একাত্তরের মানুষগুলো যখন ভূত

চৌধুরী আসফদ্দৌলা উচ্চ শিক্ষিত আধুনিক মানুষ হয়েও সরকারি কি বেসরকারি কোনো চাকরি গ্রহণ না করে তিনি থানা সদরে পৈতৃক বাড়িতেই বাস করেন। পৈতৃক জমিজমা চাষাবাদ ও সঙ্গে থানা সদরে একটি রাইস মিল, একটি বরফ কল প্রতিষ্ঠা ছাড়াও মহাজনী ব্যবসা করেন। মূলত লোকজন দিয়েই করান, নিজে হিসাব-নিকাশটা দেখেন। নিজেকে তত জড়িয়ে রাখতে হয় না বলেই হাতে থাকে যথেষ্ট সময়। আর বাড়িতে তো চর্চা ছিলই। বাবা জাঁদরেল ব্যক্তি। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে এসে ব্যবসা ও রাজনীতি দুই’ই শুরু করেছিলেন। অবশ্য রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার বড় কারণ ও উৎসাহ ছিল ঢাকার নওয়াব পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। তিনি তিন মেয়াদে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজনীতি করার সুবিধার্থে তিনি বগুড়া শহরের সূত্রাপুরে দ্বিতল বাড়ি বানিয়ে সেখানেই মাসের বেশির ভাগ সময় থাকতেন। ছেলে চৌধুরী আসফদ্দৌলা পিতার অনুগামী হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেও চাকরি না করে গ্রামে ফিরে ব্যবসা ও রাজনীতি শুরু করেন। জামুইরহাট ইউনিয়নের চেয়্যারম্যান ছিলেন দুই মেয়াদ। বর্তমানে জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি এবং বগুড়া ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান। বিত্ত, বৈভব, সম্মান সবকিছুই হাতের নাগালে। পারিবারিক জীবনও বেশ সুখের। পিতা মাতা নিজে পছন্দ করে কাছাকাছি গোবিন্দগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব পরিচিত ও আত্মীয় গোবিন্দগঞ্জ কলেজের প্রিন্সিপাল শাখাওয়াত হোসেন চৌধুরী সাহেবের জ্যেষ্ঠ কন্যা শাহানা চৌধুরীকে পুত্রবধূ করে নিয়ে আসেন। আসফদ্দৌলা ও শাহানা চৌধুরীর সুখী দাম্পত্য জীবনকে আরও আনন্দময় করে তোলে পুত্র চৌধুরী শফিকুদ্দৌলা ও কন্যা আরিফা চৌধুরী। ছেলে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে এসএসসি করে নটরডেম কলেজ, ঢাকা থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছে। মেয়ে বগুড়া সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় (ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল) হতে এসএসসি করার পর সরকারি আযিযুল হক কলেজ থেকে সবে ডিগ্রি পরীক্ষা শেষ করে গ্রামের বাড়িতে মা বাবার আদরে এবং বান্ধবী রোকেয়ার সান্নিধ্যে আনন্দময় ছুটির দিন কাটাচ্ছে। এই আনন্দ বেড়ে যায় যখন তার আরেক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শ্বশুর বাড়ি থেকে এক মাসের জন্য বাড়িতে আসে বান্ধবীকে সময় দেওয়ার জন্য।
এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল। হঠাৎ এ আনন্দময় দিনযাপনে ছেদ পড়ে। বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় যেন, বাবা আসফদ্দৌলার এক সিদ্ধান্ত। তিনি সিদ্ধান্ত জানান মেয়ের বিয়ে স্থির করেছেন।
আসফদ্দৌলার এই সিদ্ধান্তটিই সংসারে ঝড় তুলল। মেয়ে বিয়েতে কিছুতেই রাজি নয়। মা মেয়ের পক্ষে। বাবা প্রথমে মাকে বোঝাতে গেলেন, “দেখো শফিকের মা, মেয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছে। সোশ্যাল স্ট্যাটাস, সামাজিক মেলামেশা ও সন্তানকে যোগ্য মানুষ করে গড়ে তুলতে মায়ের ভূমিকা পালনের জন্য যথেষ্ট শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছে তোমার মেয়ে”। কিন্তু মায়ের এককথা, “মেয়েকে লেখাপড়া শেষ করতে হবে। বাপ দাদা সেকালের পিছিয়ে পড়া সমাজে শিক্ষার অপ্রতুলতা থাকা অবস্থায় মাস্টার্স করেছেন। দাদা সেকালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন। দাদি সেযুগের গ্র্যাজুয়েট, আমি মাস্টার্স করতে পারিনি বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে, সে কষ্ট আমাকে আজও তাড়া করে ফেরে। মাস্টার্স করার আগে বিয়ের প্রশ্নই আসে না।” বাবা গেল মেয়েকে বোঝাতে। মেয়ের এক কথা, পড়াশোনা শেষ করার আগে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না। বাবা তাকে হতাশার গলায় বললেন, “দেখ মা, বিয়ের পরেও পড়াশোনা করা যায় ইচ্ছা থাকলে, তবে হাতের কাছে জানা শোনা এমন ভালো ছেলে সব সময় পাওয়া যায় না।” জানাশোনা শব্দটায় আরিফা ধাক্কা খেলো যেন! সে বাবাকে রেখেই দৌড়ে মায়ের ঘরে গেল। মাকে বাবার সব কথা বলল। মা আর মেয়ে এবার বাবার খোঁজে ছুটল। বৈঠকখানায় তাঁকে পেয়েই মা জানতে চাইলেন,
“হাতের কাছে জানা শোনা ভালো ছেলে মানে কি? ছেলে কে?” বাবা অনেক গাইগুই করে শেষে যা বললেন, তা শুনে মা মেয়ে দুজনেই ক্ষেপে গেল। মেয়ে সরাসরি বাবাকে বলে দিল সে কিছুতেই ওই ছেলেকে বিয়ে করবে না। মা ছেলের পারিবারিক পরিচয় তুলে ওই সম্পর্কের চিন্তা নাকচ করে দিলেন।
আসফদ্দৌলা সাহেব তাঁর চিরচেনা পরিশীলিত রূপটিকে দূরে সরিয়ে, আভিজাত্য, শিক্ষা, পারিবারিক ঐতিহ্যের বিপরীত আচরণ শুরু করলেন। তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন আরিফার বিয়ে তিনি ওই ছেলের সঙ্গেই দেবেন। মেয়ে কান্না কাটি করল। মা মেয়ে তিন দিন ধরে পরিবারের কর্তার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। তাতেও বরফ না গলায় মা ছেলেকে খবর দিলেন। দুদিন পর শফিক বাড়িতে এসে সব শুনে সেও মা-বোনের পক্ষ নিল। শফিক বাবার কাছে গেল। বাবাকে বলল, “বাবা, আরিফার বিয়ে ওই বাড়িতে হতে পারে না।” বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কেন হতে পারে না ?” শফিক বলল, “বাবা, আভিজাত্যে, কৌলীন্যে , বংশমর্যাদা, অর্থ-বিত্ত-বৈভবে কোনো দিকেই ওরা আমাদের ধারে কাছে নয়। বাবা মাদ্রাসার শিক্ষক। অনেকগুলি ভাইবোন। ছোট দুই ভাই মাদ্রাসার ছাত্র। বোনেরা হাই স্কুলের গণ্ডিও কেউ পেরোয়নি। ছেলে এমন কিছু নয়, কোনোরকমে এম এ পাস করে ধরাধরি করে স্থানীয় কলেজে ইতিহাসের প্রভাষক। বেতনও সামান্য এবং অ-নিয়মিত। এমন বাড়িতে আরিফার মতো আধুনিক, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ের বিয়ে মানে ওকে ধরে বেঁধে সাগরে ফেলে দেওয়া।” বাবা ছেলেকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, “ দেখ বাবা, তোমরা ছেলেমানুষ, আবেগপ্রবণ, তোমাদের মার বাস্তব বুদ্ধি কম, তোমরা যা ভাবছ, আমি তেমন করে দেখছি না। দরিদ্র কিন্তু শিক্ষিত, চরিত্রবান ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়, ওরা আমাদের কথার নিচে ভয়ে ভয়ে থাকবে। তা ছাড়া ওর ভবিষ্যৎ তো গড়ে দেব আমি।” অনন্যোপায় হয়ে শফিক আল্টিমেটাম দিয়ে বসল আরিফার বিয়ে ওই ছেলের (মোহাম্মাদ শামসুল আলম মোল্লা) সঙ্গে হলে সে বাড়িতে আর ফিরবে না। শফিককে অবাক করে দিয়ে বাবা জানালেন বিয়ে আগামী এক মাসের মধ্যে ওই ছেলের সঙ্গেই হবে, তত দিন যেন শফিক বাড়ি ছেড়ে না যায় এবং তাঁর মাথা হেঁট না করে। বাবার এই রূপ তারা আগে কখনো দেখেনি। সবাই নির্বাক হয়ে গেল যেন! শুধু সরব দোর্দণ্ড প্রতাপশালী বিত্তবান, ক্ষমতাবান, মর্যাদাশীল চৌধুরী আসফদ্দৌলা। জয় হলো তাঁর দম্ভের।
বাইশ দিনের মাথায় সাড়ম্বরে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো। আশ পাশের কয়েক গ্রামের লোক এল, খেল। কিন্তু বড্ড যেন মনমরা, বাকস্ফূর্তিহীন। লোকজন অনেকে প্রকাশ্যেই বলাবলি করল চৌধুরী আসফদ্দৌলা কখনো ভুল করেন না, এই দম্ভের আগুন আজ নিভে গেল। উনি মস্ত ভুল করলেন। এলাকাবাসীর কথা খুব তাড়াতাড়ি ফলতে শুরু করল। চৌধুরী সাহেব ক্ষমতার কলকাঠি নাড়িয়ে তিন মাসের মধ্যে মোহাম্মাদ শামসুল আলমকে কলেজের প্রিন্সিপাল বানিয়ে ফেললেন। সবাই নাখোশ হলেও কারও কিছু বলার সাহস হলো না। চৌধুরী সাহেব কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান।
শ্বশুরমশাই চাইলেন জামাতাকে ধনীর কাতারে নিয়ে আসতে। চাকরির পাশাপাশি নিজ ব্যবসায় অংশীদার করে নিয়ে ব্যবসা শেখাতে চাইলেন। কিন্তু ধূর্ত জামাই আর তার লোভী বাবা সেদিকে না গিয়ে নগদ অর্থ দাবি করে বসল। চৌধুরী সাহেব তার ভুল বুঝতে পারলেন। কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না। আরিফার প্রায় বন্দী জীবন। লেখাপড়ার স্বপ্ন আর দেখা যাবে না, বাপ বেটার সে বয়ান শোনা হয়ে গেছে। পর্দা প্রথা মানতে গিয়ে তার প্রাণ ওষ্ঠাগত। মা এ বাড়িতে কখনো আসেননি। বেশি কান্নাকাটি করলে চৌধুরী সাহেব আরিফাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। ক্রমেই জানা যায় শামসুল ও তার বাবা মুসলিম লীগ নয়, তলে তলে তারা জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় সংগঠক। দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক চালচিত্র দ্রুত বদলাতে শুরু করে। ছয় দফা, এগারো দফা, স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসন বিষয়গুলি সামনে আসতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান নামটি সবকিছুর ওপর জায়গা করে নেয়। দিন বদলের আভাস দেখতে পায় চৌধুরী সাহেবের হিসেবি চোখ। নিজেকে মুসলিম লীগের সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেন। মনে মনে জয় বাংলার দিকে নিজেকে ঝুঁকতে দেন। জামাতাকে বোঝাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। তত দিনে শামসুল আলমের চোখে পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষ গাদ্দারে পরিণত। এভাবেই একদিন ৭ মার্চ, ২৫ মার্চের কালরাত্রি, ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আবার শামসুল আলম ও তার বাবাদের মতো কিছু লোভী, উচ্ছিষ্টভোগী দেশের মানুষদের সঙ্গে গাদ্দারি করে অখণ্ড ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান বজায় রাখার নামে পাকিস্তানি জান্তবদের সেবা করার নামে তাদের ভোগের জন্য ঘর ঘর থেকে যুবতী মেয়েদের ধরে এনে ছুড়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া যুবকদের বাড়ি চিনিয়ে তাদের বাড়ি থেকে সবাইকে ধরে এনে মেরে ফেলায় সহায়তা অথবা নিজেরাই মেরে ফেলা এবং ঘর বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, বিনিময়ে তাদের পাক বাপ-বেরাদরদের উচ্ছিষ্ট ভোগে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা এবং ইচ্ছেমতো লুটতরাজের স্বাধীনতা ভোগ করা এবং ঘর ছাড়া , দেশ ছাড়া হিন্দুদের বাড়ি সম্পত্তি দখল করে নিজের করে নিয়ে সম্পত্তির পাহাড় গড়ে তোলা। এই দালাল রাজাকারদের একজন পালের গোদা পিচ কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ শামসুল আলম।
চৌধুরী সাহেব অনেক বুঝিয়েও কাজ না হওয়ায় ভাব-গতিক বুঝে মেয়েকে তার ছেলেমেয়ে দুটোসহ নিজ বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। আর ও বাড়িতে যেতে দেননি। মুশকিল হলো সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে অ্যামবুশ পেতে এবং সম্মুখ সমরে পাকিস্তান সেনাদের মেরে এলাকাটি নিজ অধিকারে রাখার সময় পিচ কমিটির চেয়ারম্যান, সদস্য, রাজাকার, দালাল নিধন অভিযানে আটক হয় শামসুল ও তার দালাল বাবা। তাদের মেরে ফেলা হবে খবর পেয়ে চৌধুরী সাহেব গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ক্ষমা চাইয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে ওই দিনই লোক দিয়ে তাকে ভারতে পাঠিয়ে দেন। জানতে পারেন শামসুলের বাবাকে মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও বেগতিক দেখে শামসুল ফিরে আসেনি। হঠাৎ আবার সে আবির্ভূত হয় ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ ঘটে যাওয়ার পর। মীর জাফর খন্দকার মোস্তাকের আদলে ঢোলা পাজামা, লম্বা শেরোয়ানির ওপর মাথায় জিন্না টুপি চড়িয়ে হাজির প্রাক্তন পিচ কমিটির চেয়ারম্যান। মোস্তাক পতনের সঙ্গে সঙ্গেই ভোল পাল্টিয়ে সাফারি স্যুটে ব্রিফকেস হাতে নব্য ধনী মস্ত ঠিকাদার শামসুল আলম মোল্লা। সারা বিএনপি আমল জুড়ে এই স্বাধীনতা বিরোধীর রমরমা, শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি। গাড়ি, বাড়ি, প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু তবুও যেন শান্তি নেই। চিত্ত অস্থির। স্ত্রী-পুত্র কাছে নেই, এটা কোনো বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে মাঝে মাঝে একা থাকলে কারা যেন ছায়ার মতো সামনে দাঁড়ায়। কখনো কখনো মনে হয় অশরীরী কারা যেন গলা টিপে মারতে চাইছে। এ শুধু মনে করা নয়, সত্যি সত্যি দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। একদিন রাতের দিকে ল্যাট্রিন থেকে বেরোতেই কারা যেন ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিয়ে সরে গেল। এক ঝলক সে যেন তাদেরকে দেখতে পেল। শরীর নেই। মাথা আর হাত, তাও আবার মাংসবিহীন। শুধু হাড়ের কাঠামো। তারপরেও সে ওই একঝলকে তাদেরকে চিনতে পারে। এ তো সব তারা যাদের ওপর সে একাত্তরে নির্যাতন করেছে। দুজনকে তো স্পষ্টত চিনল, একজন প্রতিবেশী জ্ঞাতির মেয়ে, যাকে মিলিটারিদের হাতে তুলে দিয়েছিল। আরেকজন শীলবাড়ির বুড়ো কর্তা, বাড়ির সবাইকে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দিয়ে সে একা বাড়ি পাহারা দিচ্ছিল। শামসুল লোক দিয়ে তাকে মেরে ফেলে বাড়ির দখল নিয়েছিল। বাড়ির লোকেরা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতাল ভর্তি করায়। সুস্থ হওয়ার পর সে সকলের পরামর্শে আবার বিয়ে করে। দুই হাতের আঙুলে সাতটি অষ্ট ধাতুর মিশ্রণে তৈরি নানা পাথরের মূল্যবান সব পাথর, তাতে আরও দুটি যুক্ত হয়। তাবিজ আরও একটি বাড়ে। ভেতরে ভয় ভয় কাজ করে। কিন্তু বড় রকম কিছু অনেক দিন ঘটেনি। সব সময় মানুষজন সঙ্গে থাকে।
বিপত্তি ঘটে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলে। সে ভীষণ উত্তেজিত। ভীতও বটে। জামাত ও শিবিরের লোক নিয়ে ভোটদানে প্রবল বাধা সৃষ্টি করা সত্ত্বেও তাদের এলাকায় নৌকা জিতেছে। বিএনপির প্রার্থী ছিল সে নিজে। প্রচুর অর্থ খরচ করেছিল। লাভ হয়নি। এখন সে মতলব আঁটছে হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে, মেয়েদের গণধর্ষণ করিয়ে আওয়ামীর ওপর দোষ চাপিয়ে দেবে। এই গোপন মিটিং শেষ করার কিছু পরে এলাকার মানুষ দেখল শামসুল আলম তাড়া খাওয়া মানুষের মতো দৌড়াচ্ছে। রাস্তা ছেড়ে সে নয়ানজলির পাড় দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। তার লোকজন খবর পেয়ে তার পিছু দৌড়ে তার কাছে পৌঁছে তাকে অজ্ঞান পড়ে থাকা অবস্থায় পায়। হাসপাতালে ডাক্তাররা বলেন তাকে শ্বাসরোধ করে মারার চেষ্টা হয়েছিল। কয়েকজন মিলে গলা টিপে ধরেছিল। অনেকগুলো হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। তবে সেগুলো কোনো স্বাভাবিক জীবিত মানুষের হাতের ছাপ নয়। মাংসবিহীন আঙুল, যাতে ধারালো বড় বড় নখ আছে। গলায় নীলচে দাগ ও রক্তসমেত ক্ষত ছিল। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর শামসুলের সুস্থ হয়ে উঠতে সময় লেগেছিল। বেশ কিছুদিন উপদ্রবহীন কাটে। বছর দুই পর আবার একদিন ফজর ওয়াক্তে মসজিদের পাশের পুকুর পাড়ে অজ্ঞান অবস্থায় মুসল্লিরা দেখতে পেয়ে তুলে বাড়ি নিয়ে গেলে, বাড়ির লোক হাসপাতালে নেয়। আবার একই ঘটনা।
গলায় মাংসবিহীন ধারালো নখের আঁচড় সৃষ্ট গভীর ক্ষত। তাতে নীলচে রক্তের দাগ। পাঞ্জাবির বুক পিঠ দুদিকেই টানা টানাহ্যাঁচড়ায় ছিঁড়ে যাওয়ার চিহ্ন। এবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতে সময় লাগে। ডাক্তার ও স্থানীয় মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হুজুর তাকে গ্রাম ছেড়ে শহরে থাকতে পরামর্শ দেন। কিন্তু সে কিছুতেই গ্রাম ছাড়ে না। তার ভয় সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেই ছাত্রলীগের ছেলেদের সহায়তায় সে একাত্তরে যাদের বাড়িঘর, বিষয় সম্পদ কেড়ে নিয়েছে, অত্যাচার করেছে, তারা দখল করে নেবে। অর্থ গৃধ্নু এই লোভী ইতর প্রজাতির মানুষ অর্থ সম্পদ আগলে ঘিরে বসে থাকে। দীর্ঘদিন একপ্রকার ভালোই কাটে। বড় রকমের দুর্ঘটনা ছাড়া।
শেষ ঘটনাটি ঘটে মাসখানেক আগে। অনেক দিন আক্রমণ না হওয়ায় মন থেকে ভয়টা সরে গিয়েছিল অনেকটা। মসজিদে আছরের নামাজ আদায়ের পর একাকীই হাঁটতে শুরু করে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের দিকে চলে গিয়েছিল সে। স্কুলের বারান্দায় পা দেওয়ার পর পরই তার শিরদাঁডা বেয়ে ভয়ের স্রোত বয়ে যায়। সে বুঝতে পারে সে নিজের ইচ্ছায় আসেনি। কারা তাকে ফুসলিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু চারিদিক চেয়ে সে কাউকেই দেখতে পায় না। ঘাড়ের ওপর অনেকগুলো মানুষের একত্র দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ ও গরম বাতাস টের পায়। পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় যেন। চিৎকার করতে চায়, গলা দিয়ে স্বর নামে না। মাথাটা ঘুরে ওঠে। সে বুঝতে পারে তার বসা উচিত। সামনের ক্লাসরুমের দরজা হাঁ করা খোলা দেখতে পায়। সে ভেতরে ঢুকতেই, কারা যেন তাকে সালাম দেয়। সে অবাক হয়ে সামনে তাকায়। শীত বিকেল হলেও বাইরে তখনো ঝকঝকে আলো। কিন্তু ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
অবাক ব্যাপার যে চোখ ঠাওর করতেই সে সামনে পরিষ্কার দেখতে পায়। কয়েকটি সার কঙ্কাল সামনে বসা। যাদের অনেককে শরীর মুখে মাংস না থাকলেও সে অনায়াসে চিনতে পারে। এরা একদা তার প্রতিবেশী, গ্রামের মানুষ, এলাকার লোক ছিল, যারা তার লোভের বলি হয়েছিল। ভীষণ ভয় পেয়ে সে পালিয়ে যেতে যায়। পারে না। দেখে দরজার পাল্লা বন্ধ। তার পা দুটিও যেন শিকল দিয়ে বাঁধা।
চারিদিক থেকে ভেসে আসে অশরীরী প্রেতাত্মার ভয়ংকর হাসি। জ্ঞান হারানোর আগে সে অনেককে তার দিকে একসঙ্গে আসতে দেখে। গলায় সাঁড়াশি মতো চাপ অনুভব করে।
চারদিকে খোঁজ খবরে বেরিয়েছে শামসুলের লোকজন। তার দলের লোকজন। থানার পুলিশ। মানুষটি যেন একেবারে নিখোঁজ হয়ে গেছে। পরদিন স্কুল বন্ধ ছিল। দুদিন আগে ভোট হয়ে গিয়েছে। এলাকার কিশোর ছেলের দল স্কুলের মাঠে খেলতে গিয়ে দেখে একটা ক্লাসরুম হাঁ করা খোলা। তারাই দেখতে পায় রাজাকার শামসুল আলমের চক্ষু বিস্ফারিত, জিহ্বা খানিকটা বেরিয়ে থাকা লাশ। তারা ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে বয়স্কদের ডেকে আনে। সকলে দেখে লাশের গলায় অনেকগুলি মাংসবিহীন আঙুলের চেপে বসা নীল দাগ ও ক্ষতচিহ্ন। সারা শরীরের জামা খুবলে খুবলে তুলে ফেলার মতো ছেঁডা এবং শরীর জুড়েই গলার মতোই একইরকম ক্ষতচিহ্ন।
সেদিন তারিখ ছিল জানুয়ারি ০১, ২০১৯। মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটেছে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮। ৩০ ডিসেম্বর,২০১৮’র নির্বাচনের পরদিন।