অফিস, জিনিয়া ও একটি বিকেল

বনানী ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে আজ প্রায় ছয় মাস হতে চলল, অথচ ভয়টা আর গেল না। এই যেমন এখন আমি দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ভয়ে, কিন্তু ক্লায়েন্টকে তা বুঝতে দেওয়া যাবে না। মুখে মৃদু হাসি, হাতে সিগারেট। সিগারেট আমি নিয়মিত খাই বা পান করি, তা নয়। বললেই খাই, ব্যাপারটি এই রকম। এখন যেমন টানছি আর ক্লায়েন্টের সাথে খোশগল্প করছি। এটাও এক ধরনের ক্লায়েন্ট সার্ভিসের মধ্যে পড়ে। আমি শিখেছি এটা মজনু ভাইয়ের কাছ থেকে। মজনু ভাই আমার আগের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট অফিসের বস। তার কাছ থেকেই কাজ শেখা। আমি এই অফিসে আসার আগে তার সাথে পরামর্শ করার সময় অবাক করে দিয়ে বললেন দেখো, পরিবর্তন না করলে লস। একটু রিস্ক থাকে। কিন্তু বড় হতে গেলে রিস্ক নিয়ে এগোতে হয়। না হলে তুমি এগোবে, তবে ধীরে অনেক ধীরে।
মজনু ভাইয়ের জন্য এখনো খারাপ লাগে। খুব প্রাণখোলা মানুষ। শুরুতে কাজে অনেক ভুল হয়েছিল আমার। অবাক ব্যাপার, সিইও সাহেবকে উনি সামলেছেন। আমাকে বুঝতে দেননি। আরও অবাক হলাম আমাকে চাকরি পরিবর্তনের কথা বললেও তিনি কেন জানি একই অফিসে রয়ে গেলেন। এখনো দেখা হলে খোঁজখবর নেন।
-কেন রয়ে গেছেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দেননি। গুজব আছে সিওও শায়লা ম্যাডামের সাথে তার প্রেম। আমার চোখে সেভাবে পড়েনি। কিন্তু কথাটি অফিসে বেশ চাউর আছে। শায়লা ম্যাডাম বিবাহিত। তার একটি ছেলে আছে, যে এবার ও-লেভেল দেবে। স্বামী বিজনেসম্যান। প্রতি ঈদে বা বছরের শুরুতে শায়লা ম্যাডাম স্বামীসহ বিদেশভ্রমণ করেন নিয়মিত। প্রেমের গুজব ছড়ানোর মূল কারণ বোধ হয় দুজনেই একই সাথে আইবিএ থেকে এমবিএ করেছেন। তারও আগে দুজনেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ফিন্যান্স ও মার্কেটিং বিভাগে।
আগের কথায় আসি। ক্লায়েন্টকে বিদায় দিয়ে আমি ভাবতে বসলাম; আর আশ্চর্য হলাম আমার ভয় না কাটার জন্য। চাকরির প্রথম দিন দশতলা বিল্ডিংয়ের বারান্দায় প্রথমে পা দিয়েই ভয় পেয়ে গেলাম। হুহু বাতাস, আর ঝুল বারান্দাই হয়তো ভয়ের একটি কারণ। রেলিং ধরে উঁকি মারতেই মনে হলো কেউ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে। এই মনে হতেই প্রথমে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, তারপর হার্টবিট গেল বেড়ে। তারপর ভয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি বনানী কবরস্থান পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে প্রথমে মনে হচ্ছিল প্লেন থেকে দেখা বাড়িগুলোর মতো। আমি ভয়ে বারান্দার রেলিং না ধরে সরে এসে আস্তে আস্তে বারান্দার সুইং কাচের দরজার কাছে এসে কিছুটা ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। আমার কলিগরা অবলীলায় রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর সিগারেট ফুঁকছে। সাধারণত এই বারান্দায় সিগারেট টানার জন্যই সকলের আসা। হাওয়া খেতে বা আড্ডায় সঙ্গ দিতে মাঝে মাঝে মেয়েরাও আসে, যেমন আজ ক্লায়েন্ট সার্ভিসে শামিল হতে জিনিয়া উপস্থিত ছিল।
জিনিয়া প্রসঙ্গ আসতেই কেমন যেন মনে হতে থাকে আমার। প্রায় এক বছর হতে চলল, জিনিয়াকে ঠিক বোঝা হয়নি আমার। এই ব্যর্থতা আমার না জিনিয়ার, সেটা বুঝতে পারছি না। যেমন প্রথম দিনের পরিচয়ে আমাকে বলল,Ñহাসান ভাই-টাই বলতে পারব না, আমি হাসান বলব, সেই সাথে ‘তুমি’ বলব। সমস্যা নেই তো?
প্রথম দিন নার্ভাস ছিলাম। এই রকম প্রশ্নে আরও নার্ভাস হয়ে গেলাম। মৃদু হাসি দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলেছিলাম। পরে দেখতে পেলাম এমডি বাদে সকলকেই এই মেয়েটি অবলীলায় নাম ধরে ডাকে আর তুমি বলে। জানতে পারলাম জন্ম আর বেড়ে ওঠা লন্ডনে। তারপর কী এক কারণে পরিবারের সাথে ঢাকায় চলে আসা। নর্থ-সাউথে এমবিএটা শেষ করে এই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে জয়েন করেছে। জিনিয়ার ব্যাপারে আজ পর্যন্ত এতটুকুই জানা ছিল আমার।

২.
সকাল ১০টায় অফিস টাইম হলেও আমার মাঝে মাঝে একটু দেরি হয়ে যায়; আজই যেমন। দেরি হওয়াতে রিকশাকে তাড়া দিচ্ছিলাম তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য। অফিসের ঠিক কাছে রাস্তায় হঠাৎ ডাক শুনলাম।
-হাসান? অ্যাই হাসান...
আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি জিনিয়া। রিকশাঅলাকে থামাতে ইশারা করলাম। পেছন ফিরে তাকাতেই জিনিয়া বলে উঠল, তুমি রিকশা ছেড়ে দাও...
কোনো মেয়ের প্রতি সম্মান জানানো, না ভালো লাগা থেকে জানি না, রিকশা ছেড়ে দিলাম। জিনিয়ার কাছে যেতেই বললাম, আজ গাড়ি আনোনি?
জিনিয়া নিয়মিত গাড়ি করে আসে। গাড়িটি ওদের পারিবারিক। আমার প্রশ্নে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলল।
-চলো তাহলে।
বলেই আমি হাঁটতে যাব, দেখি জিনিয়া দাঁড়িয়ে আছে।
-দাঁড়িয়ে কেন? চলো।
-না, অফিসে যাব না।
-কেন? কোনো সমস্যা? কিছু হয়েছে?
-সমস্যা-টমস্যা কিছু নয়, আজ অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না।
-ঠিক বুঝলাম না ...
-অত কথা বলতে পারব না। আজ যেতে ইচ্ছে করছে না, ব্যস। তুমি কি আমার সাথে যাবে?
আমার অবাক হবার পালা। জিনিয়া অফিস করবে না, কেন করবে না তাও বলছে না। তার ওপর আমার কাছে জানতে চাচ্ছে-আমি যাব কিনা? বোঝার চেষ্টা করলাম, বুঝতে পারলাম না।
-কোথায় যাব?
-পরিকল্পনা করিনি এখনো। একা যেতে ইচ্ছে করছিল না। তাই ওয়েট করছিলাম তুমি যাবে কিনা?
-ঠিক বুঝলাম না। অফিসে আমার আজ জরুরি মিটিং রাশেদ ভাইয়ের সাথে।
রাশেদ ভাই আমার বস। কোম্পানির হেড অব ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। খুবই সজ্জন মানুষ। আর প্রচণ্ড রিলাই করেন আমাকে। কাল আমাকে সময় না দিতে পারায় বলেছিলেন নতুন প্রোজেক্ট নিয়ে আজ বসবেন ১১টার দিকে। আমি যেন সবকিছু গুছিয়ে রাখি। এই অবস্থায় জিনিয়া অফিসে যেতে বারণ করছে। আমাকে চুপ থাকতে দেখে জিনিয়ার বলে উঠল, অসুবিধা হলে যাওয়ার দরকার নেই। আমি একাই যেতে পারব।
আমি পুরোটাই ধন্দে পড়ে গেলাম। জিনিয়া কি বলতে চাচ্ছে? একবার বলছে কোথায় যাবে জানে না। আবার বলছে একাই যেতে পারবে। আসলে মেয়েটি যাবে কোথায়? তা ছাড়া আমাকেই বা যেতে বলছে কেন? কোনো দিন তো এমন মনে হয়নি যে, সে আমাকে খুব পছন্দ করে! আজ কি হলো মেয়েটার। অনেক প্রশ্নের মধ্যে আমি অন্য কিছু জানতে চাইলাম, এই না বললে জানো না? আবার বলছ একাই যেতে পারবে, বুঝলাম না?
-আমি তো যাবই। তুমি ডিসাইড করো কী করবে? এই রাস্তা দিয়ে অফিসের অনেকে যাতায়াত করে। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে। আমি চললাম...
বলেই জিনিয়া হাঁটতে শুরু করল। আমি পড়লাম দোটানায়। একদিকে অফিসের জরুরি মিটিং, অন্যদিকে জিনিয়ার হঠাৎ অদ্ভুত প্রস্তাব। এ অবস্থায় আমি জিনিয়ার পিছু নিলাম। কোনো মেয়ের হঠাৎ আহ্বান, নয়তো অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় জিনিয়ার পিছু নিলাম আমি।
জিনিয়ার সাথে হাঁটার সময় হঠাৎ জিনিয়া জানতে চাইল, দূরে কোনো জায়গা আমার চেনা আছে কিনা। আমি সেভাবে কিছু বলতে পারলাম না। জিনিয়া উবার কল করল। চার মিনিট অপেক্ষাতেই উবার সামনে এসে উপস্থিত। দুজনেই উঠে পড়লাম।
-তুমি অফিসে কল করেছ?
-নাহ্!
-আশ্চর্য! অফিসে যে যাচ্ছ না, তা বলতে হবে না!
আমি এবার ঘাবড়ে গেলাম। কি বলব রাশেদ ভাইকে? তিনি খুব ডিপেন্ড করেন আমার ওপর। জিনিয়া মিথ্যে কথাটা শিখিয়ে দিল। প্রচণ্ড ফুড পয়জনিং, আসার মতো অবস্থা নেই। বলার পর খারাপ ও ভালো দু রকমের বোধ হতে লাগল। খারাপটা হচ্ছে রাশেদ ভাইকে মিথ্যা বলা। আর দুই, জিনিয়ার সাথে একান্ত কিছুটা সময় কাটানোর আনন্দ। এখানে আমার কিছুটা অন্যরকম অনুভূতি হতে থাকল। জিনিয়ার কিছু কি হচ্ছে? দেখে বোঝার উপায় নেই।

৩.
আমরা এখন এসেছি উয়ারি বটেশ্বরে। নরসিংদীতে। মূল রাস্তা থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। রেন্ট-এ-কার করে এখানে এসেছি। আমার কাছে খুব বেশি টাকা ছিল না। তারপরও টাকা দিতে গেলেই জিনিয়া ধমকাচ্ছে।
-তোমার তো হঠাৎ বেরোনোর ইচ্ছে ছিল না। টাকা দেবে কেন? যেদিন তোমার ইচ্ছেতে বের হবে, তখন দিও।
আমি কিছুটা সোজা-শান্ত ছেলে হয়েই জিনিয়ার সাথে চলছি। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের সভ্যতা ছড়িয়ে আছে এখানে। মাটির নিচে একটি ঘরের মধ্যেই থাকা-বসা-রান্না-বাথরুম, অবাক ব্যাপার। এরপর আমরা মিউজিয়াম যাই। সেখানে খনন করার পর প্রাচীন নিদর্শন বলতে মূলত ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখলাম। বের হওয়ার পর আমরা হাঁটছি। হাঁটার পথে লক্ষ করলাম প্রতিটি বাড়িতে আম ও লটকন গাছের আধিক্য। জিনিয়া কিছু বলছে না, আমিও সেভাবে কিছু বলতে পারছি না। মিউজিয়াম থেকে বের হতেই জিনিয়া বলল, চলো হাঁটি।
আমরা এক সাথে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছু দূর হেঁটে দেখতে পেলাম ধানক্ষেত। রাস্তার পাশে ধানক্ষেতের আগে উঁচু জায়গায় বসে পড়লাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে জিনিয়া বলল, আমি জানতাম তোমাকে বলা যায়। তুমি বললেই আসবে।
আমি জিনিয়ার কথা শুনছি, আর কেন জানি হৃৎকম্পন হচ্ছে খুব। জিনিয়া বলতে থাকে, জামিকে বলতে পারতাম। কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হলো, না, তুমি হচ্ছ সেই ব্যক্তি যাকে বলতে পারি।
কি বলবে জিনিয়া? জামিকেই বা ভেবেছিল কেন? ইত্যাদি প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে।
-তোমাকে নিয়ে প্লেজার ট্রিপ ব্যাপারটি ঠিক তেমন না। আমার মন ভালো নেই।
আমি বুঝতে পারছি না কি বলব। জিনিয়া আবার বলতে শুরু করল, তোমাকে বলা হয়নি, আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসতাম। ছেলেটির নাম আর নাই বলি, ওর সাথে কাল আমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে।
এরপর জিনিয়া চুপ হয়ে যায়। আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। আমি তো প্রেমই করিনি, আর ব্রেকআপ? সেটা তো আমার বোঝার অনেক পরে। এই ক্ষেত্রে কি বলব বুঝতে পারছি না। জিনিয়া একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল,Ñকি? কিছু বলছ না যে? তুমি হয়তো কিছু একটা এক্সপেক্ট করছিলে। এই রকম নিভৃতে প্রেমের কথা বলবার জন্যই আসছি, এই তো! তোমরা সকলেই এক।
-না। আমি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসিনি। বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। জিনিয়া কি বলে শুনেই নেই না। পরবর্তীতে ভুল তো ভাঙানো যাবে।
-আসলে দোষটা আমারই। আমি কেন যেন ওকে ভালোবাসতে গিয়েছিলাম। ঘর করতে গেলে সবার আগে প্রয়োজন বিশ্বাস। ওর সবকিছুতেই সন্দেহ। কেন ওর সাথে মিশছ, কেন আমাকে এটা বলোনি, সেটা বলোনি ইত্যাদি ইত্যাদি। ওর সাথে আমার প্রেম চাকরি করার পর থেকে, কিন্তু আজ কদিন ধরে বলছে, মা-বাবা তোমার এই চাকরিটা পছন্দ করছে না। ব্যাংকে অথবা অন্য কোনো অফিসে চাকরি করতে হবে। তুমি বলো, এটা কি মেনে নেওয়া সম্ভব? কাল যখন বিয়ের জন্য চাকরির শর্ত জুড়ে দিল, আর চুপ থাকতে পারলাম না। মেনে নিয়ে বিয়ে করলে হয়তো ওই চাকরি নিয়ে অন্য কথা বলত। বাবার ব্যবসাই যে ছেলের ভবিষ্যৎ, সে ছেলে এত কথা বলে কিভাবে? কি বলো? ঠিক করেছি না।
-হ্যাঁ, তুমি ঠিক কাজটিই করেছ! কিন্তু এই কথাটি বলার জন্য এখানে কেন? সেটা তো বুঝলাম না?
-আমি বিশ্বাস করি যে, সব কথা সব জায়গায় বলা যায় না। তাই এখানে আসা। অফিসে তোমাকে আমার অন্য ধরনের মনে হয়েছে। বলে নেই, কয়েকজন ইন্টারেস্ট দেখায়নি তা নয়, কিন্তু আমি পাত্তা দিইনি। পরে তারাও থেমে গেছে। তুমি ব্যতিক্রম। সরি...
-কেন?
-ওই যে তোমাকে বলে ফেললাম, তোমরা সকলেই এক। ভেবেছ প্রেমের কথা বলবার জন্যই আসছি।
-তোমার কি ভুল ভেঙেছে?
-হ্যাঁ...
-তাহলে চল।
দুজনেই উঠে পড়লাম। একজনের অনুভূতি হৃদয়ের কষ্টটা হালকা করার, আর অন্যজনের হৃদয় কষ্ট চেপে রাখার। এই কথাটি কেন মনে হলো আমি জানি না।