এরপর কি?

বাংলাদেশে যাব চার সপ্তাহের জন্য। সস্তায় টিকিট পাওয়ার আশায় সোমবার গিয়েছিলাম ওজোন পার্কের গ্লোবাল ট্রাভেলসে। মোহাম্মদ আলিম গত এপ্রিলে আমি ও আমার স্ত্রীকে সুলভে বাংলাদেশ ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এবার কিন্তু তা হলো না। দাম অনেক চড়া।
ট্রাভেলসে বসে আলিমের সঙ্গে গল্প করছি। সঙ্গে আছেন প্রিয়ভাজন সাংবাদিক মিসবাহ উদ্দিন। এ সময় এলেন অধ্যাপক মাওলানা মুহিবুর রহমান। বেশ কয়েক বছর পর দেখা। দেখলাম, বয়স তাঁকে কাবু করতে পারেনি, আমাকে যেমনটা করেছে। স্থানীয় পত্রপত্রিকায় আগে তিনি নিয়মিত লিখতেন। দুই ঈদসহ সব ধর্মীয় দিবসে আমরা তাঁর লেখা চেয়ে নিতাম। আমরা দুজন পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করলাম। বললেন, তাঁর বিভিন্ন রচনা নিয়ে একটি বই বেরিয়েছে। আমার জন্য একটি কপি পাঠিয়ে দেবেন। কিছুদিন আগে জেরুজালেমে আল–আকসা মসজিদে গিয়েছিলেন। এ উপলক্ষে ইসরায়েলকে দেখার সুযোগ মিলেছে। ভ্রমণ করেছেন প্রাচীন সভ্যতার দেশ মিশর। এ নিয়ে বই লেখার ইচ্ছা আছে। আরও জানালেন, অস্ট্রেলিয়া সফরের কথাও।
মাওলানা মুহিবুর রহমান ‘মদিনা‘ নামে একটি সাময়িকী বের করতেন। এখন এর প্রকাশনা চোখে পড়ে না। তিনি সন্তোষে মাওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। মাওলানা ভাসানীর নামাজে জানাজায় তিনি ইমামতি করেছেন। ওই সব দিনের স্মৃতি নিয়ে বই লেখার ইচ্ছার কথা জানালেন।
প্রসঙ্গ এল আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে। আমি আমার মুঠোফোনটি দেখিয়ে বললাম, এক মাস হয় এই স্মার্ট ফোনটি পেয়েছি। সারা দুনিয়ার খবর এই ছোট্ট কৌটায় পাওয়া যায়। শুধু কি তাই! এই মুঠোফোনে কথা বলা, ছবি দেখা, ছবি তোলা, ভিডিও করা, কম্পোজ, ইমেইল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, অ্যালার্ম ঘড়ি, ক্যালেন্ডার, নাটক-মুভি দেখা, গান শোনা, পত্রিকা পড়া, জিপিএস সহ কি না করা যায়! পত্রিকা কিনে পড়ার সংখ্যা এখন কমে গেছে।
আমার কথায় সায় দিয়ে মাওলানা রহমান বললেন, হ্যাঁ, আমারও একটা এই জাতীয় ফোন আছে। প্রথমদিকে একটু–আধটু অসুবিধে হলেও এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বললেন, জানেন? সম্প্রতি আমি একটি হাদিসের খোঁজ পেয়েছি, যাতে বর্তমান এই প্রযুক্তির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ওই আলাপের সময় হাদিসটি লিখে আনার কথা ভাবিনি। লিখে আনলে এখানে উদ্ধৃত করতে পারতাম।
এবার ইচ্ছা ছিল নির্বাচনোত্তর বাংলাদেশ নিয়ে লিখব। গত রোববার ফোন করে পেয়ে গেলাম মোমেন ভাইকে (ড. এ কে আবদুল মোমেন)। কিছুক্ষণ আগে নতুন মন্ত্রিসভা ঘোষণা করা হয়েছে। মোমেন ভাই হয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানালাম। আমরা নিউইয়র্ক বা আমেরিকাবাসীরা মোমেন ভাইকে নিজেদেরই একজন হিসেবে ভাবি। তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে আমাদের সঙ্গে। আমেরিকায় ফোবানার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। আমরা খুশি হয়েছি এই নিয়োগে।
খবরে দেখলাম, বাংলাদেশে এক নতুন মন্ত্রী তাঁর অফিস ঝাড়ু দিচ্ছেন, অপর এক মন্ত্রী মোটরসাইকেলে চড়ে যাচ্ছেন তাঁর কর্মস্থলে। এতে আরও উৎসাহিত হলাম, এবার এসব নিয়েই লিখি। মনে পড়ল, এরশাদ আমলে এক মন্ত্রী ছিলেন, আমাদেরই জ্যেষ্ঠ সহকর্মী, ‘ঝাড়ুদার’ মন্ত্রী হিসেবে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিল।
কিন্তু লেখা হলো না। মাওলানা রহমানের সঙ্গে আলাপের পর ঠিক করলাম, ওই আলাপের রেশ টেনে আরও কিছু কথা বলি।
কল্প কাহিনি কী করে যে বাস্তব হয়ে যায়, আজকালকার নতুন নতুন আবিষ্কার তারই জানান দিয়ে যায়। আমাদের প্রায়শ লিখতে হয়-‘গল্প নয় সত্য’। ফিকশন নয়, রিয়্যালিটি।
আমার মনে পড়ে, ঊনসত্তর সালের কথা। অ্যাপোলো ১১ নিয়ে নেইল আর্মস্ট্রং ও এডউইন অলড্রিন চাঁদের বুকে প্রথম পা রাখলেন। মানুষের চন্দ্র বিজয়ের দিনে সারা দুনিয়া মাতোয়ারা, আমরাও। ওই সময় ধর্মানুরাগী কারও কারও মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ কাজ করছিল। চন্দ্র বিজয়ে কি সীমা লঙ্ঘন হলো? মোগলাবাজারে আমাদের গ্রামেই বাড়ি মাওলানা কুতুব উদ্দিনের। তিনি রেঙ্গা মাদ্রাসার শিক্ষক। কলকাতা থেকে টাইটেল পাশ। তাঁকে ‘ভাইছাব’ (ভাইসাহেব) বলে ডাকতাম। জিজ্ঞেস করলাম, মানুষের চাঁদে যাওয়ার বিষয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি কীভাবে দেখছেন। বললেন, চাঁদে মানুষ যেতে পারবে, ধর্মীয়ভাবে এতে আপত্তি বা বাধার কিছু নেই। অবশ্য পরে একটি বাক্য জুড়ে দিয়েছিলেন তিনি, তবে ওরা (নেইল আর্মস্ট্রং ও এডউইন অলড্রিন) চাঁদে গিয়েছে কিনা, তার প্রমাণ আমার কাছে নেই।
তিয়াত্তর সালে সিলেটের যুগভেরীতে সাংবাদিক হিসেবে আমার কর্মজীবন শুরু। কাঠের টাইপে হেডিং ও সিসার অক্ষরে কম্পোজ করে আমরা পত্রিকা বের করতাম। আর এখন? সেদিন প্রথম আলো অফিসে ইব্রাহীম চৌধুরী আমার হাতে লেখা একটি স্ক্রিপ্ট কম্পিউটারের স্ক্রিনের সামনে বসে শুধু পড়ে গেল, এদিকে ওটি পুরো কম্পোজ হয়ে গেল। বাহ, কী চমৎকার আবিষ্কার। জানলাম, ইংরেজি ভাষায় এই কম্পোজ অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে।
১৯৯০ সালে আমরা নিউইয়র্কে যখন পত্রিকা (ঠিকানা) বের করা শুরু করি, সে সময়ের প্রযুক্তি ও বর্তমান অবস্থার মধ্যে অনেক ফারাক। ওই সময় লেখা ও ছবি পেস্ট করে পাতা তৈরি করে ছাপা কারখানায় গিয়ে দিয়ে আসতে হতো। আর এখন? কম্পিউটারেই সব পাতা তৈরি হয়ে যায়। তারপর ইন্টারনেটে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ছাপাখানায়। নিউইয়র্কের কয়েকটি পত্রিকা এখন তৈরি হয় ঢাকায়। ওখানে সব রেডি করে ইন্টারনেটে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিউইয়র্কের ছাপাখানায়। এখানে ছাপার পর বিতরণ করা হয় চারদিকে। আমি সাংবাদিকদের আড্ডায় মাঝে-মধ্যে বলে থাকি, ইন্টারনেট সুবিধা থাকলে এখন বাংলাদেশের গহিন কোনো গ্রামে বসেও নিউইয়র্কের পত্রিকা বের করা যায়।
এখন দেশে-বিদেশে প্রিন্টিং গণমাধ্যমের দুর্দশার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই নিউইয়র্কেই কয়েকটি প্রেস বন্ধ হওয়ার পথে বলে শুনে আসছি।
৩০ বছর আগে যখন নিউইয়র্কে আসি, দেশে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার জন্য উদ্‌গ্রীব থাকতাম। এক দেশ থেকে আরেক দেশে ফোনকল ছিল ব্যয়বহুল। টিঅ্যান্ডটি বা এরূপ কোম্পানির ফোনে লং ডিসট্যান্স কথা বললে প্রতি মিনিটে তিন/চার ডলার চার্জ করা হতো। সে সময় ম্যানহাটনের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের ফোন বুথে দেখতাম মানুষের ভিড়। শুনতাম, ওখানে নাকি সস্তায় কথা বলা যেত। কীভাবে তা সম্ভব হতো জানি না। আমি কখনো এ সুবিধা ভোগ করিনি। কেউ কেউ বলতেন, ওই বুথগুলোতে এক শ্রেণির লোক নাকি দুই নম্বরী কাজে লিপ্ত ছিল। আমি আমার বাসা থেকে চড়া মূল্যেই কথা বলতাম দেশে।
আর এখন? স্মার্ট ফোনে মেসেঞ্জারে বলতে গেলে নামমাত্র মূল্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলছেন অধিকাংশই। শুধু কি কথা? কথার সঙ্গে ছবিও। এখানে বসেই আপনি দেখতে পাচ্ছেন দেশে আপনার বাড়িতে এই মুহূর্তে কী রান্না হচ্ছে অথবা কে কী করছেন, কেমন আছেন-সবকিছু। একইভাবে ওপার থেকেও আপনার সবকিছু দেখতে ও শুনতে পাচ্ছেন আত্মীয়রা। এ অভাবনীয় কাণ্ডের জন্য শুধু দরকার দুপাশে দুটি স্মার্টফোন। এই মুঠোফোন যেন আলাদিনের চেরাগকেও হার মানাচ্ছে। আলাদিনের চেরাগে ঘষা দিলে একটি দৈত্য বেরিয়ে আসে, আর এ মুঠোফোনের চেরাগে ঘষা দিলে বেরিয়ে আসে ডজন ডজন দৈত্য! এরপর কি? কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!
আগে অথবা এখনো ফুড ডেলিভারি দেওয়া হয় সাইকেলে চড়ে বা গাড়িতে করে। খবরে দেখলাম, এখন ড্রোন দেবে এই সেবা। আপনি অর্ডার করলে পিৎজা অথবা গাঁজা আপনার দুয়ারে পৌঁছে দেবে ড্রোন।
হলিউডের সিনেমার অনেক কদর। অনেক আবিষ্কারের আগাম বার্তা পাওয়া যায় তাদের সিনেমায়। আজ যা ফিকশন বা কল্পকাহিনি, কাল-পরশু বা তারও পরে তাই বাস্তব রূপে ধরা দেয়। ভবিষ্যতে কী আসছে, হলিউড যেন আগেই বলে দিচ্ছে। স্টার-ট্রেকের মুভিতো আছেই, আরও আছে অনেক কল্পকাহিনি। ইনভিজিবল চরিত্র নিয়ে হলিউডের সিনেমার বাস্তব রূপ পেতে যাচ্ছে। অনেক আগের খবর, গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষকে অদৃশ্য করা সম্ভব। আমেরিকার সামরিক বাহিনীতে ইনভিজিবল ইউনিট গঠনের কথাও ওই খবরে শুনেছিলাম। এখন যে মোটরকার রাস্তায় চলছে, এক সময় যদি তা আকাশ ছেয়ে যায়, কেমন দেখাবে তখন? হ্যাঁ, সিনেমার এমন কাল্পনিক দৃশ্য এক সময় হয়তো বাস্তবে দেখা যাবে। ট্যাক্সি আকাশে উড়ে এসে উঁচু ভবনের কোনো এক অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় এসে দাঁড়াল। আবার ওখান থেকে উড়াল দিল অন্য কোনো গন্তব্যে।
সেদিন পারিবারিক আড্ডায় এক আত্মীয় তথ্য পরিবেশন করলেন, তিনি খবরে জেনেছেন, আগামী এক শ বছরের মধ্যে এমন রোবট তৈরি করা সম্ভব হবে, যা মানুষের মতো চিন্তা করতে পারবে। আড্ডায় আরেক আত্মীয় অংশ নিয়ে বললেন, হয়তো সম্ভব। এক সময় শুনেছি, একজন মানুষের মস্তিষ্কের সমান বা অনুরূপ কাজ করতে হলে যে পরিমাণ কম্পিউটারের প্রয়োজন পড়বে তা পর পর সাজালে দুই মাইল জায়গা জুড়ে যাবে। আরও শুনেছি, মানুষের মস্তিষ্কের পুরোটা নয়, গড়ে মাত্র ২৫ শতাংশ নাকি কাজ করে থাকে। আল্লাহর অশেষ করুণা!
ওই আত্মীয় আরও যোগ করলেন, আগামী এক শ বছরে মানুষের মস্তিষ্ক সমতুল্য রোবট তৈরি সম্ভব হলেও সে মস্তিষ্ককে নির্দেশনা দেবে কে? মস্তিষ্ক বা ব্রেন মানুষকে চালায়, আর এই মস্তিষ্ককে নির্দেশ করে আত্মা বা রুহ। এই আত্মা আসবে কোথা থেকে?
আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতার জন্য এ আলোচনা আর এগোয়নি।
তবে আমার মনে পড়ল দুটি বিতর্কের কথা। ইউটিউবে প্রায়ই এ নিয়ে প্রোগ্রাম চোখে পড়ে।
এক, মানুষ চাঁদে যায়নি, যা দেখানো হয় তা কৃত্রিম চাঁদ, এগুলো সব নাসার বানানো গল্প! দুই, এই পৃথিবীটা সমান্তরাল অর্থাৎ ফ্ল্যাট। গোল নয়। এর পক্ষে নানা যুক্তি-তর্ক পেশ করা হয়।
আমার এক আত্মীয় এসব বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। একদিন আমাকে বোঝাতে আসলেন। আমি বললাম, মহাশূন্যে যাত্রা প্রথম শুরু করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরে তাদের পেছনে ফেলে আগে চাঁদে পৌঁছে যায় আমেরিকা। যদি চাঁদে যাওয়াটা ভুয়া হতো, তা হলে সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথমে তা তুলে ধরতো। ওরা তা না করে বরং চন্দ্র বিজয়ের স্বীকৃতি দিয়েছে। দুই, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন প্রতিদিন পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছে। গোল না হলে ওরাই তো বলত। ওখানে তো বিভিন্ন দেশের নভোচারীরাই আছেন।
আমার কথা শুনে আত্মীয়টি থমকে গেলেন।
আমি বললাম, পড়াশোনা, এসব তর্ক-বিতর্ক দেখা ভালো। তবে হুট করে কোনো সিদ্ধান্তে আসা ভালো নয়। আত্মীয়টি বললেন, মনে হয় আপনিই ঠিক।
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।