সাংস্কৃতিক জোটের পথচলা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উৎসমূলে রয়েছে বাঙালি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের মৌলিকত্ব। বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলন তার অহংকার, তার আত্মপরিচয় ও জাতিসত্তা বিকাশের বাতিঘর। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সূচিত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গতিধারা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে, রূপান্তরিত হয়েছে স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশীদারে। বাংলার মুক্তিকামী মানুষের রাজনৈতিক দর্শনের শক্ত ভিত্তিও তৈরি হয়েছে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পটভূমি থেকে। সূত্রপাত ঘটেছে এক অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম নিরপেক্ষ,বৈষম্যহীন ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখার। অথচ আমাদের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিকে ফিরে তাকাতে গেলে একটি কথা স্মরণ করতেই হবে যে, বাংলাভাষা ও সাহিত্য জন্ম থেকেই ‘বিদ্রোহী’; কোনো দিনই এই ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমাজের উঁচু শ্রেণির কাছ থেকে সহজে মর্যাদা পায়নি। লড়াই করে তা প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সব মাধ্যমেই একটি বিষয় লক্ষণীয় যে সবকিছুকে ছাপিয়ে সেখানে বড় হয়ে উঠেছে বাস্তব জীবন, তার প্রতিবাদ, ক্ষোভ আর দ্রোহ। আর তাই আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি জীবনধর্মী।
’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শের ওপর যখন নেমে আসে একের পর এক আঘাত, সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকা মানুষ, স্বাধীনতা বিরোধী দানবদের তাণ্ডবে মানুষের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা—এমনই এক সময় ১৯৮৪ সালে শ্রদ্ধাভাজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারের হাত ধরেই গড়ে ওঠে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি, আলবদর, রাজাকার তথা মৌলবাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট হয়ে ওঠে প্রতিরোধের, প্রতিবাদের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
তারই ধারাবাহিকতায় উত্তর আমেরিকাতেও রামেন্দু মজুমদারের আগ্রহের প্রস্তাবনায় ১৯৯৮ সালে গড়ে ওঠে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। একদল তরুণ সংস্কৃতিকর্মী তাঁদের বিশ্বাস, আস্থা ও আদর্শের জায়গা থেকে প্রবাসে অভিবাসী বাঙালি সমাজ বিনির্মাণের সূচনালগ্নেই তাদের চিন্তা-চেতনা ও মনোজগতে পরিশুদ্ধ, সংস্কৃতি বিকাশের দায়িত্বটি পরম মমতায় নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন। প্রগতি ভাবনা ও আদর্শগত শুদ্ধতার পথে তাদের নিয়ে যেতে নিরন্তর কাজ করে চলেছে। দুই দশকের পথ পরিক্রমায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, উত্তর আমেরিকা অভিবাসী বাংলাদেশিদের প্রতিটি আন্দোলন, প্রতিবাদ-সংগ্রামে তা মৌলবাদের বিরুদ্ধে হোক, নারী সহিংসতার বিরুদ্ধে হোক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী হোক—সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে এসেছে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে। একাত্মতা ঘোষণা করেছে একই ভাবে বাংলাদেশের প্রগতিবিরোধী সব প্রতিবাদ-প্রতিরোধে। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে ১৩ ডিসেম্বর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে মোমবাতি প্রজ্বলনের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের আয়োজনটি গত ২০ বছর ধরে প্রবাসী বাঙালি হৃদয়-মনকে বারবার স্পর্শ করছে গভীর মর্মবেদনায়-অন্যদিকে প্রতিবাদে সংকল্পবদ্ধ হওয়ার শক্তি জুগিয়েছে অফুরান। হাড় কাঁপুনি শীত, ঝড়, বৃষ্টি ও প্রচণ্ড তুষারপাতকে উপেক্ষা করে মানুষ সমবেত হয়েছে জ্যাকসন হাইটসে। দেশ ছেড়ে আসা এসব মানুষের মনের গভীর কোণে প্রোথিত প্রচণ্ড দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধই গত বিশ বছর ধরে তাদের জোটের সব আয়োজনে নিয়ে এসেছে অংশীদার হতে।
জোট উত্তর আমেরিকার দুই দশকের বিস্তৃত সময়ে বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিশেষ দিনগুলোসহ জাতীয় দিবসগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছে। জোট প্রতিটি অনুষ্ঠানের ভাষাকে শিল্প রসোত্তীর্ণ করে বহু মাত্রিকতায় উপস্থাপন করেছে; যা শিল্প বোদ্ধাদের সপ্রংশসার নজর কেড়েছে শুরু থেকেই। শিল্পের আদি রসের শিল্পিত রূপ ও নান্দনিক সৌন্দর্যের গভীর সাধনা সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিটি আয়োজনে মূর্ত হয়ে উঠেছে। আর এভাবেই জোট প্রচলিত বৃত্তকে ভেঙে প্রগতির ধারায় সংযুক্ত হতে প্রবাসী বাঙালিকে সংগঠিত করার শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
গণমানুষের মুক্তি ও চিন্তার সম্মিলন ঘটাতে জোটের অনবদ্য আয়োজন পথ চলার অঙ্গীকার বাঙালির মনোজগতে আলোর সন্ধান দিয়েছে, চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে ও সংগ্রামী চেতনার উজ্জীবন ঘটিয়েছে-এ কথা বলা চলে নিঃসন্দেহে। আর এখানেই জোটের বিরাট সাফল্য, ব্যতিক্রমী চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য।
পরিশেষে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, জোট গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে এক প্রকার যুক্ত অথবা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। জন্মলগ্নেই জোটকে পড়তে হয়েছে জটিল সমস্যায়; মোকাবিলা করতে হয়েছে অপশক্তিকে। তারপর ২০ বছর ছুটে চলা এবং আজকের অবস্থানে পৌঁছার কাজটি কতটা কঠিন ও কষ্টসাধ্য ছিল তা-ও প্রত্যক্ষ করেছি প্রতিনিয়ত। আদর্শে অবিচল থেকে শক্ত হাতে জোটকে ধরে রাখার কাজটি যিনি অত্যন্ত নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও গভীর ভালোবাসায় সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সম্পূর্ণ করেছেন তিনি মিথুন আহমেদ। তাঁর সৃজনশীলতার বৈচিত্র্য ও নান্দনিক সৌন্দর্যময় আয়োজন সব সময়ই ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। বিশ বছর পূর্তিতে তাঁদের পথযাত্রায় মিথুন আহমেদসহ সবাইকে আমার অভিবাদন।