ফকির ইলিয়াসের দুটি কবিতা

কাতারবন্দী মানুষের প্রচ্ছদ
[সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম–আপনাকে]

আপনি শপথ বাক্য পাঠ করার জন্য সময় চেয়েছিলেন,
অথচ আপনি জানতেন না–আপনার শপথপাঠ
এই মাটির প্রতি ছিল চিরকালীন।
চর ও চরাচরে যে মানুষ জেগে থাকে,
বৃক্ষ ও বৈভবে বাস করে যে পাখি,
বর্তমান ও বিন্দুতে লুকিয়ে থাকে যে সাহস
সবই ছিল আপনার করায়ত্ত। ভাটির জনপদে,
বাস করা হাঁসগুলো হেসে হেসে তাকাত
আপনার মুখের দিকেই।

এ দেশের রাজনৈতিক আকালে আপনি,
ছিলেন অভিভাবক।
এই সূর্যের সংকটে আপনি ছিলেন,
উজ্জ্বল প্রদীপ-শিখা।
গ্রামের হাট থেকে রেস্তোরাঁর খাবার টেবিলে
আপনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল
আলোচনার উপপাদ্য বিষয়।

মনে পড়ে, মার্কিন মুলুকে এসে আপনি
পনেরোই আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের নথি
খুঁজেছিলেন। জেল হত্যাযজ্ঞ! যা আপনাকে
ফেরারি করেছিল দেশে দেশে,
সেই স্মৃতিচারণ করে আপনি বলেছিলেন,
‘পিতা হত্যার বিচার চাই, ইলিয়াস’!
আমি শক্ত করে আপনার হাত চেপে ধরে
জাতিসংঘ চত্বরে পাশাপাশি হেঁটে হেঁটে
খুঁজেছিলাম জাতির পিতার রেখে যাওয়া পদছাপ।

কাতারবন্দী মানুষের প্রচ্ছদ হয়ে আপনি,
সেভাবেই পদছাপ রেখে গিয়েছেন প্রিয় অগ্রজ!
খুব ধীর লয়ে বলেছেন, সৃষ্টির পক্ষে প্রজন্ম
বদলালেই, বদলাবে বাংলাদেশ।

সৈনিক হে!
আপনাকে অনন্ত কাল মনে রাখবে এই বাংলাদেশ!
এই মেঘনা নদীর ঢেউ, এই ঢাকার রাজপথ
খুব সন্তর্পণে ধারণ করবে আপনার ছায়া।
আর গোলাপগুলো নীরবে বলবে,
‘আবার কোনো দিন এই জনপদে এসো
হে রাজনীতির বরপুত্র,
দেখে যেও তোমার প্রিয় বাংলার মেঠো পথ!’

মুজিব জাস্ট ল্যান্ডেড ইন হিজ ল্যান্ড

একজন বিদেশি সাংবাদিক ফোনে জানিয়ে দিলেন
সেই সুসংবাদ!
‘মুজিব জাস্ট ল্যান্ডেড ইন হিজ ল্যান্ড’
একজন কৃষক,একগুচ্ছ ধানি ফসল হাতে নিয়ে
যিনি ছুটে এসেছেন মৈমনসিংহ থেকে—
তিনি আওয়াজ তুললেন–‘জয় বাংলা’
একজন হকার, গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে
তাকালেন আকাশের দিকে। তেজগাঁও বিমানবন্দরের
সুগভীর নীলাকাশ ভেদ করে উড়ে গেল
একঝাঁক কবুতর।

তিনি এয়ারক্রাফট থেকে নেমেই স্পর্শ করলেন
সেই মাটি। যে মাটি পুড়িয়ে গেছে পাক হানাদার,
যে মাটিতে মিশেছে লাখো শহীদের রক্ত,
যে মাটিতে ধর্ষিতা হয়েছেন লাখো নারী!

এবং বললেন–আমার কাছে দেওয়ার কিছুই নেই।
আমি ফিরে এসেছি আপনাদের মাঝে,
আমি ফিরে এসেছি তোমাদের কাছে,
আমি বাঙালি, আমি মানুষ!

লাখো মানুষ আবারও তাকালেন তাঁর সেই
আঙুলের দিকে। সাতই মার্চে যে শাণিত আঙুল
দেখিয়েছিল সূর্য, দেখিয়েছিল পথ-দেখিয়েছিল স্বাধীনতা।

মুজিব এসেছেন, এসেছেন নেতা, এসেছেন সেই অগ্নিপুরুষ
বাংলার আকাশ জুড়ে বিষাদিত আনন্দ রেখা আজ!
১০ জানুয়ারি উনিশ শ বাহাত্তর এভাবেই লেখা হয়ে যায়
এভাবেই অমর হয়ে থাকে লাল–সবুজের
পতাকা ঘেরা মানচিত্রে।