শূন্য দিগন্তরেখা

মৃতদেহটি আমার সামনে দিয়ে যখন নিয়ে গেল মিশ্র একটা অনুভূতি হলো আমার। মৃত মানুষটি আমার আত্মীয় নয়। আবার অনাত্মীয়ও নয়। সাধারণত জীবন আমাদের বন্ধনে আবদ্ধ করে। কিন্তু আজ মৃত্যু আমাকে একটি বন্ধনে জড়িয়ে দিল।
মৃত্যুর অনুগামী হয় নিঃসঙ্গ ছায়া। অনন্ত দীর্ঘশ্বাস। নোনাজলের নিঃশব্দ ঢেউ। নির্নিমেষ চাহনির ওধারে নিঃসীম শূন্যতা।
কিন্তু এই মৃত্যুতে এমন কিছুই হলো না। ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়ার এমন অসামঞ্জস্য সূত্র খুব কমই দেখা যায়।
আজ দিনটি শুরু হয়েছিল খুব সাদামাঠাভাবে। দিগ্ভ্রান্ত এক টুকরো কালো মেঘ এদিক-ওদিক ঘুরে ক্লান্ত হয়ে ঝুলে ছিল ছাতিম গাছের মাথায়। ভবঘুরে চড়ুইগুলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ছায়া ফেলছিল দেয়ালে। আর পাঁচটা দিনের মতোই খুব স্বাভাবিক শুরু ছিল।
কিংশুক অফিসের ট্যুরে গত পাঁচ দিন বাইরে। কিংশুকবিহীন দিনগুলোর আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য অনেক দিন ধরেই খুঁজে পাই না আমি। বলা চলে, স্বাভাবিকতার কোনো ব্যত্যয় হয় না তাতে। বেশ কিছুদিন হলো করপোরেট জগতের নামীদামি ব্যক্তি হওয়ার চেষ্টায় রত কিংশুক। এ ট্যুর ও ট্যুর লেগেই রয়েছে। এর সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে অসংখ্য ওয়ার্কশপ। এ জন্য ঘড়ির সবচেয়ে মন্থর কাঁটায় চোখ রেখে চলে ওর জন্য আমার প্রতীক্ষা। এমনকি ছুটির দিনগুলোও আমি নিঃসঙ্গতার উলকাঁটায় দিনের প্রহর বুনি।
তবে আমার এই নিঃসঙ্গতার বুনন কিংশুকের চোখ এড়াতে পারেনি কোনো দিন।
‘শাঁওলি তোমার নিজেকে আবার ব্যস্ত করে ফেলা উচিত। এভাবে থাকলে তুমি ডিপ্রেশনে চলে যাবে।’
আমাকে নিয়ে আসলেই খুব ভাবনা কিংশুকের। সেবার অল্প সময়ের মধ্যে দুই দুইবার মিসক্যারেজের ধাক্কায় আমি বিপর্যস্ত। পুঞ্জীভূত দীর্ঘশ্বাসের অতলে কেউ আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। আস্তে আস্তে আমি নিমজ্জিত হচ্ছিলাম সেই অতলে। সবার আগে কিংশুক এগিয়ে এল আমার পরিত্রাতা হিসেবে। সব দীর্ঘশ্বাস নিজের আঁজলায় ভরে কিংশুক আমাকে উপহার দিয়েছিল নিরিবিলি শান্ত দুদিন। নিয়ে গিয়েছিল শহর থেকে অনেক দূরে। এক শান্ত মফস্বলে।
কড়ে গুণে গুণে এক বছর তিন মাস আগের সেই দুই দিন। এখনো চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিলে আমি সে দুদিনের গন্ধ পাই। দিনের আবার গন্ধ হয়? হুম, হয়। আমি পাই প্রতিটা দিনের আলাদা আলাদা গন্ধ।
সে সময় শীত আসি আসি করছিল। মফস্বলের আকাশ তখন ছিল একদম ঝকঝকে পরিষ্কার। সকালে সাদাটে হালকা কুয়াশা উঠত মাটি থেকে। আর সে কুয়াশায় মিশে থাকত সবুজ ঘাসের ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণ বাতাসে মিশে ছড়িয়ে পড়তে দিনের এ প্রহর থেকে ও প্রহরে। আর এর সঙ্গে মিশে থাকত আহ্লাদী সূর্যের একটা তামাটে গন্ধ। দিনভর নির্বিকার উড়ে চলা ধুলোর সঙ্গে কিংশুকের উদ্দাম ভালোবাসায় আরও মিশে থাকত ইটার্নিটির মিষ্টি সৌরভ।
আত্মব্যস্ত এই পৃথিবীর এক কোণে সেই দুই দিন হয়ে উঠেছিল শুধুই আমাদের। সেই দুদিনের ঘ্রাণ আমার ইন্দ্রিয়ে এখনো প্রবলভাবে বর্তমান।
আমার সব দীর্ঘশ্বাস পায়রা করে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিল কিংশুক। বাঁধনহারা হয়েছিলাম আমরা সময়ের হিসেব ভুলে। ফিরে এসেছিলাম এই শহরে দুজন সবুজ গঙ্গাফড়িং হয়ে।
তবে ফেরার পরপরই কিংশুকের ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। প্রমোশন হয় ওর। বাড়ে দায়িত্ব। কাজের সব দায় কিংশুকের আত্মায় একটু একটু করে ঘাঁটি গাড়ে আর আমার দেয়ালে বাড়তে থাকে রাতের ছায়া। কখনো মানুষ, কখনো উড়ে যাওয়া পাখি। আবার কখনো একখণ্ড অনড় মেঘ। ছায়ার খেলায় আমার মন আস্তে আস্তে বশীভূত হচ্ছিল। নিজের মনে এসব ছায়া নিয়ে গল্প ফেঁদে আমি পাড়ি দিতাম ছোপ ছোপ অন্ধকারের এক একটি দ্বীপ। অনন্ত অপেক্ষার মূর্ত সময়।
কিংশুক ফিরত। সেই অন্ধকার সময় ডিঙিয়ে ফিরত ও। আর সে ফেরা শুধুই ঘরে। দশ ফুট বাই আট ফুটের একটি ঘরে।
গল্প-আদরের পরিমিত সময়ে আমি তখন অভ্যস্ত হতে শুরু করেছি। ওর চোখে অনন্তের আভাস আমাকে দেখেই লুকিয়ে যেত। আমি চোখ ঘুরিয়ে ব্যস্ত হতাম অপ্রাসঙ্গিক কোনো কথায়। কিংশুক আর আমার মাঝে অপ্রস্তুত সময় মাথাচাড়া তখনো দিতে শেখেনি।
কিংশুকের পৈতৃকসূত্রে পাওয়া ছোট এই বাড়ি। নিরিবিলি এই বাড়িতে বুনো ছাতিমের গন্ধের সঙ্গে আমার সোদা একাকিত্বের মেলবন্ধন বেশ পোক্ত হয়ে উঠছে তখন। অন্যদিকে করপোরেট জগতের এক্কাদোক্কায় নিজেকে জড়াতে তত দিনে বেশ গ্রুম হয়ে উঠেছে কিংশুক। রেইবেন-এর রোদচশমা ওর কাছে আড়াল শুরু করেছে আমার একাকিত্ব।
ক্লাসলেস আমি পিছিয়ে পড়ছি কিংশুকের হুগো বস, উইলয়াম কার্লোস, ইজরা পাউন্ডের কাছে। আমার গণ্ডি তখনো জীবনানন্দেই আবদ্ধ। বুকের ভেতর ছাতিমের গন্ধ লুকিয়ে সুবাসিত হই তখনো।
ভাঁটফুল আর হেমন্তের হিজলে তত দিনে অনীহা আসতে শুরু করেছে কিংশুকের। আমার বোধের আয়নায় তখনো সে ছবি খুব স্পষ্ট নয়। শুধু বৃষ্টি জলে নাওয়া একগুচ্ছ সময় যেদিন ওর হাত গলে হারিয়ে গেল সেদিন কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম আমি ‘দূরত্ব বাড়ছে আমাদের’।
কিংশুক নিজেকে তৈরি করতে ভাঙছে একের পর এক সিঁড়ি। সানরুফের আলোয় নিজেকে ঝাঁ চকচকে করে সমীহ আদায়ে ব্যস্ত। আর আমি রোদের আঁচ বাঁচিয়ে ছাতিমের ছায়ায় নিমগ্ন দিনরাত।
তবে সে নিমগ্নতা আমার বেশি দিন থাকেনি। বলা যায় আমিই রাখিনি। কিংশুকের ব্যস্ত সময়ের সাপলুডুর একটা অন্যরকম শক্তি ছিল। বিনা দানে কেউ বেশি সময় থাকতে পারে না সেখানে। ব্যস্ততার ছক্কা দান যখন কিংশুক হরদম দিয়ে যাচ্ছে তখন আমিও একটা দু’টো মাঝারি গোছের দান দিতে শুরু করলাম। বলা যায় কিংশুক আমাকে প্রলুব্ধ করল আমাকে। এ ছাড়া অন্য কোনো উপায়ই ছিল না আমার। কিংশুক এক একটি বড় দানে মই বেয়ে যখন অনেক উপরে তখন আমি খেই হারিয়ে সাপের লেজের নিচে হিমশিম খেয়ে চলছি।
‘কী করছ তুমি, শাঁওলি? এত অলস সময় তোমার! চার দেয়ালের বাইরে দেখ সবাই কীভাবে দৌড়াচ্ছে।’
তাই ছাতিমের গন্ধ ফেলে, জীবনান্দের বই ফেলে, হিজলের ছায়া ফেলে আমিও পা রাখি বাইরে। বিয়ের পরে ফেলে দেওয়া ক্যারিয়ারকে আবার সাপটে নেই বুকে।
কলেজের চাকরিটা আবার নতুন করে শুরু করি। আর এর সঙ্গে মঞ্চনাটকের শখটাও ঘষেমেজে শাণিত করি। প্রায় আট বছর পর ফিরে যাই আমার একান্ত নিজের জগতে। সারা দিন কলেজে পড়িয়ে সন্ধ্যায় চলে যেতাম নাটকের রিহার্সেলে। আমি মঞ্চে ফেরার পর প্রথম নাটক ছিল ‘চিত্রাঙ্গদা’।
এত দীর্ঘ সময়ের পর নিজেকে পছন্দের কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আমিও যেন মোহের দুর্গে বন্দী হতে শুরু করলাম। সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্রটা হাতিয়ে নিজেকে শান দিতে লাগলাম। গলা ছেড়ে রাতভর আওড়ে যেতাম,
‘এসো সুন্দর নিরলংকার
এসো সত্য নিরহংকার
স্বপ্নের দুর্গ হানো
আনো মুক্তি আনো
ছলনার বন্ধন ছেদি
এসো পৌরুষ-উদ্ধারে।’
ছলনার দুর্গ যে এমনভাবে ভেঙেচুরে পড়বে তা আমার স্বপ্নতেও ছিল না। আমার স্বপ্নের দুর্গ কীভাবে দিনের পর দিন ছলনার প্রাসাদ হয়ে উঠেছে তা সত্যিই আমার বোধগম্য নয় এখনো।
ফোনটা এল আজ সকালের একটু পরেই। দেয়াল থেকে চড়ুইয়ের ক্ষুদ্র ছায়া ততক্ষণে নিরুদ্দেশ হয়েছে। আমি কলেজ কামাই করেছি আজ চিত্রাঙ্গদার স্টেজ রিহার্সেল বলে। তৈরি হচ্ছিলাম। ফোনটা বাজল।
‘হ্যালো- কে বলছেন?’
‘কিংশুক রহমানের বাসা এটা?’
‘হুম’
‘আপনি?’
‘আমি শাঁওলী। কিংশুক রহমানের স্ত্রী।’
‘জয়দেবপুর হাসপাতালে কিংশুক রহমান ভর্তি আছে।’
এরপর আর কী কী কথা হয়েছে মনে নেই আমার। আমি কীভাবে জয়দেবপুর পৌঁছালাম তাও জানা নেই আমার। শুধু একটি কথাই মনের মধ্যে দামামা বাজিয়ে চলছিল ‘কিংশুকের তো চট্টগ্রাম থাকার কথা এখন’।
আমি গিয়ে দাঁড়ালাম রোড অ্যাক্সিডেন্টে আহত কিংশুকের সামনে। খুব খারাপভাবে ইনজুরড কিংশুক। একটি পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। আমাকে দিশেহারা হওয়ার সুযোগ না দিয়েই একজন পুলিশ আমাকে নিয়ে গেল একটি মৃতদেহের সামনে।
‘কিংশুক রহমানের সঙ্গে একজন ছিলেন। উনি অবশ্য খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থায় এখানে এসেছিলেন। এখন ডেড।’
আমি দেখলাম কিংশুকের অচেনা সঙ্গীর মৃতদেহ।
দীর্ঘাঙ্গী একজন। ছেঁড়াফাটা কাপড়চোপড়েও তার রুচির পরিচয় হারিয়ে যায়নি। থেঁতলে যাওয়া মুখের আরেকপাশ অদ্ভুতভাবে অবিকৃত। গমরঙা গালের ঠিক মাঝখানে একটি তিল এখনো জ্বলজ্বল করছে।
‘আপনি চেনেন একে?’ পুলিশের প্রশ্নে আমি শুধু চোখ তুলে তাকালাম।
‘কিংশুক রহমানের সঙ্গে উনি ফিরছিলেন ঢাকার দিকে। ওনারা জয়দেবপুর এসেছিলেন পাঁচ দিন হলো।’
আমি ভাবছি কিংশুক কী অদ্ভুতভাবে এই পাঁচ দিন আমাকে চট্টগ্রামের মাটির ঘ্রাণ পাঠিয়ে গেছে!
তনিমা ডিভোর্সি। নিজের পরিবার থেকে অনেক দিন দূরে। তার ফোন থেকে যে গুটিকয়েক পরিচিত মানুষের নম্বর পাওয়া গেল তারা কেউ মৃত তনিমার দায়িত্ব নিতে চাইল না।
মৃতদেহটি অনিশ্চিত পড়ে রয়েছে হাসপাতালের বারান্দায়।
আমার হাতে কিংশুকের মোবাইল। কৌতূহলবশত স্ক্রিনে আঙুল বুলিয়ে ঢুকে গেলাম মেসেঞ্জারের গোপন দুর্গে। তনিমা আর কিংশুকের অজস্র কথোপকথন। তনিমার লেখা কবিতা। ভালোবাসার নির্মল আহ্বান। কিংশুকের প্রতিউত্তর। আত্মসমর্পণ।
‘আই লাভ দি উইথ অ্যা লাভ আই সিমড টু লস উইথ মাই লস্ট সেইন্ট, আই লাভ দি উইথ দ্যা ব্রেথ, স্মাইল, টিয়ার্স, অব অল মাই লাইফ, অ্যান্ড ইফ গড চুজ, আই শ্যাল বাট লাভ দি আফটার ডেথ।’
কিংশুককে দেওয়া তনিমার শেষ ম্যাসেজ।
আমি ফিরে গেলাম তনিমার বেওয়ারিশ মৃতদেহর কাছে। পাশাপাশি হলাম আমরা দু’জন। যারা অনিঃশেষ ভালোবাসে একজন মানুষকে।