'তারে আমি চোখে দেখিনি'

সৈয়দ ইকবাল হাসান
সৈয়দ ইকবাল হাসান

‘তারে আমি চোখে দেখিনি/ তার অনেক গল্প শুনেছি’, মুকুল দত্তের লেখা এই গান গেয়েছেন কিশোর কুমার, সুর করেছেন লতা মঙ্গেশকার। কবি ইকবাল হাসানের বিষয়টি প্রায় এমনই। তাঁর অনেক গল্প না শুনলেও অল্প-স্বল্প গল্প আমি শুনেছি লেখক বন্ধুদের কাছে, অগ্রজদের কাছে। মাঝে মাঝে তাঁকে আমি গুলিয়ে ফেলতাম তাঁরই আরেক বন্ধু সৈয়দ ইকবালের সঙ্গে। ইকবাল হাসানকে আমি প্রথম দেখি নিউইয়র্কে, কবি শহীদ কাদরীর ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’য়। শহীদ কাদরী নিউইয়র্কে একটি কবিতার আড্ডা জমিয়ে তুলেছিলেন। ত্রৈমাসিক এই আড্ডায় নিউইয়র্কের বাঙালি কবিদের পাশাপাশি ঢাকা/কলকাতার এবং নানান দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালি লেখক/কবিরা প্রায়শই যোগ দিতেন। এমন না যে ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’য় যোগ দিতেই তাঁরা উড়ে আসতেন। কোনো কারণে নিউইয়র্কে বা আমেরিকায় কেউ এলে, ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’য় যোগ দেওয়ার তাগিদ অনুভব করতেন।

ইকবাল হাসান থাকেন কানাডার থান্ডার বে এলাকায়। আমি বলি ঠান্ডার বে। ওখানে শীতে তাপমাত্রা নেমে আসে হিমাঙ্কের নিচে ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কোন আগুন কবিকে উষ্ণ রাখে এই ভয়ানক শীতে? কবি নিজেই তা ফাঁস করে দিয়েছেন, ‘দুপুরেই প্রকৃতিকে আরেকবার নগ্ন হতে হলো/ ফ্যানের ব্লেডের নিচে, অমসৃণ কার্পেটের ওপর/ বারান্দায় ছিল কাক; উড়ে গেল/ পলায়নপ্রিয় পাখির জন্য দুপুরই প্রকৃষ্ট সময়/ সহসা তাকিয়ে দেখি,/ তোমার ধবল পিঠে বসে গেছে দুপুরের দাগ’ (কবিতা- দুপুর-২)। তো ইকবাল হাসানকে কিন্তু শহীদ ভাই দাওয়াত দিয়েই আনেন। এবং শহীদ কাদরীর দাওয়াত পেয়েই ইকবাল হাসান থান্ডার বে থেকে উড়ে আসেন নিউইয়র্কে। শহীদ কাদরী যেমন কম লিখতেন, তেমন কম প্রশংসাও করতেন অন্য কবিদের। আমি লক্ষ্য করলাম শহীদ ভাইয়ের মধ্যে ভীষণ ইতিবাচক একটি মনোভাব ইকবাল হাসানের প্রতি, যা মূলত তাঁর কবিতার প্রতিই। শহীদ ভাইয়ের এই আগ্রহ তাঁর প্রতি আমাকেও আগ্রহী করে তোলে।

আমি মন দিয়ে শুনছিলাম তাঁর কবিতা। অনেকগুলো কবিতা পড়ে শোনালেন ‘হাস্কি’ কণ্ঠে। কবির কণ্ঠ যেমনই হোক, কবিতা যদি সুখপাঠ্য হয়, আর উচ্চারণ শুদ্ধ, মিলনায়তন মুহূর্তেই হয়ে ওঠে দেবালয়। শ্রোতা-দর্শক মাতানোর কায়দাটিও ইকবাল হাসান ভালোই জানেন। ‘ফ্রি ভার্সে’র ফাঁকে ফাঁকে রসঘন সমিল প্রেমের কবিতা ছেড়ে দিচ্ছিলেন। মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তের দোলায় তখন আর সকলের মতো আমিও দুলছিলাম। সেই থেকে কবি ইকবাল হাসান আমার বন্ধু, প্রাণের মানুষ।

প্রতি বছরই তিনি নিউইয়র্কের বইমেলায় আসেন। তাঁকে আমার কাছে খুব সোজা-সাপ্টা ও উদার মানুষ মনে হয়েছে। আমি যখনই ঢাকার কোনো সাহিত্য সম্পাদকের ইমেইল ঠিকানা বা ফোন নম্বর চেয়েছি, তিনি মুহূর্ত বিলম্ব না করে দিয়ে দিয়েছেন। এই উদারতা বাঙালি কবিদের মধ্যে খুব কম দেখা যায়। গোষ্ঠীবদ্ধতার কারণে অনেকেই গোষ্ঠীর বাইরের কারও উপকার করতে চান না। ইকবাল হাসানকে আমার গোষ্ঠীমুক্ত কবি মনে হয়েছে।

২০১৭ সালের নিউইয়র্ক বইমেলায় তিনি একটি সেশন পরিচালনা করছিলেন। সেখানে পবিত্র সরকার, শামসুজ্জামান খানসহ লেখক/কবিদের অনেকেই ছিলেন। তিনি হঠাৎ ক্রিয়াপদহীন কবিতার প্রসঙ্গটি তোলেন এবং এটি যে আমিই প্রবর্তন করেছি, তা অকপটে বলে দেন। অগ্রজ কবিরা প্রকাশ্যে এ ধরনের স্বীকৃতি অনুজদের দিতে প্রায়শই কুণ্ঠাবোধ করেন।

২০১৭ সালের মেলায় আমাদের একটি স্টল ছিল। ‘স্বপ্নশিকারি’ ব্যানারে। আমরা জেলখানাহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। আমরা চাই মানুষ সর্বার্থে মুক্ত হোক। আমাদের স্টলে সারাক্ষণই বসে ছিলেন কবি ইকবাল হাসান। পাঠকদের হাতে বই তুলে দেওয়া, সই করা, ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল তুমুল আড্ডা। মাঝে মাঝে বই খুলে আমরা নিজেদের কবিতাও একে অন্যকে পড়ে শোনাচ্ছিলাম। চলন-বলন, আচার-আচরণে যেমন ঘোরপ্যাঁচ নেই, তেমনি ঘোরপ্যাঁচ নেই তাঁর কবিতায়ও। কিন্তু অতি সুকৌশলে সারল্যের গভীরে তিনি প্রোথিত করেছেন সুগভীর শিল্পবোধ। ‘তুমি কি শুধুই রং ও তুলির খেলা/ কুহক জড়ানো নির্ঘুম কালো রাত/ ছায়া হয়ে শুধু ঘোরার ভেতরে ঘোরা/ নিজের আগুনে নিজেকেই শুধু পোড়া/ পুড়তে পুড়তে পড়ে আছে শুধু ছাই/ কিছুই পাবো না জেনেও তোমাকে চাই’ (কবিতা— কুহক)। একেবারে সোজাসাপ্টা চাওয়া। কিন্তু যখন বলেন, ‘পড়ে আছে শুধু ছাই, কিছুই পাব না জেনেও তোমাকে চাই’, তখনই এই সোজাসাপ্টা চাওয়ার সাথে যুক্ত হয়ে যায় একই সঙ্গে শিল্প ও গভীর জীবনবোধ। এখানেই ইকবাল হাসান তাঁর সব সারল্য ও স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং হয়ে ওঠেন আধুনিক কবি।

কবিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন হতে হয়। ধারালো দৃষ্টির আলোকে স্পষ্ট করে তুলতে হয় আর সকলের অদেখা জগৎ, সেই জগৎ যত ক্ষুদ্রই হোক। ‘তোমার শরীরে শীত, আমি ঘামি দুপুরের রোদে।/ পাতা ঘামে, গাছ ঘামে, ঘামে দেখি শালিখ চড়ুই/ আর দুপুরের কাক/ তোমার শরীর কিন্তু কখনো ঘামে না।/ পাশাপাশি হাঁটি, হুডতোলা রিকশায় যাই/ তোমার শরীরে শীত, আমি ঘামি মিরপুর রোডে।/ সহসা তাকিয়ে দেখি,/ তোমার চোখের নিচে ফুটে আছে দুপুরের ঘাম’ (কবিতা- দুপুর-৫)। কী অসাধারণ দক্ষতায় কবি উপস্থাপন করলেন নারীর কামতৃষ্ণা তাঁর চোখে, অন্য কোথাও নয়।