেছে। তার বাবা–মা আর অপেক্ষা করতে চাচ্ছেন না। শৈলীর ছোট্ট নিশ্বাসটা খুব মনে পড়ছে তার!

আব্বার প্রবল জেদি, রাগী, একগুঁয়ে, ভালোবাসার শীর্ণ মুখটা মনে ভাসছে।

আম্মার ভাঙা মনের না বলা আবদার যেন কানে বাজছে।

একটা চাকরি চাই। একটা বিসিএসের চাকরি! আর কত প্রতীক্ষা!

স্টলে পত্রিকা চলে এসেছে। ভিড় করে সব কিনছে!

ভিড় কমলে বাবুল পেপারটি কিনে মাঠে এসে বসল। তার হাত কাঁপছে। রোল নম্বরগুলো কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছে। তাকে এখন প্রথমে এই ঝাপসা চোখ ঠিক করতে হবে। সেটাও একটা প্রতীক্ষা!
...

হিশাম আল রাব্বী: ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে অন জব ট্রেইনি হিসেবে কর্মরত। ইমেইল: <[email protected]>