তবু জেগে থেকো বাংলাদেশ

কেমন আছে বাংলাদেশ? কেমন আছে আপনজন? ২৭ ডিসেম্বর সুদূর আমেরিকা থেকে ছুটে গিয়েছিলাম দেশে, জন্মভিটায়। সকাল ১০টায় কাতার এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজ প্রিয় মাতৃভূমির মাটি ছুঁতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল মায়ের মুখ, তাঁর কবরের দৃশ্য। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে আবারও নভো এয়ারে করে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে। এরপর সোজা মায়ের কবরে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার মা নিজের হাতে মাটি খুঁড়ে একই গর্তে লুকিয়ে রেখেছিলেন এক হিন্দু পরিবারসহ আমাদের সবাইকে। তারপর কত বছর কেটে গেছে। এখনো যেন সেই দৃশ্য একইরকম জ্বলজ্বলে। জন্ম যন্ত্রণা পেরিয়ে এখন মধ্যবয়সে বাংলাদেশ। শির-দাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ৪৮ বছরের যাত্রার বাঁকে বাঁকে আছে হাজারো উত্থান-পতনের গল্প। গ্রাম থেকে শহরে সব-মানুষের মুখে এক সুর ‘ছোটদের-বড়দের সকলের/ আমারই দেশ/ সব মানুষের।’ কিন্তু সব মানুষের কী হয়েছে এই বাংলাদেশ। এই স্বপ্নের দরজায় কী আমরা দাঁড়াতে পেরেছি। এই ভাবনায় এসে থমকে দাঁড়াতে হলো আমাকে, যখন দেখি এক শ্রেণির মানুষের রয়েছে সম্পদের পাহাড়, যা এমনকি উত্তাল বঙ্গোপসাগরের সুউচ্চ ঢেউকেও থমকে দিতে পারবে হয়তো। অন্যদিকে কাতারে কাতার রুগ্‌ণ মানুষ। ছোট্ট দেশ; নানা প্রতিকূলতা, অন্তহীন সমস্যা, অন্তরালে চলা সীমাহীন দুর্নীতি; ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। এ যেন এক ‘কূলহারা ঢেউয়ের সাগর’, যা পাড়ি দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এত কিছুর পরও আমাদের বাংলাদেশিদের কাছে এ দেশ এক অনন্য ভূমি।
তারপরও গত দশ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক নেতৃত্বে বিশ্বের বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত দরিদ্রতম দেশটির জন্য বিস্ময়কর কাজ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর মনোবলই তাঁর একমাত্র সহায় হয়েছে। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বিরোধী পক্ষ, নাগরিক সমাজ কিংবা বেসরকারি সংস্থা যা খুশি বলুক, আমি পরোয়া করি না। আমি আমার দেশকে জানি। আমি জানি কীভাবে আমার দেশকে উন্নত করতে হবে।’ এই একরোখা মনোভাবের সরাসরি প্রভাব পড়েছে এবারের ২০১৮ সংসদ নির্বাচনে। মোট ৩০০ আসনের ২৮৮টিতে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছেন তিনি।
হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এ বাঙালি জাতির রয়েছে নানা ঐতিহ্য-উৎসব। ঈদ-পূজা-পার্বণ কিংবা বাংলা নববর্ষের সর্বজনীন উৎসবে সবাই যেন একসঙ্গে একই পথে এসে মিলিত হয়। নির্বাচনও এ দেশে এক উৎসবই। কিন্তু এ নির্বাচনে এবার কেন যেন ভিন্ন এক আমেজ চোখে পড়ছে। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানহাট-কদমতলী, আগ্রাবাদের বেশ কিছু কেন্দ্র ঘুরে দেখার সুযোগ হলো। এসব এলাকায় শান্তিপ্রিয় স্থানীয় লোকজনই ভোটার। ভোট কেন্দ্রের (পোস্তারপাড় বালক উচ্চ বিদ্যালয়) দিকে এগোতেই অপরিচিত এক যুবক বললেন, ‘বদ্দা ইক্কা ন যাইওন (ভাই ওদিকে যাবেন না)। কারণ জানতে না চেয়েই বরং একধাপ এগিয়ে গেলাম। কেন্দ্রের সামনে শ খানেক উঠতি বয়সের কিছু তরুণ, যাদের অধিকাংশই ভোটার নয় বলে আমার মনে হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজন আমাকে ভোটকেন্দ্রের দিকে নিয়ে গেল। ইভিএম পদ্ধতিতে প্রথম ধাপ পার করে বুথের দিকে চোখ যাওয়া মাত্র দেখলাম বুথের ভেতরে দুজনের একজন বলে উঠলেন, ‘বদ্দা অনের ভোট অ্যাঁরা দি (ভাই, আপনার ভোট আমরা দিয়েছি)। নির্বাক হয়ে ভোট কেন্দ্র থেকে বেরোনোর সময় একজন পরিচিত দৌড়ে এসে চুপিসারে আমাকে বললেন, ‘ভুলে আপনার ভোট আগে দিয়ে ফেলেছি।’ সে মুহূর্তে গণতন্ত্র-স্বাধীনতা শব্দগুলো ফিকে মনে হলো আমার কাছে। মনে হলো এটি কথিত ‘হু কেয়ার্স’ ধাঁচের ‘ফ্রি-স্টাইল ইলেকশন’! আবার নিজের অজান্তে ভাবলাম কী নেই বাংলাদেশে? সব আছে। এই সব নিয়ে নীরবে-নিভৃতে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ তুমি জেগে থেকো। আমার মায়ের কবরে কামিনী ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে তুমি ছুটে চলো দূর-বহু দূরে।