বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অকুতোভয় সৈনিক

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

মানবাধিকারের ধারণাটি আঠারো শতকে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকাশকালের ফসল। তবে সমসাময়িক মানবাধিকারের ধারণার উদ্ভব ঘটেছে সাম্প্রতিক কালে। মৌলিক অধিকারের ধারণার বিকাশ ঘটে মূলত ‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে’র মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের অভিজ্ঞতা থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক এ ঘোষণা গৃহীত হয়।
মানবাধিকার সম্পর্কিত আলোচনা বিশ্বব্যাপী প্রসার লাভ করে বিশ শতকের চল্লিশ থেকে নব্বইয়ের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে। বর্তমানে যেকোনো বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকারের ধারণা একটি প্রাথমিক কাঠামোগত ভিত্তি হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। মানবাধিকার বলতে বোঝায় মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা, যা সকল মানুষের ন্যায়সংগত অধিকার। প্রচলিত ধারণায় এই অধিকারগুলো হচ্ছে অখণ্ডনীয় ও মৌল। তবে এসব অধিকার ও স্বাধীনতা যেসব ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হোক না কেন, তা সর্বদাই বিতর্কের জন্য উন্মুক্ত। প্রাকৃতিক অধিকার থেকে মানবাধিকার; মানব ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও সামাজিক অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ রূপ লাভ করে সমাজের সদস্য হিসেবে কোনো নির্দিষ্ট দল বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এ প্রতিষ্ঠান হতে পারে পরিবার, সম্প্রদায়, ধর্ম কিংবা পেশাগত।
ব্যক্তি হিসেবে প্রতিটি মানুষ তার মানব অস্তিত্বের কারণেই মানবাধিকার পাওয়ার যোগ্য—এ ধারণাটি সাম্প্রতিক হলেও বহু পূর্ব থেকে প্রচলিত বিভিন্ন প্রথা ও ধর্মীয় অনুশাসনের মূলে এর অস্তিত্ব রয়েছে। মানবাধিকারের এই মূলমন্ত্রকে দুনিয়ার অধিকার হারানো মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত করতে যে কয়জন মহামানব সারা জীবন সংগ্রাম ও আন্দোলন করে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, তেমনি একজন ছিলেন কিংবদন্তি আফ্রো-আমেরিকান মানবাধিকারকর্মী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। ১৯২৯ সালের ১৫ জানুয়ারি আমেরিকার জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টা শহরে জন্মগ্রহণ করেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। আমেরিকার নাগরিক ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অহিংস আন্দোলনের জন্য ১৯৬৪ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। বর্ণবাদী আচরণের জন্য ১৯৫৫ সালে তিনি মন্টোগোমারি বাস বর্জনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনে তাঁর বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বক্তৃতাটি উপস্থাপন করেন। আমেরিকার ইতিহাসে যাকে এখনো শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী প্রেসিডেন্ট বলে সবাই জানেন, সেই জন এফ কেনেডির অনুরোধ উপেক্ষা করে দেওয়া ওই ভাষণে তিনি তুলে ধরেন শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্যমূলক আচরণ ও কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর নির্যাতন ও বঞ্চনার কথা। তিনি বললেন, ‘ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোনো প্রাপ্তি নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত “নিগ্রোরা” পুলিশের বর্ণনাতীত নির্যাতনের শিকার হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোনো প্রাপ্তি নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত না ভ্রমণ-ক্লান্ত কৃষ্ণাঙ্গরা শহরের হোটেল বা মোটেলে বিশ্রামের অধিকার পাবে। ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের প্রাপ্তি নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের শিশুরা “কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গদের জন্য” লেখা সাইনবোর্ড দেখবে। আমি জানি, তোমরা কেউ এসেছ দূর-দূরান্ত থেকে, কেউ জেলের কুঠরি থেকে, কেউ পুলিশের টর্চার সেল থেকে। তোমরা যার যার ঘরে ফিরে যাও। কিন্তু কাদাজলে ডুব দিয়ে থেকো না। হয়তো আজ বা আগামীকাল আমাদের জন্য সংকটময় হবে। তবুও আমি স্বপ্ন দেখি। এই স্বপ্নগাথা আছে আমেরিকার অস্তিত্বে। আমি স্বপ্ন দেখি, এক দিন এই জাতি জাগ্রত হবে এবং মানুষের এই বিশ্বাসের মূল্যায়ন করবে যে, সব মানুষ জন্মসূত্রে সমান।’
নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং এক অসামান্য ভাষণ দিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে আড়াই লক্ষ আমেরিকানের এক সমাবেশে। লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে দেওয়া সেই বিখ্যাত ভাষণ বিশ্বের সর্বকালের সেরা বাগ্মিতার দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এখনো। সেদিন সাদা-কালো সব ধর্মবর্ণের আমেরিকানই দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে এসে ওয়াশিংটনে সমবেত হয়েছিল। তাদের দাবি ছিল বর্ণবৈষম্যের অবসান। জন লুইস নামের ২৩ বছর বয়সের এক বন্ধু ছিলেন মহান নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের। সেদিনের ঐতিহাসিক সভার বর্ণনা দিতে গিয়ে জন লুইস বলেন, ‘সেদিন ভীষণ গরম পড়েছিল। আমি আমার ডানদিকে তাকিয়ে দেখলাম, মানুষ আর মানুষ-হাজারে হাজার। বাঁ দিকে দেখলাম শুধু মানুষ। অনেকেই খুবই তরুণ। বক্তাদের দেখার জন্য গাছের ডালে চড়ে বসেছে। সামনের দিকে তাকালাম, হাজার হাজার লোক। কেউ কেউ লেকের জলে নেমেছে একটু ঠান্ডা হওয়ার জন্য। সবার অপেক্ষা, কখন অনুষ্ঠান শুরু হবে।’
জন লুইসের নিজের শৈশবও কেটেছে বর্ণবৈষম্যের মধ্যে। অ্যালাবামায় বড় হয়ে ওঠা জন লুইসের এখনো মনে আছে একবার এক লাইব্রেরি থেকে তিনি বই ধার নিতে পারেননি শুধু কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে। শ্বেতাঙ্গ লাইব্রেরিয়ান বলেছিলেন, কালো চামড়ার লোকদের বই দেওয়া যাবে না। পরে ছাত্রদের অহিংস আন্দোলনের সমন্বয়কারী হয়েছিলেন তিনি। নাগরিক অধিকার আদায়ের ওই সংগঠনের কাজ ছিল তরুণদের অহিংস আন্দোলনের পন্থা শেখানো।
লুইসের ভাষ্য, ‘আমি জানতাম, যাদের সঙ্গে আমি কাজ করছি, তাদের সবার পক্ষ থেকে আমাকে কথা বলতে হবে। কথা বলতে হবে যারা মার খেয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে, জেল খেটেছে, যারা নিজের মুখে নিজেদের কথা বলতে পারেনি, যারা এই সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছে—তাদের হয়ে।’
সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি যে সিভিল রাইটস বিল প্রস্তাব করেছিলেন, তার সমালোচনা করা হয় ঐতিহাসিক সে সভায়। অনেক বক্তা প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানান আরও সাহসী হতে, যাতে মার্টিন লুথার কিংয়ের জোর সমর্থন ছিল। তাই বলেই হয়তো সে সভায় কিংয়ের প্রতিটি শব্দ ও বাক্যের মধ্যে ছিল অপরিসীম গতি ও বিশ্বাস, যা তাঁকে করেছিল জগৎ বিখ্যাত।
মার্টিন লুথার কিং সিনিয়র ও আলবার্টা উইলিয়ামস কিংয়ের ঘরে তাঁর জন্ম। আটলান্টায় বেড়ে ওঠা জুনিয়র বুকার টি ওয়াশিংটন হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে মোরহাউজ থেকে সমাজবিদ্যায় ব্যাচেলর অব আর্টস ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে করেটা স্কটকে বিয়ে করেন। তিনি গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৫৯ সালে গান্ধীর জন্মস্থান ভারত সফর করেন। ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে দারিদ্র্যমোচন ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতায় গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন। গরিব ও কৃষ্ণাঙ্গদের আর্থিক অধিকার আদায়ে ‘পুওর পিপলস আন্দোলন’ সংগঠিত করেন। প্রতিনিয়ত লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটনে দেওয়া বিখ্যাত ভাষণে মার্টিন লুথার কিং প্রায় ঐশী বাণীর মতো ভাষায় বর্ণনা করেছিলেন তাঁর কল্পনার আমেরিকাকে। কিভাবে বর্ণবৈষম্য গোটা জাতিকে ধ্বংস করছে; শুধু কালো আমেরিকানদের নয়, সবাইকে তা-ই তুলে ধরেছিলেন তিনি সেই ভাষণে। তিনি তুলে ধরেছিলেন ভবিষ্যতের আমেরিকা নিয়ে নিজের আশাবাদকে, যেখানে সব আমেরিকান হবে সমান, যারা গড়ে তুলবে সত্যিকারের স্বপ্নের আমেরিকা।
সারা জীবন কালো মানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার কিং জুনিয়ারের জীবনে নেমে এল সত্যিকারের কালো এক দিন। মার্টিন লুথার কিং মেমফিসের মেসন টেম্পলের দু হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ কর্মীদের প্রতি সমর্থন জানানোর উদ্দেশ্যে। ধর্মঘটকে উসকে দিতে নয়। ভাষণের প্রথম ১১ মিনিট চলমান ধর্মঘট নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। তবে ভাষণের শেষ অংশটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ‘আমাদের সামনে কঠিন সময় আসছে। কিন্তু আমাকে তা আর প্রভাবিত করে না। কারণ আমি পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করেছি এবং আমি আর কিছুই পরোয়া করি না’, উপস্থিত মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন কিং জুনিয়র।
এখানেই থামলেন না কিং জুনিয়র। আরও বললেন, ‘অন্য যে কারও মতো আমিও লম্বা সময় বাঁচতে চাই। জীবনের দৈর্ঘ্য মূল্যবান। কিন্তু সে বিষয়ে আর চিন্তিত নই আমি। আমি শুধু ঈশ্বরের ইচ্ছাপূরণ করতে চাই। আর তিনি আমাকে পর্বতারোহণের ক্ষমতা দিয়েছেন। আমি সেখান থেকেই প্রতিশ্রুত ভূমি দেখতে পেয়েছি। সেখানে হয়তো আপনাদের সঙ্গে যেতে পারব না। তবে আমি আপনাদের জানাতে চাই, আমরা একত্রিত হয়ে সেই প্রতিশ্রুত ভূমিতে যাব।’ সব শেষে বললেন, আজ আমি অত্যন্ত খুশি। আমি কোনো কিছু নিয়েই আর চিন্তিত নই। আমি আর কোনো মানুষের ভয় পাই না। আমি সৃষ্টিকর্তার আগমনীর জ্যোতি দেখেছি।’
এটিই ছিল মহান এই নেতার শেষ ভাষণ। পরদিন কিং জুনিয়র তাঁর হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ডান গালে গুলিবিদ্ধ হন। বুলেটটি তাঁর চোয়াল ভেঙে মেরুদণ্ডে আঘাত করে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল মার্টিন লুথার কিংয়ের জীবনের অবসান ঘটে।