পরিক্রমা

-এ ভাই একটা চা দাও দেখি, চিনি কম।
-স্যাকারিন দিমু চিনির বদলে? দোকানি বলল।
মেজাজটা সকাল থেকে এমনিতেই খারাপ ছিল, আরও তিরিক্ষি করে দিল বেটা। তুই তে নেমে এলাম, বললাম, ‘দে, ডাবল করে দে।’ কাপ নিলাম ওর হাত থেকে। দাম পরিশোধ অন্তে, মাটির ডায়াবেটিস বাড়িয়ে দিলাম সব চা ফেলে দিয়ে। দোকানি খুব একটা আশ্চর্য হলো বলে মনে হলো না। ব্যস্ত হলো অন্য খরিদ্দার নিয়ে। ওর সাইকোএনালিসিস করার প্রয়োজন বোধ করলাম না। হাঁটা দিলাম।
এখন ফেরা যাক আগের কথায়। ঠিক, কী নিয়ে সকাল থেকে মেজাজ খারাপ? এই হয়েছে জানেন, আজকাল মেজাজ খারাপ হতে আর কারণ লাগে না। হ্যাঁ, এটা যে নতুন কোনো ব্যাপার নিয়ে, তাও নয়। খোলাসা করেই বলি তাহলে। ব্যাপারটা হলো, নতুন ক্যালেন্ডার কিনতে হবে। বছর ঘুরেছে, তাই নতুন একটা ক্যালেন্ডার চাই। এই নিয়ে সকাল সকাল গিন্নির সঙ্গে এক রাউন্ড ঝগড়া হয়ে গেল। বলে কিনা, ‘ডিজিটাল যুগ ক্যালেন্ডার দিয়ে কী হবে। সবইতো আজকাল অটো আপডেট হয়।’ ভাগ্য ভালো মানুষের অটো আপডেট হয় না। নাকি হতে পারে? আমি কী তাহলে সেকাল আর একালের মধ্যে আটকে পড়া একজন মানুষ? ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি নতুন বছরে ঘরে নতুন ক্যালেন্ডার ঝোলানো হয়। যাই হোক, বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা রাস্তায়। কিছুক্ষণ হাঁটার পর মনে হলো এমন তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া না করলেই হতো। কত কিই তো বদলে গেছে বা যাবে। একজন নোম্যান্স ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা লোক কী ভাবলো না ভাবলো, তাতে কার কী এসে যায়।
হঠাৎ দূরে দৃষ্টি গেল। আরে, জীবন না। জীবন, আমার হাইস্কুলের বন্ধু। অনেক অলস সময়ের আড্ডার সাক্ষী। খুব চুপচাপ আর সরল ধরনের ছেলে ছিল জীবন। আমাদের আড্ডায় জীবনের কন্ট্রিবিউশন বলতে জাস্ট-উপস্থিতি। সবাই জানতো ও হচ্ছে ঘোর মনোযোগী এক শ্রোতা। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে, ও শুধু হুঁ হাঁ করে উত্তর দিত। বন্ধু রাসেল ওর নাম দিয়েছিল ‘শর্টহ্যান্ড’।
তো আজ, এই ‘শর্টহ্যান্ডে’র সঙ্গে আবার দেখা। ও দূর থেকে হাত নাড়ল। কাছে যেতেই বলল, ‘এই ম্যান, হাউ আর ইউ. ইটস বিন এ ডিকেড হাহ্ !’ কেমন যেন একটা ইলেকট্রিক শকের মতো ফিল হলো। নিশ্চিত হলাম যে ‘শর্টহ্যান্ড’ এখন বেশ ‘ডিটেইল’ হয়েছে। দু চারটা কথার পর বোঝা গেল, একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সেলসম্যান পদের মতো গুরুদায়িত্ব পালন করছে আমাদের-একদা স্বল্পালাপি জীবন মিত্র। মগজটা আমার সাদাকালো হয়ে গেল। ‘সত্যজিৎ’ এর ‘জন অরণ্য’ মুভির মূল চরিত্রের কথা মনে হলো। আর যাই হোক, কথা কম বলা লোকের জন্য এ কম্ম নয়। ওর আর কী দোষ। এটা তো আর ১৯২৫-১৯৪৫ এর সাইলেন্ট জেনারেশনের যুগ নয়। জীবন বাবু এদিকটায় এসেছেন বৃদ্ধ বাবার আশ্রম দর্শন এবং কী একটা জরুরি মিটিং আছে ক্লায়েন্টের সঙ্গে, সেটায় অ্যাটেন্ড করতে। পরেরটা বেশ জরুরি মনে হলো, তাই ওকে আর আটকালাম না। জীবন মিত্র কেটে পড়ল।
আমি কিছুক্ষণ ওর ক্রমশ ছোট হয়ে আসা গাড়ির লেজের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার পা বাড়ালাম। আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। অনেক দিন শহরটাকে এভাবে দেখা হয় না। ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে এ শহর। বেশ খিদে পেয়েছে। সামনে একটা রেস্টুরেন্ট দেখে থামলাম। দরজা ঠেলে ঢুকলাম। বাম দিকের কোনার টেবিলটা বেশ জমজমাট মনে হলো। কাছে যেতেই টের পেলাম, সবাই আমার অতি পরিচিত আড্ডার রথী-মহারথী। দেখা মাত্র, ইরফান বেশ জোরে জাপটে ধরল। ‘আরে বন্ধু তুমি এত দেরিতে’, বলল।
আমি কী বলব ভেবে ওঠার আগেই, রাসেল নেতার মতো স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল ‘তোর জন্য তো শিঙাড়ার অর্ডার আটকে আছে রে।’ যা হোক, দেয়ালের দিকে স্পঞ্জের মতো দেবেশ, মনির, হায়দার চেপে যাওয়ায় বসার জায়গা পেলাম ছোট বেঞ্চিটার ওপর। আড্ডার প্লেনটি পুনরায় রানওয়ে ছাড়ল। খেলা, রাজনীতি, রোমান্স, ভূত-ভবিষ্যৎ আরও কত বিষয়ের কাটা ছেঁড়া। সবশেষে কোরাস সংগীত। বেশ কাটছিল সময়টা। এর মধ্যে হঠাৎ, বিলুর গলা শোনা গেল- ‘কী মিয়া, দোকান কী খোলা রাখতে চান, না চান না। দুই টাকা বাকি, আর ভাব তো এমন লইতাছেন যে, চালান লইয়া টান দিচ্ছি আপনার।’ কাউন্টারে হাশেম মিয়ার অসহায় চাহনি আর তার সামনে পাওনার খোলা খাতা দেখে কারও আর বুঝতে বাকি রইল না। বিলু এগিয়ে এল আমাদের টেবিলের দিকে। ‘বিলু’ আমাদের রংবাজ বন্ধু। কেউ ওকে ঘাঁটাতে সাহস করত না। সামনে এসে কাঁধে হাত রেখে শক্ত একটা ঝাঁকুনি দিল। ‘কী মিয়া তুমি এদিকে, কী মনে কইরা? কিছু মালকরি ছাড়তো।’ আমি সম্মোহিতের মতো পকেটে হাত দিলাম।
‘স্যার, পেমেন্ট কাউন্টারে করবেন। আপনার আর কিছু লাগবে?’ বেয়ারার কথায় সংবিৎ ফিরল। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম আমি মোটেই হাশেম মিয়ার রেস্টুরেন্টে নই। বরং ‘ইস্ট অ্যাভিনিউ’ এর একটা মোটামুটি মানের ইটারিতে বসে আছি। স্বভাবতই আমার বন্ধুরাও কেউ নেই আশপাশে। বিল দিয়ে রাস্তায় এলাম। মাথাটা বেশ হালকা লাগছে। ভেবে দেখলাম ক্যালেন্ডার কিনে কাজ নেই। বরং বউয়ের জন্য একটা নিউ ইয়ারের কার্ড আর ফুল কিনে বাড়ি ফিরি। বাকি রইল আমার হ্যালুসিনেশনের পোস্ট মর্টেম? থাক, নাই বা করলাম। এই মুহূর্তে, আর্জেন্টাইন কবি আন্তোনিও পরচিয়ার একটা লাইন মনে পড়ছে- “One lives in the hope of becoming a memory.”