সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। দুই প্রবল প্রতিপক্ষ কৌরব ও পাণ্ডবরা দ্বন্দ্বে লিপ্ত। নিজেদের মিত্রদের দলে ভিড়িয়ে এক ব্যাপক সেনাসমাবেশ করেছে। কৌরব পক্ষে দুর্যধন ‘বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী’ না ছাড়ার ঘোষণা সদম্ভে দিলেও এ অবস্থান ছিল দুই পক্ষের জন্যই সত্য। এক ভীষণ বৈরিতা। কিন্তু ওই যুদ্ধেও আহত সেনাদের দিন শেষে চিকিৎসা দিয়েছেন কৌরব-পাণ্ডব শিবিরে থাকা চিকিৎসকেরা সম্মিলিতভাবেই। এ মহাভারতের কথা।
আসা যাক মহাকাব্যের যুগ পেরিয়ে প্রামাণ্য ইতিহাসের যুগে। সর্বশেষ ক্রুসেডে খ্রিষ্টানপক্ষের নেতা রাজা রিচার্ডের অসুস্থতায় বিরোধীপক্ষের নেতা নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসক পাঠিয়ে দিচ্ছেন। সালাদিন নামে সমধিক পরিচিত ওই নেতার পুরো নাম সালাহ আদ-দীন ইউসুফ বিন আইয়ুব। বেশি নয় দ্বাদশ শতকের শেষভাগের ঘটনা এটি। এ ধরনের ঘটনার সাক্ষ্য নানাভাবেই পাওয়া যাবে ইতিহাসে-গাঁথায়। একজন অসুস্থ মানুষ কোন পক্ষের, তার পরিচয় কী, তা কখনোই বিবেচ্য নয়। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সময় থেকে টানা যেতে পারে রেডক্রসের মতো সংস্থার উদাহরণ।
প্রাথমিকভাবে মানুষের মৌলিক চাহিদা হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানকে। পরে এর পরিসর বেড়ে শিক্ষা ও চিকিৎসাও এ ক্ষুদ্র তালিকায় ঢুকে পড়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদী কাঠামোয় দাঁড়িয়ে এই চাহিদাগুলোকে মুখে মানুষের অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হলেও কার্যত তা রক্ষায় খুব কমই কাজ করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে নিউইয়র্ক এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে।
নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও ৮ জানুয়ারি নিউইয়র্ক নগরীর সব বাসিন্দার (বৈধ ও অবৈধ) স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের ঘোষণা দিয়েছেন। এ জন্য বছরে ১০ কোটি ডলারের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। এককথায় নিউইয়র্কে বসবাসকারী সব মানুষকে এই সেবার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে মেয়রের বক্তব্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্লাজিও বলেছেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা একটি অধিকার। এটি শুধু সামর্থ্যবান মানুষের জন্য একটি বিশেষাধিকার নয়।’
নিউইয়র্ক নগর কর্তৃপক্ষের এ পদক্ষেপ এমন এক সময়ে নেওয়া হয়েছে, যখন আমেরিকার বর্তমান ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধে লিপ্ত। সংকোচন করা হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তায় গৃহীত বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচি। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে নিউইয়র্ক নগর জানিয়ে দিচ্ছে, চিকিৎসাসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈধ-অবৈধ নাগরিক—এমন কোনো বিবেচনা গ্রহণযোগ্য নয়। স্বাস্থ্যবিমা থাকুক বা না থাকুক, প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার পূর্ণাঙ্গ অধিকার। এ ক্ষেত্রে হয়তো প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা পাওয়ার নিশ্চয়তার ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতে এর পরিসর আরও বাড়বে। কিন্তু এ ঘোষণার মধ্য দিয়েই নিউইয়র্ক নগর কর্তৃপক্ষ এর বাসিন্দাদের প্রতি যে দায়বোধের পরিচয় দিয়েছে, তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে পুরো আমেরিকা। নিউইয়র্ক নগরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমেরিকার সর্বত্র একদিন বৈধ-অবৈধ স্ট্যাটাসনির্বিশেষে সব বাসিন্দার জন্য চিকিৎসাসেবার দ্বার খুলে দেওয়া হবে—এটাই প্রত্যাশা।