আমার জল-জোছনার শহর

আমি আমার সেই শহরের কথা বলব যেখান থেকে আমি পালাতে চাইনি, যে শহর আমাকে পালাতে দিতে চায়নি। বোশেখ মাসের এক রাতে সুবহে সাদিকের পর যে শহরে হয়েছিল আমার আগমন আজ থেকে ৬০ বছর আগে। নানু-খালারা ব্যস্ত হলেন। মুড়িয়ে নিলেন হাতে বানানো কাঁথা দিয়ে। বাবা আজান দিলেন। সবকিছু সম্পন্ন হলো নিয়ম মাফিক। ঘষে মুছে রাখা চিমনি বদল করে লাগানো হারিকেন উঁচিয়ে নানি বললেন, মাশাআল্লাহ গোলগাল হবে, মা-বাবা দুজনের চেহারার সঙ্গে মিল আছে। মাটির মালসায় রাখা তুষের আগুনে নাভি সেঁকাসহ যাবতীয় আয়োজন রুটিন মাফিক চলতে লাগল। হাঁসফাঁস গরমে সবাই অস্থির হলেও সবকিছু দেখভালের কোনো কমতি নেই। বেড়ে ওঠার সময়ে পরতে পরতে শহরের নানা স্বজনদের নানা কিসিমের আদর আর ছোঁয়ার মাঝেই ক্রমে বেড়ে ওঠা।
শৈশবের দুরন্তপনার গল্প মা-খালারা বলতেন। বিকেলে সাদা শার্টের ওপর ক্রস বেল্টের হাফ প্যান্ট। সঙ্গে চকচকে কালো ছোট আকারের পাম্প সু আর হাঁটু অবধি দুধসাদা নাইলনের মোজা পরে ফিটফাট হয়ে পা রাখতাম বাসার সামনে চিলতে বারান্দায়। শুরু হতো তিন চাকার সাইকেলে চালানো দু–চারটি প্যাডেল মেরে সামনের ছোট মাঠে চলে যেতাম দ্রুত। বাসার কাজের লোক ইনছান মামুকে পেছনে পেছনে দৌড়াত হতো আমাকে চোখে চোখে রাখতে। পাড়ার সমবয়সীরা আমাকে দেখামাত্র মাঠ ছেড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতো দ্রুত। মোটা সোঁটা ছিলাম বলে হাতের নাগালে পেলে কারও অক্ষত অবস্থায় ফিরে যাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। পায়ে-পায়ে কৈশোর এল। প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণে বৈচিত্র্য ছিল।
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার শুরুর দিকে পুরো একদিন কাটিয়েছি পাশে সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। স্কুলের প্রথম দিনে ভয়ে জড়সড় হয়ে কান্নাকাটি শুরু করলে পরিচিত এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষিকা পাঠিয়ে দিলেন লাগোয়া উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে খালাতো বোনের কাছে। বর্ষায় খোয়া ওঠা সদর সড়ক দিয়ে পা টিপে টিপে স্কুলে যেতে হতো। পাশের বাসাটি ছিল প্রয়াত আবুদাব। ওনার বাবা ছিলেন তৎকালীন নামকরা আইনজীবী। কাকা ছিলেন অখণ্ড ভারতের পূর্বাংশ আসাম বেঙ্গলের ডাকসাইটে কংগ্রেস নেতা। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে লড়েছেন বর্তমান বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল থেকে। ব্রিটিশদের রোষানলে পড়ে কারাবরণ করেছেন বহুবার। তাঁদের বাসার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বেশ বড়সড় খাল দিয়ে গ্রাম হতে আসা নৌকাগুলো সদর রাস্তার লাগোয়া রেইনট্রি গাছে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। সুযোগ পেলে নৌকায় উঠে পেছনের গলুই পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করা ছিল নিত্যদিনের খেলা। শীতে পৌষ সংক্রান্তিতে খড় দিয়ে তৈরি করা হতো ছোট ছোট কুড়ে ঘর। উৎসবের আমেজে বিকেলে শহরের পাশের আমন খেত থেকে ন্যাড়া সংগ্রহ করে বানানো হতো খড়ের তৈরি ঘর। ভোরে উঠে ঘরে আগুন দিয়ে তাপ পোহানোতে পাড়ার সবাই হাজির। পুরো উৎসব ছিল সর্বজনীন। বিকেলে প্রতিবেশীদের বাসায় বাহারি পদের নানা পিঠা-পুলি খাওয়ার আনন্দ। আজও এই বয়সে মনে দোলা দেয়, স্মৃতি জাগানিয়া হয়ে ফেরত আসে।
স্বাধীনতা পূরবর্তী দেশ মুক্তির আন্দোলনের নানা ঘটনা স্বচক্ষে দেখা। জনতার মিছিলে অংশ নিয়েছি নিয়মিত। সেই সময়ের শহর ছিল মুক্তির নেশায় উত্তাল। সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। মিছিলের শহর, প্রতিবাদের শহর। অন্দর মহলে থাকা মা–বোনেরা পর্যন্ত সব ধরনের প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিলেন। আন্দোলন আরও বেগবান হলো। দেশ মুক্তি পেল একাত্তরের ডিসেম্বরে। সদ্য স্বাধীন দেশের শহুরে চিত্রটির মধ্যে কিছু বুনো মোষের দাপানির আওয়াজ পাওয়া গেল, যা ছিল ছোট এই শহরের শান্তিপ্রিয় শহরবাসীর কাছে সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা।
শহরে পেশিশক্তির মহড়ায় কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল। শহরের সব অধিবাসী সমস্বরে বলতে লাগলেন, আমরা শান্তি চাই, আমরা শান্তি চাই। সবাই একযোগে দাবি তুললেন, আমরা এক হয়ে থাকতে চই, মিলেমিশে চলতে চাই। কোনো বিভেদ নয়, থাকবে না কোনো অন্যায় কিংবা অবিচার। মিলেমিশে বাস করতে চাই। সবাই সে আহ্বান একযোগে মেনে নিল। আবার সবাই এক হয়ে মিলে মিশে চলতে শুরু করল।
শীতের সেই কাক ডাকা ভোরে ঘিয়ে রঙের পশমি চাদর গায়ে দিয়ে ফজর নামাজ শেষ করে আমার বাবা যখন হাঁটতে বেরোতেন, সঙ্গী হতেন মোটা খদ্দরের চাদর গায়ে জড়ানো, এক হাতে পূজার নৈবেদ্যের জন্য ফুলের সাঁজি আরেক হাতে ফুল পেড়ে নেওয়ার বাঁশের কঞ্চি হাতে নিয়ে পাশের বাসার ডাক্তার বাবু ধীরেন্দ্র দেব চৌধুরী।
নিঃসংকোচে কত বিষয় নিয়ে নানা বাক্যালাপ করতে করতে দুজনে হাঁটতেন অনেকক্ষণ। প্রাতর্ভ্রমণের আরেক দলে থাকতেন পাড়ার দেবু বৌদি ও রাহেলা ভাবি। হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছেন আর তাঁদের সঙ্গে কথায় কথায় খিল খিল করে হাসতে দল বেঁধে হাঁটছে অষ্টাদশী ৩/৪ ননদের দল। হঠাৎ চোখে পড়ত হন হন করে হেঁটে চলা জেলা সদরে কর্মরত কলেজ পাশ করা পাড়ার এক বড় ভাই। ছন্দের কোনো বিচ্যুতি নেই। শহরের এই নান্দনিক রূপে কোনো অবহেলার ছাপও নেই। ভীষণ রোমান্টিক। আবেদন সরাসরি। একেবারে বুকের অলিন্দে এসে সরাসরি আঘাত করে বলেই আজও সেই সুখের স্মৃতি রোমন্থনে সুখ পাই। বুকে বাজে সেই ঐতিহাসিক সুর। যুগে যুগে সম–বাসনায় লালিত হয়। সেই জল জোছনার শহরের আজও আমি একটি অংশ। শক্ত কালো কয়লার সর্বোচ্চ তাপে পুড়ে DMV মার্কার টকটকে লাল রঙের একটি ইটের মতো। সাম্যের শপথ নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চলেছি সমানতালে। শপথ নিয়েছি শহরের ঐতিহ্য যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। উপাসনালয় নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম সাহস করে। খোলা রামদা, কুড়াল নিয়ে হাজার বিশেক উম্মত্ত জনতার সামনে ছিলাম মাত্র পাঁচজন, যাদের দুজন আজ প্রবাসী। বাকি তিনজন না ফেরার দেশে। তাঁরা কোনো দলের কর্মী কিংবা নেতা ছিলেন না। ছিলেন মানবতায় বিশ্বাসী মফস্বল শহরের ছা-পোষা নিরীহ গৃহস্বামী।
আমার শহর আমাকে কি দেয়নি? সতত দিয়েছে উজাড় করা ভালোবাসা। বন্ধু হয়ে প্রেমিকার উষ্ণতায় আলিঙ্গন করেছে। আমার পৌরুষকে সর্বক্ষণ সেল্যুট করে বলেছে, তোমার এ অহংকার আমি মাথায় তুলে রাখলাম। এবার এক ব্যতিক্রমী শহর অধিকর্তাকে স্মরণ করতে তাগিদ অনুভব করি। বিশাল হৃদয়ের অধিকারী এক কবি ছিলেন তিনি। সুর–ছন্দ–স্বপ্ন সবকিছুতে তার নিখাদ প্রেম ছিল। নিজেও ছিলেন ভাবুক আর চিরন্তন প্রেমের পূজারি। সেই পুরুষের কথা বলছি যিনি চন্দ্রালোকিত রাতে জোছনা উপভোগ করে ছিলেন শহরের বাতি নিভিয়ে। কতই না কাব্যিক ভাবনার ফসল! অভিমানী কণ্ঠে বলতেন, সিলেটে চলে গেল কেন? ফিরে আসো নিজ শহরে। ভীষণ টান ছিল সবার জন্য। নিজ শহরে কখনো এলে বলতেন, এসেছ? আর যাইও না, থেকে যাও। সবাই মিলে শহরে বেড়াতে বের হব। আমার শহরের সেই আমন্ত্রণ ছিল আদি ও অকৃত্রিম। আর সেই আমন্ত্রণ আজও প্রতিদিন শুনি আটলান্টিকের নোনা জল ছুঁয়ে আসা বাতাসে। আবেগতাড়িত হই আর কেঁদে কেঁদে স্মরণে রাখি জল জোছনার আমার প্রিয় শহরকে। আর তাই বুঝি আটলান্টিকের গভীর সোপানে নোঙর করা জাহাজে বসে রোজনামচা লিখি। চিৎকার করে বলি, আমি আসছি হে প্রিয় শহর, প্রিয় শৈশব আর প্রিয় কৈশোর, চন্দ্রকে কম্পাস বানিয়ে। সূর্যকে শক্তি—আসছি আমি। খুব শিগগিরই। অপেক্ষায় থেকো আমায় বরণ করতে!