সামাজিক প্রেক্ষাপট ও তাৎপর্য

বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের বিশ্ব সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ কম নয়। বিশ্ব সাহিত্য আস্বাদনে বাঙালি পাঠকের মূল ভরসা বাংলায় অনুবাদ ও ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসন সূত্রে লব্ধ ভাষা ইংরেজি রচনার মাধ্যমে। অন্য কোনো ভাষায় দখল সম্পন্ন বাঙালির সংখ্যা খুবই কম বলে সেসব ভাষার মূল রচনা থেকে পাঠের সুযোগ সীমিত অল্প কিছু মানুষের মধ্যে।

আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আর্থিক সামর্থ্য বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের সকল প্রান্তের সঙ্গে বাঙালির সব ধরনের যোগাযোগ আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। ব্যবসায় ও কর্মসূত্রে, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও প্রদান করতে, ভাগ্য অন্বেষণে এবং অভিবাসনের কারণে বাঙালি এখন পৌঁছে গেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। প্রায় প্রতিটি দেশে। ফলে এসব দেশ, দেশের মানুষ, প্রকৃতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনীতি, ধর্মবিশ্বাস, জীবন-যাপন পদ্ধতি ও সামাজিক ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগ্রহও বেড়েছে বাঙালির আগের চেয়ে বহু গুণে। এই আগ্রহ কেবল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণকারী বাঙালি অথবা বিদেশে আবাসন গেড়ে বসা এক কোটির বেশি বাঙালির কাছে নয়। বাঙালির মূল ভূখণ্ডে তাদের রেখে আসা আত্মীয়-পরিজন ও শুভানুধ্যায়ীদেরও। প্রবাসে সন্তান ও প্রিয়জন কেমন পরিবেশে ও কেমন মানুষের মাঝে বাস করছে তা জানার আগ্রহ তাদের চিরন্তন। আর এদের সংখ্যাই বিপুল।

অথচ জ্ঞান আহরণে তাদের এই বিপুল তৃষ্ণা মেটানোর জন্য মাত্র অল্প কয়েকটি দেশ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থ ও প্রকাশনার সংখ্যা সামান্যই। সেসব দেশের সাহিত্য নিয়ে প্রকাশনা আরও সীমিত।

পৃথিবীর সুন্দরতম দেশগুলোর অন্যতম কানাডায় বাঙালির অভিবাসনের ইতিহাস সেই ১৯৫০-এর সময় থেকে। সাত দশক। তবে লক্ষাধিক বাঙালি অভিবাসী হয়েছে গত দুই দশকে। পেশাজীবী ও শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের আগমনে কানাডায় বাঙালির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। সেই সঙ্গে অভিবাসী বাঙালির কাছে ও তাদের জন্মভূমিতে বাড়ছে কানাডার সমাজ ও জীবন সম্পর্কে আগ্রহ।
এ অবস্থায় কানাডার মানুষের জীবন ও মনোজগৎ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ও সাহিত্য পিয়াসী বাঙালির তৃষ্ণা মেটাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কানাডায় বাঙালি অভিবাসী ও গবেষক সুব্রত কুমার দাসের অত্যন্ত পরিশ্রমলব্ধ গবেষণা গ্রন্থ ‘কানাডীয় সাহিত্য: বিচ্ছিন্ন ভাবনা’।
বাংলাদেশে এ বছরের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় সদ্য প্রকাশিত এই গ্রন্থের আগে বাংলা ভাষায় কানাডীয় সাহিত্য নিয়ে এমন প্রতিনিধিত্বশীল কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না।

গ্রন্থের সূচনায় ‘প্রাককথন’ ও ‘কানাডীয় সাহিত্য: একটি ভূমিকা’ শীর্ষক দু’টি অমূল্য পর্ব ছাড়াও ‘কানাডীয় সাহিত্যে বিশ্বসাহিত্যের স্বাদ’ ও ‘প্রসঙ্গ: ক্যানলিট’ নামের অধ্যায় দু’টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
কেননা, কানাডীয় লেখকদের সাহিত্য কীভাবে বিশ্বসাহিত্যের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছে তা এ দেশের লেখকদের রচনা ও বক্তব্যের উদ্ধৃতি এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য সহযোগে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেছেন সুব্রত প্রথম অধ্যায়ে। কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশিত কানাডা পরিচিতি পুস্তিকার প্রারম্ভেই উল্লেখ ছাড়াও এ কথা সর্বজনবিদিত যে, ‘অভিবাসীদের দেশ কানাডা’। অল্প কিছু আদিবাসী ছাড়া কানাডার অধিবাসী সবাই ভিন দেশ থেকে আগত অভিবাসী অথবা অভিবাসীদের বংশধর। সঙ্গত কারণেই সেই একদা অভিবাসী, বর্তমানে কানাডীয় লেখকদের রচনায় উঠে এসেছে তাঁদের মাতৃভূমি ও পিতৃভূমির চালচিত্র। আর এভাবেই বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের সমাজ, জীবন ও মানবিক অনুভূতির রূপ ও রস এই লেখকদের মাধ্যমে কানাডার সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে বিশ্বসাহিত্যে রূপায়িত করেছে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই তা তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন কানাডার বাঙালি এই লেখক। তিনি যথার্থই বলেছেন, “হয়তো কখনো কখনো লেখক নিজে জন্মগ্রহণ করেন কানাডাতেই, কিন্তু তাঁর পিতৃ-মাতৃ পুরুষের ছিল ভিন্ন দেশ। আর তাই প্রায়শই দেখা যায় কোনো কোনো লেখক অনুসন্ধান চালান তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির। তাঁদের রচনায় উঠে আসে সেই ভিটের চিত্র, সেই মাটির গন্ধ। এবং এটিই কানাডার ঔদার্য যে, ভিন্ন ভিটের চিত্র, ভিন্ন মাটির গন্ধকে নিজের করে নিতে কানাডা একটুও পিছপা নয়। প্রশাসনিকভাবে নয়, সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণেও নয়।”

আর ‘ক্যানলিট’ অধ্যায়ে কানাডার সাহিত্যের নিজস্বতা যে কালক্রমে নতুন এক স্বতন্ত্র অভিধায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে, তার ঐতিহাসিক পটভূমি তুলে ধরেছেন তিনি সংক্ষিপ্ত অথচ প্রয়োজনীয় তথ্যের সমাহারে।
আটাশ জন কানাডীয় লেখক ও তাঁদের রচনা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়ে নানা দৃষ্টিভঙ্গিতে সহজ ভাষায় যে ব্যবচ্ছেদ সুব্রত করেছেন তা অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও আগ্রহ উদ্দীপক। তার সাহিত্য মূল্য নিয়ে আলোচনা করবেন বাংলা ভাষার সাহিত্য গবেষকেরা।

আমি কেবল আলাদাভাবে উল্লেখ করতে চাই, গ্রন্থের প্রথম পর্ব ‘প্রাককথন’ নিয়ে। যে পর্বে গবেষক সুব্রত নতুন মহাদেশ আবিষ্কারের মতোই ধীরে যেভাবে কানাডার সাহিত্যের ভেতরে প্রবেশের দ্বার খুঁজে বের করেছেন, কানাডার গ্রন্থাগারিক ও সাহিত্যপ্রেমীদের সাহচর্যে ও পরামর্শে এবং সর্বোপরি, নিজের অনুসন্ধিৎসু মনের নিরন্তর তাগিদে, তার সরস বর্ণনা এক অমূল্য সম্পদ এই গ্রন্থের। এই ‘প্রাককথন’ কেবল একজন গবেষকের গবেষণা পদ্ধতির নিজস্বতার সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দেয় না, কাজ করে গরিষ্ঠ বাঙালির কাছে অনালোকিত কানাডার বা বিশ্বের যেকোনো দেশ ও ভাষার সাহিত্য নিয়ে আগ্রহী অনুগামী পাঠক ও গবেষকদের জন্য এক আলোকবর্তিকা হিসেবে। প্রণোদনা জোগায় নতুন দেশ ও ভাষার সাহিত্য নিয়ে পাঠের, গবেষণার ও নিজে রচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার।

গবেষণা গ্রন্থ হলেও সবার জন্য চলতি ভাষায় সুব্রত কুমার দাসের প্রাঞ্জল উপস্থাপন শৈলী গ্রন্থটিকে সহজবোধ্য করেছে। চিরাচরিত গবেষণামূলক রচনা পাঠের একগুঁয়েমি থেকে মুক্ত রেখে প্রতিটি পর্বকে আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য করে তুলেছে।
প্রাথমিকভাবে যে বিষয়গুলো এই গ্রন্থের ঘাটতি বলে মনে হতে পারে তার উল্লেখ বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

গ্রন্থসূচিতে দৃষ্টিপাত করলে প্রথমেই লক্ষ করা যাবে যে কানাডার শীর্ষস্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে সুপরিচিত লেখকদের বেশির ভাগই এই তালিকায় বা গ্রন্থে স্থান পাননি। যেমন, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রথম কানাডীয় এলিস মুনরো, ম্যানবুকার পুরস্কার বিজয়ী মার্গারেট অ্যাটউড ও মাইকেল ওন্দাটজি এবং এম জি ভাসানজি, রোহিনতন মিস্ত্রি ও ইয়ান মার্টেল। এমনকি হালের জনপ্রিয় তরুণ কবি রূপী কাউর।
প্রথম দর্শনে গ্রন্থে এ সব লেখকের অনুপস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক মনে হবে। কিন্তু ‘প্রাককথন’-এ তাঁদের অনুপস্থিতির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন লেখক, তা খুবই যৌক্তিক মনে হবে। কারণ হিসেবে দুটি বিষয় উল্লেখ করেছেন তিনি। প্রথমত: সুপরিচিত এই লেখকেরা বৃহত্তর বাঙালি পাঠকদের কাছে কিছুটা হলেও পরিচিত। তিনি মূলত: দৃষ্টিপাত করতে চেয়েছেন বাঙালি পাঠকের কাছে অপরিচিত ও অনালোকিত, কিন্তু এ দেশে পাঠকের কাছে প্রিয় ও বিবিধ সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত লেখকদের প্রধান কয়েকজনকে। দ্বিতীয়ত: এই গ্রন্থে নির্বাচিত লেখকদের জন্য তিনি যে পাঁচ থেকে ১২ পৃষ্ঠার পরিসরে পরিচিতি তুলে ধরেছেন ও রচনা নিয়ে আলোচনা করেছেন, কানাডার শীর্ষস্থানীয় ওই সব লেখকদের জন্য এই ক্ষুদ্র পরিসর একেবারেই অপর্যাপ্ত। আশার কথা, সুব্রত জানিয়েছেন এই লেখকদের নিয়ে তাঁর সবিস্তারে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে।

আরেকটি বিষয় হলো, কানাডার আদিবাসী লেখকদের অনুপস্থিতি। কেবল আদিবাসী লেখক নয়, আদিবাসীদের জীবন ও সমাজ নিয়ে অপর কোনো কানাডীয় লেখকের রচনাও অনুল্লেখ থাকা। কানাডা নামের আজকের এই ভূখণ্ডে ইউরোপীয়রা এসে বসতি স্থাপন করেছে চার শ’ বছরের কিছু আগে। কিন্তু এখানে আদিবাসীদের বাস তার আগে থেকেই হাজার বছর ধরে। তাদের সেই সময়ের জীবন, ভাবনা ও সংস্কৃতি নিয়ে এবং ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের আগমনের পর আদিবাসীদের সঙ্গে ইউরোপীয়দের যে সংঘাত, সম্পর্ক ও তার দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া নিয়ে রচিত সাহিত্যের কিছুটা উপস্থিতি গ্রন্থটিকে আরও প্রতিনিধিত্বশীল করে তুলত সন্দেহ নেই।

কানাডার সাবেক গভর্নর জেনারেল ও শিক্ষাবিদ ডেভিড জনস্টোন-এর ‘কানাডার ধারণা: একটি জাতির কাছে পত্র’ (The Idea of Canada: Letters to a Nation) গ্রন্থে আদিবাসী এক বালকের কাছে লেখা তাঁর পত্রে যেভাবে নিজের পরিচয় তুলে ধরার কথা এই গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যেই নিহিত রয়েছে চার শ’ বছরের বেশি সময় এক ভূখণ্ডে বাস করেও ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের প্রতিনিধি লেখক ডেভিডের সঙ্গে আদিবাসীদের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি এক বালকের বোঝাপড়ার বিপুল দূরত্ব। উভয় সমাজের সম্পর্কের মাঝে হিমালয়সম প্রাচীরের উপস্থিতি। গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক কানাডার আদিবাসীদের সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি উল্লেখ করলেও এই দূরত্ব, অবিশ্বাস ও সহাবস্থান নিয়ে রচিত সাহিত্যের ওপর আলোকপাত ছাড়া কানাডীয় সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা সম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে কী?
তবে যেহেতু এই গ্রন্থের শিরোনাম ‘কানাডার সাহিত্য: বিচ্ছিন্ন ভাবনা’ থেকেই স্পষ্ট যে গবেষণা গ্রন্থটি কানাডার সাহিত্য নিয়ে একটি সর্বাত্মক আলোকপাত নয়, বিচ্ছিন্ন ভাবনা, সেহেতু লেখককে ছাড় দেওয়াই যায়। বরং তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া যায় বিশেষভাবে এ কারণে যে কানাডার সাহিত্য নিয়ে বাংলায় গ্রন্থ রচনা করে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষী ছাড়াও কানাডার ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী সব ধরনের সাহিত্যের প্রতি বাঙালির আগ্রহের সলতে উসকে দিতে সহায়তা করছেন তিনি।

একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ বোধকরি এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বাংলাদেশে কানাডার দূতাবাসে তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে আমি যোগ দেওয়ার প্রায় এক বছর পর, ১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে, কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারের ও পররাষ্ট্র দপ্তরের বাজেটে বরাদ্দ কাটছাঁটের কারণে হঠাৎ করেই কয়েকজন কূটনীতিক ও স্থানীয় কর্মী ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি দূতাবাসের গ্রন্থাগারটি বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় গ্রন্থাগারের হাজার তিনেক গ্রন্থ দুই দিনের মধ্যে সরিয়ে ফেলার। দূতাবাসের সহকর্মীদের মধ্যে বইগুলো বিলিয়ে দেওয়ার সময় আমি নিজে গোটা পনেরো বই বাছাই করি নিজের সংগ্রহের জন্য। কিন্তু বই বাছাইয়ের সময় কানাডার কোনো শীর্ষস্থানীয় লেখকের লেখার সঙ্গে পরিচয় না থাকার কারণে এক এলিস মুনরোর একটি গল্পগ্রন্থ ও আর দু/একটি সাহিত্য ছাড়া আর সব বই-ই ছিল কানাডার সমাজ, ইতিহাস ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে লেখা। নন-ফিকশন। কারণ, কানাডার সাহিত্য নিয়ে সুব্রত কুমার দাসের এই বাংলা গ্রন্থের মতো কোনো ইংরেজি বই আমার সামনে ছিল না যা লেখক বাছাই করতে সহায়তা করতে পারে।
বাঙালি পাঠকের এখন আর সেই সমস্যা রইল না। এই গবেষণা গ্রন্থটি কানাডীয় সাহিত্যের একটি লেখকপঞ্জি ও গ্রন্থপঞ্জির চেয়ে বেশি কিছু বাঙালির জন্য। উল্লিখিত ২৮ জন লেখক ছাড়াও ‘প্রাককথন’ পর্ব ও ‘কানাডীয় সাহিত্যে বিশ্ব সাহিত্যের স্বাদ’ অধ্যায়ে আরও বহু কানাডীয় লেখক ও তাঁদের রচনার উল্লেখ রয়েছে। যা অনুসন্ধিৎসু পাঠকের প্রাথমিক দিক নির্দেশনার জন্য আপাতত: যথেষ্ট।

এই গবেষণা গ্রন্থের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো বাঙালির নিজস্ব ভূখণ্ডের সাহিত্য অনুরাগী ও বৃহত্তর পাঠক ছাড়াও কানাডায় অভিবাসী বাঙালির কাছে গ্রন্থটির গুরুত্ব। এ দেশে আগত বাঙালির গরিষ্ঠ অংশই পেশাজীবী, শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সদস্য। বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। এ দেশে আগমনের পর তাদের প্রথম তিন থেকে পাঁচ বছর কেটে যায় বাসস্থান, কর্মসংস্থান ও সন্তানের শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশের দিকে। সেই সময়ে ও বিশেষ করে, নতুন বসতির দেশে স্থিত হওয়ার পর তাদের প্রয়োজন হয় মনের খোরাকের দিকে। অবসরে বিনোদন, ভ্রমণ ও খেলাধুলার পাশাপাশি সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ নতুন করে সঞ্চার হয়। মাতৃভূমি থেকে সংগ্রহ করা বাংলা ভাষার সাহিত্য এবং সাম্প্রতিককালে অনলাইনে পাওয়া পত্র-পত্রিকা ও রচনাবলীতে নিবদ্ধ থাকেন বেশির ভাগ সাহিত্য অনুরাগী।

কিন্তু যে ভূখণ্ডে তাদের নতুন আবাস, সেই দেশের সঙ্গে আত্মস্থ হতে সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাঠ গ্রহণে ঠিক কী গ্রন্থ বেছে নেওয়া প্রয়োজন, তার সহায়ক হিসেবে এই গবেষণা গ্রন্থটির মূল্য অসামান্য। গ্রন্থটি কানাডীয় সাহিত্যের রস আস্বাদনে উদ্বুদ্ধ করার সঙ্গে বাঙালি অভিবাসীদের কানাডার সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মীকরণের ক্ষেত্রেও এক সেতুবন্ধনের জন্য প্রথম অথচ গুরুত্বপূর্ণ সোপান হিসেবে কাজ করবে। উল্লিখিত লেখকদের রচনার সঙ্গে পরিচয়ের পথে অগ্রসর হতে এটি সহায়ক হবে।

কানাডার সংস্কৃতির সঙ্গে আত্মীকরণে সংযোজক হিসেবে গবেষণা গ্রন্থটির এই ভূমিকার কারণে কানাডায় আগত প্রতিটি বাঙালি অভিবাসীর গ্রন্থটির পাঠ গ্রহণ প্রয়োজনীয় বলে আমি মনে করি।

টরন্টো, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯