২৮ জনকে একসঙ্গে গুলি

[মুক্তিযুদ্ধের গল্পের কি শেষ আছে? যুদ্ধ মানেই এক সাগর রক্তের ইতিহাস। যুদ্ধ মানেই প্রিয় মানুষের হারানো ব্যথার কাহিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় অর্ধশত বছর পরও যুদ্ধের সেই ক্ষত নিয়ে আমাদের অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সেই বেদনার দাগ কোনোভাবেই মোছার নয়। প্রদীপ সাহা বর্তমানে নিউইয়র্কে থাকেন। তিনি নিউইয়র্কে বাঙালি জনসমাজের জনপ্রিয় মুখ এবং ডট নেট প্রেসের মালিক। ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধকে তিনি দেখেছিলেন একজন বালকের চোখ দিয়ে। যুদ্ধ কী তা তিনি তখন বুঝতেন না। শুধু এটুকুই বুঝতেন, যুদ্ধ মানেই প্রতিবাদ, যুদ্ধ মানেই প্রতিরোধ আর যুদ্ধ মানেই নিজ বাড়ি ফেলে অজানা–অচেনা কোন শহরের দিকে নিরন্তর ছুটে চলা। সেই ছুটে চলা পথে তিনি দেখেছেন যুদ্ধের নৃশংস চেহারা। মানুষের মতো দেখতে কিছু পাকিস্তানি হায়েনার মুখ। সেই বালকের চোখ দিয়ে তিনি বড়দের যুদ্ধ দেখতে পেয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কথাই বলছেন প্রদীপ সাহা]

গল্প-৯
গুনে গুনে ২৮টি গুলি
মার্চ মাসের ২৫ তারিখেই আমাদের এলাকায় গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। এদিক থেকে, ওদিক থেকে গুলির শব্দ কানে আসছে। আমি তখন ছোট। বয়স ৬ বছর। যুদ্ধ তেমন বুঝি না। তবে বেশ বুঝতে পারি, খারাপ কিছু একটা হতে যাচ্ছে। বাবাকেও এই নিয়ে সব সময় চিন্তাযুক্ত দেখতে পেতাম। আশপাশের অনেকেই নিজেদের বাড়ি ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা আঁটছে। কিন্তু আমরা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না, এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকি। আমাদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে। আমি তখন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে যুদ্ধ দেখি। দেখি সিরাজ কাকা, আমিনুর কাকারা ২ নম্বর রেলগেটের রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে। আমিও তাদের সঙ্গে হাত লাগাই। সেনাবাহিনী এই ২ নম্বর রেলগেট রাস্তা দিয়েই ফতুল্লা হয়ে নারায়ণগঞ্জে ঢুকতে পারবে। তাই যেভাবেই হোক রাস্তা বন্ধ করতে হবে।
একদিন আমাদের এক মামা, নাম হারাধন পোদ্দার ছাদ থেকে দেখতে পেলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ফতুল্লা পর্যন্ত চলে এসেছে। এই ভয়াবহ কথাটা আমাদের সবার কানে আসল! মিলিটারি নারায়ণগঞ্জেও চলে এসেছে! তখন আমরা কেউই আর নারায়ণগঞ্জে থাকাটা নিরাপদ মনে করলাম না। আমার বাবার নাম স্বদেশ চন্দ্র সাহা। নারায়ণগঞ্জে আমার বাবা ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল প্রাইম টেক্সটাইল। মনে আছে, সম্ভবত ২৬ মার্চের পর কোন একদিন আমাদের ম্যানেজার হরি মামা আমাকে রাস্তা থেকে ডেকে বাড়ি নিয়ে এলেন। আমার বয়স তখন কম। রাস্তায় ঘুরে বেড়াই, খেলাধুলা করি। কিন্তু হরি মামার হঠাৎ এভাবে ধরে আনায় বুঝতে পারছিলাম, দেশে কিছু একটা হতে যাচ্ছে। বাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গেই মা আমাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে বললেন। আমি বললাম জুতা পরি? মা বললেন, না স্যান্ডেল পর। আমি স্যান্ডেল পরে তৈরি হলাম। তারপর একটা নৌকা ভাড়া করে বাবা-মা সবার সঙ্গে চলে গেলাম বিক্রমপুরের আবদুল্লাহপুরে। সেখানে এক পুরোনো রাজবাড়িতে আমরা থাকতে শুরু করি। তখন মে মাস। প্রায় দুই মাস আমরা আবদুল্লাহপুরে ছিলাম। দেশে মুক্তিযুদ্ধ তখন চারদিক ছড়িয়ে পড়েছে। বাবা আবদুল্লাহপুরে খুব বেশি দিন থাকাটা নিরাপদ মনে করলেন না। আমরা তখন আবার আবদুল্লাহপুর থেকে চাঁদপুরে আমাদের পিতৃভিটায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। কারণ বাবা তখন খবর পেয়েছেন, পাকিস্তানি বাহিনী এদিকেও চলে আসছে।
মনে আছে, খুব ভোরে বাবা একটা লঞ্চ ভাড়া করে নিয়ে আসলেন। লঞ্চে আমাদের সব আত্মীয়স্বজনদের তোলা হলো। তারপর লঞ্চ ছাড়ল চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে। লঞ্চ চাঁদপুর যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখি ঘাটে প্রচুর মানুষ। লঞ্চ আসতে দেখে সবাই লঞ্চে ওঠার জন্য পাগল হয়ে গেল। আমরা লঞ্চ থেকে নারায়ণপুরের মাচ্ছাখালি নেমে গেলাম বাবার পিসির বাড়িতে। সেখানে রাতে খাওয়া–দাওয়া করে ভোরবেলা আবার পায়ে হেঁটে রওনা হলাম আমাদের বাড়ি চাঁদপুরের দিকে। মাচ্ছাখালি থেকে আমাদের বাড়িতে পায়ে হেঁটে যেতে লাগে ১৭ ঘণ্টা। এই ১৭ ঘণ্টা পথ পায়ে হেঁটে যাওয়া এত সহজ না। এর মধ্যে আমি অনেক ছোট। স্পষ্ট মনে আছে, মাঠের পর মাঠ আমরা পায়ে হেঁটে গ্রামগুলো পেছনে ফেলে এগোচ্ছি। কখনো রাস্তার পাশে একটু বিশ্রাম নিই। গ্রামের মানুষ আমাদের জল দিচ্ছে, কখনো শুকনো খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করছে। সে যেন অন্য রকম এক পরিস্থিতি! সেই কঠিন আর দুর্গম সময়ে মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সত্যি বলতে কি, মানুষের জন্য মানুষের তখন মমতার শেষ ছিল না। শেষ পর্যন্ত আমরা গভীর রাতে আমাদের পৈতৃক বাড়িতে এসে পৌঁছালাম। বাড়িতে আমাদের বেশ ভালোই কাটছিল। তখন অক্টোবর মাস। কিছুদিন পরই দুর্গাপূজা। কিন্তু বাবা কিছুদিন পরই টের পেলেন, সেখানকার স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাজাকারদের দলে যোগ দিয়েছে। তিনি আমার বাবাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখছেন না। গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ফিসফাস কথাবার্তা শুরু হতে থাকে, ‘স্বদেশ বাবু লাখ টাকা নিয়ে এসেছেন’।
বাবা বুঝলে পারলেন, গ্রামেও তিনি আর নিরাপদ নন। তাকে মারার জন্য প্রধান শিক্ষক ও তাঁর সহযোগীরা ওত পেতে আছে। যেকোন সময় তারা বাবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। একদিন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রধান শিক্ষককে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে আসে। উদ্দেশ্য মেরে ফেলার। কারণ তিনি রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। বাবা তখন সেখানে থাকা নিরাপদ মনে করলেন না। অক্টোবর মাসে ঠিক দুর্গাপূজার তিন দিন আগে আমার বাবা চাঁদপুর গ্রামের বাড়ি থেকে গোপনে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একদিন খুব ভোরে রাত দুইটার দিকে বাবা এগারোটি রিকশা ভাড়া করে নিয়ে এলেন। সেখানে কিন্তু কীভাবে জানি আমাদের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল, স্বদেশ বাবু চলে যাচ্ছেন। বাবা তখন বুদ্ধি করে তাঁর যাওয়া স্থগিত করলেন। সেদিন সারা রাত টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছিল। আমাদের উদ্দেশ্য রিকশায় চড়ে আমরা সোনামোড়া সীমান্ত পর্যন্ত যাব। তারপর সীমান্ত পার হয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতায় চলে যাব। বাবা এবার আবার নতুন করে বুদ্ধি আঁটেন। এলাকার মানুষ যখন সবাই ঘুমিয়ে, তখন তিনি আবার ভোর চারটার দিকে ১১টা রিকশা ভাড়া করে নিয়ে আসেন। সেই রিকশায় মা, আমরা চার ভাইবোন, দাদি, দাদুসহ আমাদের অন্যান্য সব আত্মীয়স্বজন চড়ে বসি। আমাদের এগিয়ে দিতে রওনা হলেন আমার বড় মামা ও সেজো মামা এবং মামার দিক থেকে আরও অনেক আত্মীয়স্বজন। তাঁদের উদ্দেশ্য আমাদের সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু ভাগ্য খারাপ থাকলে যা হয়, মাঝ পথে আমাদের দুটো রিকশা বিকল হয়ে পড়ে। আমার দুই মামা তখন রাস্তায় আমাদের বিদায় দিয়ে বিকল রিকশার সঙ্গে আবার বাড়ি ফিরে গেলেন।
এখনো মনে আছে, সেদিন গভীর রাতে আমাদের রিকশা চলছে মাটির আঁকা বাঁকা পথ ধরে। রাস্তার দুই পাশে দেখতে পাচ্ছিলাম মানুষের বীভৎস লাশ। শেষ পর্যন্ত আমরা সোনামোড়া সীমান্তে এসে পৌঁছলাম। পরে জানতে পেরেছি, এই গভীর রাতে জীবনবাজি রেখে আমাদের সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে আসার জন্য বাবা প্রতি রিকশাচালককে এক হাজার টাকা করে দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে এক হাজার টাকার অনেক মূল্য ছিল। সোনামোড়া সীমান্ত পার হলেই ভারত। কিন্তু সেখানে যেতে হলেও একটা ছোট খাল পার হতে হবে। বাবা কয়েকটা বাঁশের ভাঁড় ভাড়া করলেন। প্রতিটা ভাঁড়ে আমাদের বসিয়ে দিলেন। বাবা হেঁটেই পার হলেন। বর্ডার পার হওয়ার পর আগরতলা পর্যন্ত একটা ট্রাক ভাড়া করা হলো। আমরা আগরতলা থেকে কলকাতায় শোভাবাজারে এক বাসায় উঠি। সেখানেই দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমরা থাকি। সেই বাড়িতে থাকার সময় বাংলাদেশ থেকে আসা অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমার মা তাদের জন্য রান্নাবান্না করতেন। এখনো মনে আছে, আমরা শোভাবাজারে যে বাড়িটায় ছিলাম সেখান থেকে খুব কাছেই ছিলেন শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। হৈমন্তী শুক্লা আমাকে দেখলেই বলতেন, ‘কিরে কবে এসেছিস? জয় বাংলার লোক, ঢেপা ঢেপা চোখ’।
যুদ্ধ শেষ হলো। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এলাম। দেশে ফিরে জানতে পারলাম, আমরা যেদিন চাঁদপুর ছেড়ে আসি তার তিন দিন পরই আমাদের বাড়ি আক্রমণ করতে রাজাকার আর পাকিস্তানি বাহিনী এসেছিল। তারা আমাদের খুঁজে পায়নি, কিন্তু আমার দুই মামা, দাদু (মায়ের বাবা), দাদুর এক ভাই, দাদুর মেয়ের জামাইসহ মামার দিকের আত্মীয়স্বজনসহ মোট ২৮ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আমাদের বাড়ির সামনেই লাইন করে দাঁড় করায়। দাদিকে তারা প্রথমে না মেরে বলে, ‘বুড়ি তুই এইখানে বইয়া থাক। তুই শুধু বইয়া বইয়া দেখ।’ এই বলে তারা আমার নানির সামনেই প্রথমে বাড়ির কুকুরগুলোকে মারল, তারপর তার দুই ছেলে, স্বামী এবং আরও আত্মীয়স্বজনদের গুলি করে সবাইকে মারল। তারা মোট ২৮টি গুলি খরচ করেছিল। সেদিন পাকিস্তানি হায়েনারা আমার এক মামাতো বোনকেও ধরেছিল। তখন আমার মামা একটা জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন। নিজের মেয়েকে সেনারা যখন ধরল, তখন মামা জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসলেন। বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাকেও লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। কাকতালীয়ভাবে সেদিন আমার দুই মামা বেঁচে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আসবে শুনে ছোট মামা পুকুরে শুধু নাক ভাসিয়ে ডুব দিয়েছিলেন। আর আমার আরেক মামা, গ্রামের ফসলের মাঠে এলোপাতাড়ি দৌড়াচ্ছিলেন পেছনে সেনারা তাকে গুলি করছে। কখনো কখনো গুলি তার কানের পাশ দিয়ে যাচ্ছে কখনো মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। তিনি গুলিবিদ্ধ হননি, বেঁচে গিয়েছিলেন।
তাঁদের রক্তের বিনিময়েইতো আমার আজকের এই বাংলাদেশ। এই রক্তের ঋণ শোধ করাই এখন আমাদের অন্যতম কাজ।

(আপনার গল্প চাই
দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে কেউ সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন, কেউ পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, কেউ ছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, আবার কেউ ঘটনাটি দূর থেকে দেখেছিলেন। কেউ আবার মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে মা-বাবা বা কোন নিকট আত্মীয়ের কাছে শুনেছেন। যুদ্ধ নিয়ে মানুষের এই মৌখিক বিবরণ নিয়েই শুরু হয়েছে ধারাবাহিক লেখা মুক্তিযুদ্ধের গল্পমালা। উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ের গল্পগুলোকে লিপিবদ্ধ করা। আপনার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন গল্প থাকলে সেই গল্পটি পাঠিয়ে দিতে পারেন এই ইমেইল ঠিকানায়—[email protected]
গল্পের সঙ্গে আপনার নাম, ঘটনার সময়, স্থান ও সম্ভব হলে সময় দিতে ভুলবেন না।)