নিউইয়র্কে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ২০ বছর

বাংলাদেশের জনজীবনে সাংস্কৃতিক সামর্থ্য কখনো কখনো রাজনীতির চেয়ে বেশি। সংস্কৃতির এই সামর্থ্যের উৎস হয়তো বাঙালি জীবনের যাপনবৈশিষ্ট্যেই নিহিত। বাঙালির সাহিত্যই হোক বা হোক পরিবেশনকলা—সবকিছুরই মূলে রয়েছে গ্রামীণ জীবনযাত্রার ধরন। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাও এই উৎস থেকেই উৎসারিত। বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীরাও এরই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন। এ কথাও মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, আধুনিক বাঙালি রাজনীতিকেরাও তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছেন এই সংস্কৃতির উৎসমূল থেকেই! এর দৃষ্টান্ত আমরা প্রথম স্পষ্টভাবে পাই বাংলাদেশের মানুষের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্ন উত্থাপনের সময় থেকেই। স্মরণ করা যেতে পারে যে, চল্লিশের দশকে যখন পাকিস্তান আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল তখন লেখক-সাহিত্যিকদের মনেই প্রথম প্রশ্ন জেগেছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেন বাংলা হতে হবে? সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার আলোকেই পরে রাজনীতিকেরা বিষয়টিকে তাঁদের কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসেন।
ষাটের দশকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাবিরোধী রাজনীতির সময়েও সংস্কৃতিকর্মীরাই আগে মধ্যবিত্ত বাঙালি মনে জাতীয়তার বোধ জাগিয়ে তুলেছিল। পরে সাধারণ গ্রামীণজীবনে ধীরে ধীরে জন্ম নিয়েছে বাঙালির আধুনিক রাষ্ট্রবোধের আভাস। সুতরাং যদি বলা হয় যে, বাংলাদেশে সব সময়ই সাংস্কৃতিক কর্মীরা তাদের সংগ্রামী চেতনাকে অগ্রগামী রেখেছে তাহলে ভুল হবে না। কারণ রাষ্ট্রশক্তির নানা অমানবিকতার বিরুদ্ধে সংস্কৃতিকর্মীরাই সব সময় মানবিকতার ঝান্ডা উড়িয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর কালে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ওই সব অভিযাত্রার সব সময়ের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী না হলেও আমার পক্ষে তাকে অনুসরণ ও সমর্থন না করে থাকা সম্ভব হয়নি এ কারণেই!
নিয়তির পরিহাসে আমাকেও দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশত্যাগী হতে হয়েছে। নিউইয়র্কে এসে বাংলাদেশিদের ক্ষুদ্র জনসমাজেও অনুভব করেছি বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রামের তাৎপর্য! বাংলাদেশের বাইরে বসবাস করে, ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংগ্রামের অংশভাগী হওয়ার কী তাৎপর্য থাকতে পারে এমত প্রশ্ন আমারও মনে জেগেছিল! কিন্তু আমার যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকালের দৈর্ঘ্য যত বেড়েছে তত অনুভব করেছি এখানকার মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশি জনসমাজের অংশগ্রহণের অগ্রাধিকারের পাশাপাশি বাংলাদেশিদের সাংস্কৃতিক সংগ্রামেরও গুরুত্ব রয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে মুহূর্তের মধ্যে দেশের সব খবর বিদেশে থেকেই পাওয়া যায়। দেশের সব সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রার আস্বাদ নেওয়া যায় অনেকটাই। দেশের আনন্দবেদনায় উদ্বেলিত ও উৎকণ্ঠিত হওয়ার মধ্যেই তো দেশকে অন্তরে নিয়ে বেঁচে থাকা! ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেও আসলে এখন মনোজগতে বাংলাদেশ নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব। আবার এ কথাও আমরা অনুভব করি, ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের প্রতাপের মধ্যে থেকে সেই বাংলাদেশকেই অন্তরে ধারণ করে থাকা খুব কঠিন। কারণ, এটা পরীক্ষিত যে ভিন্ন পরিস্থিতিতে নিয়মিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের চর্চা না করলে কেবল প্রযুক্তিগত ভাবে যুক্ত থেকে কোনো সাংস্কৃতিক সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। তাই এখানকার বাস্তবতা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বাস্তবতা থেকে যে অনেক দূরে এই সমস্যার কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। কারণ ভিন্ন বাস্তবতার কারণে পদে পদে আমাদের ইতিহাসের বোধ থেকে বিচ্যুতির সম্ভাবনা দেখা দিতে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র বাসের অভিজ্ঞতার দৈর্ঘ্যের সঙ্গে এখানকার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার মাত্রা বেড়েছে। মনে হয়েছে, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক যে উৎসকে ধারণ করে আমরা বাঁচব সেই প্রশ্নেই এখানে সাংস্কৃতিক জোটের কর্মধারা চলমান। আরও উপলব্ধি করেছি, বর্তমান রচনার গোড়ায় যে বাঙালির সাংস্কৃতিক সামর্থ্যের কথা বলা হয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সেই সামর্থ্যেরই উচ্চায়ত রূপকে বহন করে চলে। এ জন্যেই নিউইয়র্কেও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সক্রিয়তা অনেক গুরুত্ব রাখে। বাংলাদেশের ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় সঞ্জীবিত চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বোধকে তাত্ত্বিক ভাবে নিয়ে বেঁচে থাকবার জন্য যুক্তরাষ্ট্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরণা যুগিয়ে চলেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নিউইয়র্ক। এই সূত্রেই যুক্তরাষ্ট্রবাসী বাঙালিদের আত্মপরিচয়ের সংকট মোচনের পক্ষেও জোট গভীর প্রভাব রেখে চলেছে! আর এ জন্যই এর চলমানতার অনুকূলে আমার সমর্থন থাকবে সব সময়!
সময়ের বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে জোট আরও গভীরভাবে বাঙালি সংস্কৃতির সূত্রগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে জাগিয়ে রাখুক এই কামনা করি এবং একই সঙ্গে শুভকামনা জানাই জোটের সংগঠক ও কর্মীদের সবাইকে।