ট্রেনে চড়লেই খুলে যায় স্মৃতির জানালা

আমি ৬ নম্বর ট্রেনে সকাল ৭টায় উঠি আর উঠি ৯টায়। উপচে পড়া মানুষের ভিড় দেখি। এত মানুষ কোথায় যায়? ছেলে-বুড়ো সাদা-কালো শ্যামলা কত রকমের যে মানুষ। কেউ ঘরে নেই। যে শিশুটি দুধের বোতল নিয়ে ঘরে থাকার কথা সেও প্রচণ্ড ঠান্ডায় মার সঙ্গে বেরিয়েছে। হয়তো মা তাকে বেবি সিটারের কাছে রেখে যাবে কর্মস্থলে। সবাই ব্যস্ত। শুধু দৌড়াচ্ছে। সিঁড়ি-পথ-ঘাট কোনটাই ফাঁকা নেই। একটা ছন্দ-তাল মেনে। ডান পাশ দিয়ে সবাই চলছে। কারও হাঁটার পথে যদি ছন্দপতন ঘটে, পেছন থেকে ধাক্কা খেতে হবে, নয়তো কেউ বলবে, এক্সকিউজ মি। ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার সাবওয়েতে এত উপচে পড়া যাত্রীর ভিড় অন্য কোনো সাবওয়েতে দেখা যায় না। ঘড়ির অ্যালার্মে শরীরকে টেনে তুলতে কষ্ট হয়। সাবওয়েতে এলে সব ক্লান্তি নিমেষেই চলে যায়। ট্রেনের দরজা লাগতে চায় না; এত যাত্রী। কবি নজরুলের ‘নতুনের গান’ ও ‘সংকল্প’ কবিতা মনে পড়ে। সবাই যেন কবির নতুনের গান শুনে ‘উতলা ধরণি তল’কে নিচে রেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে। কিংবা অতি সংকল্পে সবাই যেন ‘যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে’ মানুষের ঘূর্ণন দেখতে বেরিয়ে নিজেই পড়ে গেছে এক মহাঘূর্ণিতে।
আমি বসার জায়গা পাই না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি মানুষ গুনি। একটা কম্পার্টমেন্টে প্রায় ১০০ যাত্রী হবে। এর মধ্যে প্রায় ৯০ জনের হাতে ফোন। সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। স্পিকারে অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে-‘নিজের ব্যাগ সামলে রাখুন। বয়স্ক, অসুস্থ অথবা গর্ভবতী কেউ থাকলে আসনটি ছেড়ে দিন।’ সবাই প্রথম আদেশটি মানছে, পরেরটি নয়।
কাজ শেষে যখন বাড়ি ফিরি ,স্রোতের মতো মানুষ নামে। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ। সাবওয়ে থেকে নেমে আশপাশের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে ঢোকে বাড়ি ফেরার আগে প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে। কেউ ঢোকে রেস্টুরেন্টে। আমি দেখি। এরা এত ব্যস্ত কেন? কাল কি ঈদ নাকি? যেন চাঁদ রাত! কিছু যেন বাদ পড়ে না যায়। অথচ কাল সূর্য ওঠার আগেই আবার সবার ব্যস্ততা শুরু হবে। আমি আবারও ট্রেনে উঠব। বসার জায়গা পাব না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবব আকাশ-পাতাল। ইশ্‌ ছোটবেলায় একটু ট্রেনে চড়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য সে কী তৃষ্ণা ছিল। আর এখন প্রতিদিন চড়তে হয়। এখানকার ট্রেনে কেউ বলে না, ‘হেই-ঝালমুড়ি /ডিম সিদ্ধ/ কোল্ড ড্রিংকস/ চীনা বাদাম/ কলা কলা সাগর কলা।’
একটু কাগজে মোড়ানো ঝাল মুড়ি। আহা কী স্বাদ! আব্বা দিতে চাইতেন না। বলতেন, ‘এগুলো খেয়ো না। পেট খারাপ করবে।’ ছোড়দা বলত, ‘পেট খারাপ হইলে কাকা ওষুধ দেবে।’ আব্বা বলত, ‘বাটার বন আছে সামনে। ভালো কলা পাইলে কিনব। এরপর সবাই খাবা।’ দেখি জোহরের নামাজের সময় হয়ে গেছে। ট্রেন ভৈরব স্টেশনে থামতেই আব্বা অজু করতে ট্রেন থেকে নেমে গেলেন। চাপকলের পানিতে আব্বা অজু করছেন। আমরা ভাই-বোন মিলে ট্রেনের জানালা দিয়ে সে অজু দেখছি আর বলছি, ‘আব্বা তাড়াতাড়ি করেন ট্রেন ছেড়ে দেবে।’ ট্রেনের হুইসিল পড়তেই দৌড়ে এসে আব্বা ট্রেনের দরজায় দাঁড়ালেন। যাক আমাদের আব্বা ঠিকমতো এসেছেন। এবার আমরা কলা বাটার বন খাব। না চাইতেই আব্বা ছয়টা হাঁসের ডিম সিদ্ধ কিনলেন। ইশ্‌ বাড়ি যাওয়া কত মজা হবে। উঠান ভরে সারা দিন খেলব। পুকুরে গোসল করব। পাখির মতো এ গাছ থেকে সে গাছে ঘুরে বেড়াব। ফল-ফলারি কামড়ে খাব। সন্ধ্যা হতেই ঘরে ঘরে হারিকেন জ্বলবে। হারিকেনের আলোয় সবার মুখখানা যেন আরও উজ্জ্বল দেখাবে। কেমন রঙিন স্বপ্নে ঘেরা। খবর পেয়ে দূরের পাড়া থেকে দাদুর ভাই আসবে। ‘ঢাকা থেকে কারা আসছেরে? দেখি দেখি ও মা তোরা? কত বড় হয়ে গেছে!’
হারিকেনের আলোয় গোল হয়ে সবাই পড়তে বসা। একসঙ্গে বসে খাওয়া। বোয়াল মাছ দিয়ে ভাত আহা কি সুস্বাদু সে ঝোল। কোথায় হারিয়ে গেল সে দিন। ট্রেনে চড়তে চড়তে মনে হলো স্মৃতি যেন বুকের ভেতর দাপটে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে চিন চিনে ব্যথা। ‘এটা কোন স্টেশন? পুবালী নাকি মধুগ্রাম! কি বলে আমি কোথায়?’ চারপাশে সবাই তো আমার অচেনা। এরা ইংরেজি বুঝে। এরা কবিতা বোঝে না। এদের আবেগ অনুভূতি কম। সপ্তাহ শেষে বেতনের টাকা অনায়াসে খরচ করে। হালাল-হারাম পাক-নাপাক এরা বোঝে না। নেই কোনো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বালাই। যেকোনো একটা পোশাকে দিন শুরু করে। এটা দিয়ে সারা দিন পার করে দিয়ে ঘুমাতে যায়। দুনিয়ার রং-তামাশায় বিশ্বাসী। ঝালমুড়ি না খেয়েও পরদিন সকাল থেকেই ছোড়দার পেটে ব্যথা। সেই সঙ্গে আমারও। কাকা-কাকা বলে দু ভাই-বোনের চিৎকার, যেন কাকা এলেই ভালো হয়ে যাব। ভোর হতে না হতেই বাড়ির বারান্দা ভরে যেত রোগীতে। কাকা চেম্বারে যাওয়ার আগে এই সব রোগীদের বিনা মূল্যে সেবা দিতেন। আমাদের কাছে দারুণ মজার ব্যাপার। তাই আমরাও রোগী হতে পারলে বর্তে যেতাম। বাড়তি সেবা পাওয়া যেত। এভাবে অনেকগুলো দিন একনিমেষে শেষ হয়ে যেত।
আবার ফিরে আসার পালা। বিদায়বেলায় ট্রেনের দরজা পর্যন্ত চাচাতো ভাই-বোনেরা এগিয়ে আসত। ট্রেনের জানালা দিয়ে ওরা আমাদের হাত ধরে রাখত যতক্ষণ না ট্রেন ছাড়ে। আহা কি মায়ার সে বাঁধন। হুইসিল পড়ামাত্র বুকটা ধক করে উঠত। ভাই-বোনেরা আমার এখন যাই, আবার কবে দেখা হবে জানি না। ‘আব্বা কি হবে ঢাকা গিয়ে? ঢাকার স্কুল, আর বাড়ির স্কুলে তফাৎ কী?’ ট্রেনে বসে চারপাশের সবুজ দেখতাম। কেমন সবুজ চাদরে মায়ার খেলা। দূরের গ্রামটা যেন করুণভাবে স্তব্ধ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকত। আস্তে আস্তে সে গ্রাম দূরে বহু দূরে নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে মিলিয়ে যেত। ট্রেনে এসে উঠল এক ভিক্ষুক। উঠেই গান ধরল। ‘আমার দিল কান্দে অন্তর পুড়েরে/ তুমি বিহনে আমি ভাসি সাগরে...’
বোরকার ভেতর থেকে যেন আম্মা কেমন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আব্বারও বোধ হয় মন খারাপ। আমাদের খুশি করার জন্য বললেন, ‘ঝাল মুড়ি খাবা?’ আমরা মাথা দুলিয়ে না করলাম। কী হবে এখন ঝালমুড়ি খেয়ে? কত বড় গ্রাম ফেলে চলে এলাম। এখন ওই একই ঢাকার ছোট বাসায় বন্দী। থাকা আর পড়াশোনা করা।’
পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগের ট্রেন রেলপথ স্টেশন সব আছে ঠিকঠাক। শুধু মাঝখান থেকে সেই মা-বাবা আজ আর নেই। সেই রেলপথের পাশে সবুজ মাঠের পাশে দুজনই চির নিদ্রায় শায়িত।
ট্রেনটা থামতেই বুকটা ধক করে ওঠে। কোথায় বাবা মা? কোথায় আমি? জানালা দিয়ে তাকাই। আমি আছি লেকজিনটন অ্যাভিনিউ, ফিফটি নাইনে। মাটির অনেক অনেক গহিনে। বাস্তবে ফিরে আসতে একটু সময় লাগে। একসময় আমার ট্রেনটি এসে থামে। ব্যাগ নিয়ে আমি বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হই। কারও দিকে তাকাই না। এরা কেউ আমার আপন নয়। বাসায় ছেলে-মেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। মা ছাড়া ওদের কেউ নেই। একসময় আমিও থাকব না। তখন কি ওরা আমার মত ট্রেনে বসে, আমাকে মনে করবে? আমার জন্য কাঁদবে?