চিঠিপত্র কলামের লেখক

চিঠিপত্র কলামের লেখকদের কেউ মনে রাখে জানতাম না! তবে ক্রীড়া–বিষয়ক পাক্ষিক ক্রীড়ালোক মনে রেখেছিল। ক্রীড়ালোকের চিঠিপত্র কলামে খেলাধুলার বিষয়ে নানা প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা ও মতামত জানিয়ে চিঠি লিখতাম। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়ার পরে পুরো দেশ জুড়ে আনন্দের বন্যা। গভীর আনন্দময় সেই মুহূর্তে ক্রীড়ালোক থেকে গেন্ডারিয়ায় আমার বাসার ঠিকানায় একটা চিঠি এল। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের অসামান্য অর্জন নিয়ে তারা একটি বিশেষ সংখ্যা বের করতে যাচ্ছে। সেখানে চিঠিপত্র বিভাগে যারা নিয়মিত লেখে, তাদের মধ্যে দশজনকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই দশজনের অনুভূতি নিয়ে আলাদা করে একটা ফিচার করা হবে। আমি সেই দশজনের একজন। চিঠিটা যেদিন হাতে পেলাম, পরের দিনই লেখা পাঠানোর শেষ দিন। হাতে করেই লেখাটা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ক্রীড়ালোক অফিসে গেলাম। আর এভাবেই শুরু হলো যাত্রা।
জীবনের এই পথের বাঁকে যখন পেছনে ফিরে তাকাই, ভাবতে অবাক লাগে চিঠিপত্র কলামের লেখক থেকে কীভাবে আমি পেশাদার ক্রীড়া সাংবাদিক হয়ে গেলাম। তাও আবার বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে প্রথম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতির মতো একটি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে হলাম মাঠে-ঘাটের মানুষ। রোদে পুড়ে-বৃষ্টিতে ভিজে, রিপোর্ট করতে লাগলাম ঘুরে ঘুরে। কখনো খেলার মাঠে, কিংবা বোর্ড অথবা ক্রীড়া ফেডারেশনের কার্যালয়ে, প্রেসবক্সে, দলের ক্লাবে হাজিরা দিতে লাগলাম। অনভ্যস্ত চোখে সবাই তাকিয়ে দেখতে লাগল, ভাবখানা- ‘ইনি আবার কিনি?’ নারীরাও যে ক্রীড়া সাংবাদিক হতে পারে, মানুষ তখনো তাতে অভ্যস্ত হতে পারেনি।
১৯৯৭ সাল থেকে দুই বছর বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিকে প্রদায়ক হিসেবে কাজ করার পরে ১৯৯৯ সালের পয়লা জানুয়ারি দৈনিক মানবজমিনে ‘ক্রীড়া রিপোর্টার’ হিসেবে আনুষ্ঠানিক পথ চলা শুরু হলো। পাঁচজনকে প্রথমে লিখিত ও পরে মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে এই পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলা হয়। বলা বাহুল্য পাঁচজনের মধ্যে আমিই ছিলাম একমাত্র নারী। পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম আমি ও আরেকজন। ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি যোগ দিলাম কাজে। সেই হিসেবে এই বছর জানুয়ারিতে আমার সাংবাদিকতা জীবনের ২০ বছর পূর্ণ হলো। যদিও ২০১৪ সাল থেকে গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে ক্রীড়া–বিষয়ক লেখালেখি আর সেভাবে করা হয় না। তবে শয়নে-স্বপনে-জাগরণে নিজেকে একজন ক্রীড়া সাংবাদিকই ভাবি আমি।
ক্রীড়া সাংবাদিকতা জীবনে সবচেয়ে তৃপ্তির জায়গা, নিজের জোরে সর্বত্র পথ চলেছি। কাকা-মামার জোর খাঁটিয়ে নয়। চিঠিপত্র বিভাগের লিখতে লিখতে জায়গা পেয়েছি পত্রিকার প্রদায়ক হিসেবে। সেই দিনগুলোর কথা এখনো মনে পড়ে। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়ার দিনটি নিশ্চয়ই সবার মনে আছে! খুশির ঢল চারপাশে! আনন্দ মিছিল-রং ছিটানো, নাচ-গান, কত কিছু। রিকশা করে কোথাও যাচ্ছিলাম, পথে রং দিল ছেলেরা, আর সেখানে যাওয়া হলো না। সামান্য বিরক্ত হলেও পরে খারাপ লাগেনি। এমন বিশাল সাফল্যে তো এতটুকু আনন্দ করাই যায়!
আনন্দে টইটুম্বুর সেই সময়ে লেখা নিয়ে গেলাম ক্রীড়ালোক অফিসে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ইত্তেফাক ভবন আগে ছিল হাটখোলা টিকাটুলির মোড়ে। ভবনের চার তলায় সাপ্তাহিক রোববার ও পাক্ষিক ক্রীড়ালোক পাশাপাশি। নিচতলায় প্রেস। বহু মানুষের কর্মব্যস্ত চলাচল। তার মধ্যে দুরুদুরু বুকে হাতে একটা লেখা নিয়ে গেলাম ক্রীড়ালোক অফিসে। বড় বড় সিঁড়ি বেয়ে চার তলায় উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেলাম। ক্রীড়ালোকের পক্ষ থেকে পাঠকদের লেখা যিনি দেখতেন, তার নাম কামাল হোসেন বাবলু। তিনি আমাকে বসতে বললেন। আমি বসে জানালাম, ‘আপনাদের পাওয়া চিঠিটা আমি গতকাল পেয়েছি। সরাসরি হাতে লেখাটা দেওয়ার জন্য আসলাম।’ উনি আগ্রহের সঙ্গে লেখাটা নিলেন। চা খাবেন কিনা জানতে চাইলেন। আমি মাথা নাড়ার পরে একজন এসে প্রচুর চিনি দেওয়া লাল চা রেখে গেল। একটু পরে ওখানে এলেন ক্রীড়ালোকের তৎকালীন প্রধান প্রতিবেদক সাইফুর রহমান চৌধুরী। উনি পরিচিত হওয়ার পরে বললেন, আপনি চাইলে নিয়মিত লিখতে পারেন ক্রীড়ালোকে। আমি মাথা নেড়ে আগ্রহ প্রকাশ করলাম। বললাম, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার স্টিভ ওয়াহকে নিয়ে আমি একটা ফিচার করতে চাই। উনি লিখতে বললেন।
ইত্তেফাক ভবন থেকে বের হয়ে অভিসার সিনেমা হলের দিকে যেতে একটা পত্রিকার স্টল ছিল। ওখানে দেশি-বিদেশি পত্রিকা বিক্রি হতো। বিক্রেতা লোকটি দেখতে বেশ কালো। চেহারাটাও ভয়ংকর। ছোট ছেলেমেয়েরা দেখলে ভয় পেতে পারে। উনি কথাও বলতেন খুব গুরুগম্ভীরভাবে। আশ্চর্য একটা বিষয় হলো, লোকটি অসম্ভব ভালো ছবি আঁকতেন। দোকানে যখন ক্রেতা থাকত না, উনি গভীর মনোযোগের সঙ্গে ছবি আঁকতে থাকতেন। বেশির ভাগ পেনসিল স্কেচ। ওনার যে অসম্ভব সুন্দর একটা শিল্পী মন ছিল, ওনার চেহারা দেখে বোঝা যেত না। জীবনের পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে বুঝেছি, বাইরের রূপ থেকে আসল মানুষটাকে আন্দাজ করা ঠিক না।
ইন্টারনেট থেকে তথ্য পাওয়া তখন এখনকার মতো এত সহজ ছিল না। বিভিন্ন বিদেশি স্পোর্টস ম্যাগাজিনই ছিল তখন ভরসা। টিকাটুলির সেই পত্রিকার স্টল থেকে স্টার স্পোর্টস নামে একটা ম্যাগাজিন কিনলাম ২০ টাকা খরচ করে। তখনকার দিনে বিশ টাকা অনেক টাকা। তবে টাকাটার সম্পূর্ণ ব্যবহার হতো। স্টার স্পোর্টসটা আগাগোড়া খুব মন দিয়ে পড়তাম। তদুপরি সেখানে ফিচার করার অনেক বিষয় পাওয়া যেত। স্টিভ ওয়াহকে নিয়ে একটা ফিচার ছাপা হয়েছিল। ক্রীড়ালোক অফিসে যাওয়ার আগেই পত্রিকাটি হাতে নিয়ে দেখেছিলাম। স্টিভ ওয়াহ’র ওপর লেখাটা আমি পুরোপুরি অনুবাদ করিনি। আমার জানা, আমার পর্যবেক্ষণ, পত্রিকার তথ্য- সব মিলিয়ে মনের মাধুরী মিলিয়ে লিখলাম।
স্টিভ ওয়াহকে নিয়ে লেখা ফিচার জমা দিতে গিয়ে ক্রীড়ালোক থেকে জানানো হলো, বাংলাদেশে নারী ক্রিকেট চর্চা শুরু হয়েছে। আমাকে সেটা নিয়ে লেখার অনুরোধ করা হলো। দ্বিতীয় দিনে ক্রীড়ালোকের সম্পাদক মাহবুব হাসান নীরু ভাই ও নির্বাহী সম্পাদক নাসিমুল হাসান দোদুল ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। ক্রীড়ালোকের তখন বিখ্যাত কলাম- ‘তরুণী শিলার খোলা চিঠি’। রোকেয়া হলো থেকে শিলা নামের কেউ চিঠিটা লেখে। আমি নিজে চিঠিপত্র বিভাগের লেখক বলে শিলার ব্যাপারে জানতে আগ্রহী হলাম। সে কেন নামের আগের তরুণী লেখে এটাও ছিল জিজ্ঞাসা। কেউ আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। কারও কারও মুখে রহস্যময় হাসি। পরে জেনেছি, ক্রীড়ালোক পাক্ষিক থেকেই কেউ একজন তরুণী শিলা নামে চিঠিটা লিখত। বেশ স্থূল রসে ভরপুর ছিল সেই চিঠি।
সুলতানা কামাল ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে গিয়ে পেলাম বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলকে। কাছেই আমার এক ফুপাতো বোনের বাসা ছিল। আগে ওনার বাসায় বেড়াতে গেলাম। তারপর তার সাহায্য নিয়ে গেলাম কমপ্লেক্সের মাঠে। বাংলাদেশে ক্রিকেট কোচিংয়ের অগ্রদূত আলতাফ হোসেন ভাই মেয়েদের হাতে কলমে ক্রিকেট খেলা শেখাচ্ছেন দেখলাম। উনি তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। আগে কখনো রিপোর্ট করিনি। তাই কীভাবে কথা বলতে হয় জানি না। দেখলাম, বেশ কয়েকজন স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়ে, তাদের সঙ্গে বয়স্ক একজন অনুশীলন করছে। পরে জানলাম, বয়স্ক জনের নাম ডলি ক্যাথরিন ক্রুজ। বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য একজন অ্যাথলেট। অনেক খেলা খেলেছেন। বিয়ে করেননি। মধ্যবয়সে আশ্চর্য স্ট্যামিনা তাঁর। ঘরে বসে কিছু করার নেই তাই এই বয়সে ক্রিকেট খেলতে এসেছেন। আমি অন্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে, উনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বারবার বলছিলেন, ‘এই মেয়ে, তুমি ওদের সঙ্গে কথা বলছ কেন? আমি হলাম ক্যাপ্টেন। তুমি আমার সঙ্গে কথা বল।’
আমার যা হাসি পাচ্ছিল ওনার কথা শুনে সেটা আর বলার নয়। তবে আশ্চর্য ভালো লেগেছিল মেয়েদের আগ্রহ দেখে। সামনে কোনো টুর্নামেন্ট নেই, ক্রিকেট বোর্ডের কোনো আগ্রহ নেই, তবু স্কুল থেকে-কলেজ থেকে সারা দিনের ক্লাসের পরে ওরা এসে অনুশীলন করছে। সাদা পোশাকে ওদের হাতে ব্যাট-বল দেখে ক্ষণে ক্ষণে পুলকিত-মুগ্ধ হচ্ছিলাম। সেই মুগ্ধতা আজও কাটেনি। ডলি ক্রুজ আজীবন চিরকুমারী থেকে চলে গেছেন পরপারে। তিনি দেখে যেতে পারেননি, বহু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেটাররা যেটা পারেনি, নারীরা সেটা করে দেখিয়েছে, তারা এশিয়া কাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের আঁতুড়ঘরের সেই চর্চা নিয়ে লেখাটাই আমার জীবনের প্রথমে রিপোর্ট। ‘একজন লড়াকু ক্রিকেটার স্টিভ ওয়াহ’ আমার জীবনের প্রথম ফিচার। এভাবেই একদিন চিঠিপত্র বিভাগের লেখক থেকে আমার যাত্রা শুরু হলো ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে।