এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং

বাংলা করলে এই ভবনের নাম যেমন দাঁড়ায় ‘সাম্রাজ্য রাজ্য ভবন’। এই ভবনের নাম সব দেশের নিজস্ব ভাষায় অনুবাদ করা গেলেও পৃথিবী জুড়ে এটা ‘দ্য এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং’ নামেই পরিচিত। নিউইয়র্ক শহরে টুইন টাওয়ার বা আজকের ফ্রিডম টাওয়ারের নাম সর্বোচ্চ ভবন হিসেবে যতই উচ্চারিত হোক না কেন, এ শহরের আভিজাত্য রাজা–বাদশাহের মতো মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ভবন। ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের মধ্য ম্যানহাটনে গিয়ে চারিদিক থেকে তাকালে দেখা যাবে কোন না কোন কোণ থেকে পর্যটকদের ক্যামেরা সেদিকে তাক করেই ক্লিক করছে। সাবওয়ে থেকে বের হয়ে যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, পথচারীকে বাধ্য করে মাথা উঁচিয়ে এই আকাশছোঁয়া ভবন দেখে নিতে। আলো-আঁধারি রঙের খেলা এর অনন্য এক বৈশিষ্ট্য, যা অনেক কিছুকে ধারণ করে।
দ্য এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং গড়ে ওঠার কাহিনি যেমন চমকপ্রদ, তেমন মজার। সব বিস্তারিতভাবে লিখতে গেলে রীতিমতো একটা বই লেখা যাবে। বাচ্চাদের প্রতিযোগিতার মতো, ‘তুমি আমার থেকে বেশি লম্বা হতে পারবে না, আমি লম্বা’—অনেকটা এ রকম। বিভিন্ন সময় রাতে যে রং বদলায়, তাও খুব তাৎপর্যময়। না জানলে তা বোঝা যাবে না। তবে না জানলেও বোকার মতো দূর থেকে অপলক চেয়ে থাকার মধ্যেও আনন্দ আছে। একটি সন্তানের জন্মের সঙ্গে যেমন একজন মায়ের আনন্দবেদনা জড়িত, তেমনি পৃথিবীর প্রতিটি সুন্দর সৃষ্টির পেছনে রয়েছে কারও অশ্রু, কারও মৃত্যু, কারও ব্যর্থতা, কারও সাফল্য, কারও ঘৃণা, অথবা কারও ভালোবাসা। তবে ভালোবাসাই বেশি, নতুবা এমন সাম্রাজ্য গড়া যেত না।
মূলত ১০২ তলার আকাশগঙ্গাটি গড়ে উঠেছিল উচ্চতর ভবনের প্রতিযোগিতা নিয়ে। ১৯২০ এর দশকের শেষ দিকে নিউইয়র্কের অর্থনীতি তখনো তেমন ভালো নয়, ভবন নির্মাতারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভবন স্থাপন করতে পাগলপ্রায়। মূলত ৪০ ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংক অফ ম্যানহাটন বিল্ডিং ও ক্রিসলার বিল্ডিংয়ের সঙ্গে ছিল তখন এই প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে যেমন ছিল একটি প্রধান আর্টডিকো গঠন, যা মূলত মোগুল ওয়াল্টার ক্রিসলার দ্বারা ‘আমার স্মৃতিস্তম্ভ’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। প্রধানত এই দুটি ভবন প্রতিযোগিতামূলকভাবে তাদের নকশাতে আরও মেঝে যোগ করে একে অপরের চেয়ে সেরা করার চেষ্টা করেছিল এবং ১৯২৯ সালের আগস্ট মাসে এই ভবনের মালিকেরা রীতিমতো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, যখন জেনারেল মটরসের নির্বাহী জন জে রস্কব এবং নিউইয়র্কের গভর্নর আল স্মিথ সাম্রাজ্যের রাজ্য বিল্ডিংয়ের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন।
এম্পায়ার স্টেট ভবন ১০০০ ফুট উঁচু হবে শোনার পর ক্রিসলার তাঁর চূড়ান্ত পরিকল্পনা পরিবর্তন করে তার শীর্ষস্থানে প্যাঁচানো স্টেইনলেস স্টিল সংযুক্ত করে। উপরন্তু, ক্রিসলার বিল্ডিং ১ হাজার ৪৮ ফুট রেকর্ডে উঠেছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ক্রিসলার, রস্কব ও স্মিথ সহজেই এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের জন্য লম্বা নকশা নিয়ে আবার ফিরে আসেন। ১৯৩১ সালে সম্পন্ন হয় কলসাস মিড টাউন ম্যানহাটনের রাস্তায় ১ হাজার ২৫০ ফুট উঁচু ভবন। ১৯৭৯ সালে প্রথম বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র টাওয়ার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটি প্রায় ৪০ বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা বিল্ডিং ছিল। আবার যখন ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ভেঙে পড়ে তখন এটিই ছিল ২০১২ পর্যন্ত নিউইয়র্কের সর্বোচ্চ আকাশগঙ্গা।
প্রকল্পের বিশাল আকার সত্ত্বেও এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের নকশা, পরিকল্পনা ও নির্মাণ শুরু হতে মাত্র ২০ মাস লেগেছিল। শ্রিভ, ল্যাম্ব এবং হার্মন মিলে এটির নকশা করেন। এর উচ্চতা ১ হাজার ২৫০ ফুট (৩৮০মিটার) এবং অ্যানটেনাসহ মোট উচ্চতা ১ হাজার ৪৪৫ ফুট (৪৪৩.২ মিটার)। ২০১৭ সালের মধ্যে এই ভবন আমেরিকার পঞ্চম উঁচু ভবন, বিশ্বের ২8তম উঁচু ভবন হিসেবে খ্যাতি পায়। ওয়ালডর্ফ-অ্যাস্টোরিয়া হোটেল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্লটটির ঠিকাদার স্টারেট ব্রাদার্স এবং একেন ৪১০ দিনের মধ্যে এই ভবন নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা করেন এবং প্রতিদিন ৩ হাজার ৪০০ পুরুষ কর্মী নিয়োগ করে রেকর্ড গতিতে কাজ করছেন। ভূমি মেঝের কিছু বিবরণ চূড়ান্ত হওয়ার আগেই প্রথম ৩০ তলা শেষ হয়। ভবনটি সময়ের আগে এবং নির্ধারিত বাজেটে শেষ হয়েছিল। এই ভবন নির্মাণকালে কমপক্ষে পাঁচজন শ্রমিক নিহত হন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালের ২8 জুলাই নিউইয়র্কের লা গোয়ার্ডিয়া বিমানবন্দরে একটি সেনাবিমান বি-২৫ বোমা উড়ানোর সময় আর্মি লে. কর্নেল উইলিয়াম এফ স্মিথ ঘন কুয়াশার জন্য বিরক্ত হয়ে মধ্য ম্যানহাটনের দিকে অগ্রসর হন এবং ২০০ মাইল বেগে তিনি এর ৭৮ ও ৭৯ তলায় আঘাত করেন। এই দুর্ঘটনায় একটি বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে এবং ভবনের ভেতরের অভ্যন্তরে ধ্বংসাবশেষ ছিটকে পড়ে। এতে স্মিথ ও দুই ক্রুমেনসহ ভবনটির ১১ জন জন নিহত হন। বোমা বিস্ফোরণের সময় বি-২৫–এর যন্ত্রপাতির কয়েকটি টুকরা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের ফাটলে একটি লিফট শাফ্টে আটকে ছিল যার মধ্যে ছিলেন ১৯ বছর বয়সী লিফট অপারেটর বেটি ল্যু অলিভার। ৭৫তম তলা থেকে লিফটটি ছিটকে পড়লেও সৌভাগ্যক্রমে অলিভার বেঁচে যান। তবে ঘাড় ও মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত পান।
এ রকম বহুল আলোচিত বিষয় আছে যা মনোযোগ কাড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন সিনেমা নির্মাণকাজে এ ভবনটি ব্যবহৃত হয়। প্রায় ৯০টি সিনেমার মধ্য কিং কং সিনেমায় এর ব্যবহার ও সাফল্য ছিল উল্লেখ্যযোগ্য। ফিল্মের ৫০তম বার্ষিকীতে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের সঙ্গে একটি নকল কিং কং সংযুক্ত করা হয়েছিল। প্রতিদিন লাখো পর্যটকের কাছে এখনো এক বিস্ময়। এতে প্রতিফলিত আলোকছটার রং বদল আমেরিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন ডা. মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সম্মানে ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি রং হচ্ছে লাল, কালো এবং সবুজ। প্রাথমিক অবস্থায় এটি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত প্রকল্প হিসেবে থাকলেও পরে এটি হয়ে ওঠে একটা বাণিজ্যিকভাবে সফল প্রকল্প এবং এখনো প্রতিদিন এটির আয় লাখো ডলার ছাড়িয়ে যায়।