বইমেলায় কি বাণিজ্যই মুখ্য হয়ে উঠছে!

বইমেলার উদ্বোধনী দিনে অভিভাবকদের সঙ্গে এসেছিল শিশুরাও। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।  ছবি: প্রথম আলো
বইমেলার উদ্বোধনী দিনে অভিভাবকদের সঙ্গে এসেছিল শিশুরাও। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ছবি: প্রথম আলো

আমার যতটুকু মনে পড়ে, স্বাধীনতার পর থেকেই ২১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমি কিছু আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। আগেও নিশ্চয়ই এরকম হতো, তবে তার স্মৃতি-অভিজ্ঞতা আমার নেই। মনে পড়ে এ উপলক্ষে যে জনসমাগম হতো, তাকে আমার পরিশীলিত ও সংস্কৃতিমান মনে হতো। এ রকম কেবল আমারই যে মনে হতো, তা নয়। নবীন বাংলাদেশে প্রধান প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারার কর্ণধার চিত্তরঞ্জন সাহার কাছেও এমনটা নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল। সে জন্যই তিনিও অনুভব করেছিলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণির যত মানুষের প্রতিনিধিত্ব এখানে ঘটে, একই সঙ্গে সামর্থ্যে ও চেতনায় তাদের পক্ষেই সম্ভব বইয়ের ক্রেতা হওয়া! এই অনুভবই কালক্রমে বাংলাদেশের সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী হয়ে উঠেছে। বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা বইমেলা আয়োজনের লক্ষ্যে না-হলেও বইমেলার আয়োজন তাই এখন বাংলা একাডেমির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অনেকে তো মনে করেন, এটাই বাংলা একাডেমির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কাজ।
পঞ্চাশের দশকের আগে ঢাকা যখন প্রায় মফস্বল শহর ছিল, তখনো এখানে বই প্রকাশিত হতো। দেশজুড়ে রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড ও হাট-বাজারভিত্তিক একটি বিপণন-সংযোগ বাংলাদেশে গড়ে উঠেছিল। কলকাতা, ঢাকা কিংবা আরও মফস্বলে প্রকাশকও ভিপিপি যোগে দেশের যেকোনো প্রান্তে বই পাঠতে পারতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায় এখন সেভাবে বিপণন সম্ভব হয় না। এখন যে বিপণন-ব্যবস্থা আছে তা ঐতিহ্যেরই সামান্য রূপান্তর মাত্র। এখন তো অমর একুশের এই বইমেলাই নগরবাসীর মধ্যে পুস্তকপ্রাপ্তির নির্ভরযোগ্য উপায়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে পুস্তক প্রকাশনায় নাই নাই করেও যতটা উন্নতি করেছে, যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে, তার তুলনায় বই বিপণনের কার্যকর ব্যবস্থা বলতে গেলে গড়েই ওঠেনি। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়া সত্ত্বেও ভিপিপি ব্যবস্থায় ডাকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বই পৌঁছে যাওয়ার উপায়টি যেমন ছিল সহজ, তেমনি ছিল ব্যয়সাশ্রয়ীও। আজকাল এই ব্যবস্থা আর কার্যকর নেই। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বই পাঠানোর প্রক্রিয়া বেশ ব্যয়বহুল। ফলে বাংলাবাজার থেকে সরাসরি সংগ্রহ করা ছাড়া বই সংগ্রহের নতুন উপায় অনলাইনভিত্তিক বই সরবরাহ।
বিচিত্র বিষয়ে যেসব বই আজকাল প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলোর সম্পর্কে পাঠকেরা বইমেলা ছাড়া কমই জানার সুযোগ পান। বইমেলা ছাড়া জ্ঞানার্থীদের অনেকেই আর জানতে পারেন না, কোন বই কোথায় পাওয়া যাবে। পাড়ার বইয়ের দোকানে স্কুলপাঠ্য বই ছাড়া বড়জোর অতি জনপ্রিয় দু-একজন লেখকের বই পাওয়া যায়। সুতরাং সাধারণ বই প্রেমীদের কাছে বই পৌঁছানোর আর কোনো উপায় রইল না। আমার ধারণা, অমর একুশের অনুভূতির সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক যুক্ত হওয়ায় বইপ্রেমীরা ধীরে ধীরে ব্যাপকভাবে বইমেলামুখী হয়ে উঠেছেন। এই অবস্থা গড়ে উঠেছে আমাদের এক ধরনের সাংস্কৃতিক স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্য দিয়ে। সে জন্যই বাংলা একাডেমির মেলা থেকে কেবল বই কেনাই উদ্দেশ্য থাকে না দর্শনার্থীদের। বই দেখা-কেনার অতিরিক্ত একটা উৎসবমুখরতা, একটা দেশপ্রেমের চেতনা এর সঙ্গে যুক্ত থাকে বলে এই মেলাকে নিছক একটা বই বিক্রির ব্যবসায়িক মেলা ভাবা একেবারেই ঠিক হবে না। সেই বিবেচনাতেই একুশের চেতনাগত ভাবমূর্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বইই থাকতে হবে এই মেলায়।
দেখা যায়, নগরবাসী, কেবল নগরবাসীই-বা বলি কেন, একুশের চেতনাগত কারণে সারা দেশের মানুষেরই প্রত্যাশা থাকে মেলায় আসার। লক্ষ্য নতুন নতুন বই দেখা, সামর্থ্য হলে কেনা। সাধারণ মানুষের এরকম প্রত্যাশা থেকেই বইমেলা বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। যেসব বিশেষত্বপূর্ণ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সারা বছর কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না, তারাও এই মেলায় তাঁদের স্টল নিয়ে আসেন। পেশাদার প্রকাশকদের প্রকাশনা ছাড়াও অনেক নবীন লেখকের বই নিজ উদ্যোগে বা বন্ধু-বান্ধবের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে অনেক ভালো বইও থাকে। ফলে বাংলা একাডেমির এই মেলা সারা বছরের সৃজন ও মননাকাঙক্ষার মেলা হয়ে ওঠে। সত্যিকারের পাঠকদের কাছে বাংলা একাডেমির বইমেলার কোনো বিকল্প নেই!
প্রায় সূচনালগ্ন থেকে প্রতি বছরই বইমেলায় আসার সুবাদে লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের বই বিপণনে এই মেলার ভূমিকা এখন যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার কারণ একাধিক। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বাংলা একাডেমির বইমেলার দিকে বেশ নজর দেয়। পত্রিকাগুলো হ্রাসকৃত মূল্যে বইয়ের বিজ্ঞাপন ছাপে। যেসব বই আসছে প্রতিদিন তার সংবাদ ছাপে। আশির দশকের একেবারে প্রথমদিকে বইমেলা ছিল বেশ ছিমছাম ও খোলামেলা। গুটিকয় স্টল বসতো। এখন মেলায় আগত মানুষের সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। বেড়েছে স্টলের সংখ্যা। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ এখন আর যথেষ্ট হয় না। পুস্তক প্রকাশনা তো একটা ব্যবসা। বইমেলায় যাঁরা স্টল দেন তাঁদেরও দাবি এর পরিসীমা বাড়ানোর। সেই সূত্রেই বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ ঘটেছে। আরেকটি সম্প্রসারণ ঘটেছে দেশের বাইরে অবস্থানকারীদের দিক থেকে। স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও ইন্টারনেট মাধ্যমে এই বইমেলা প্রবাসী বাঙালিরও প্রাণের মেলা হয়ে উঠেছে। দেশের বাইরে থেকেও এই বইমেলায় নিজের একটা বই হাজির করার ইচ্ছে এখন অনেকেরই প্রবল। উত্তর আমেরিকাবাসী বাংলাভাষী অনেক লেখকই এখন বইমেলা উপলক্ষে দেশে ফেরেন। নিজেদের বই যেমন এখানে হাজির হয়, তেমনি বই সংগ্রহ করে অনেকে নিয়ে যান দূরদেশে।
মনে পড়ছে, আশির দশকের গোড়ার দিকে সে সময়কার হিসাবে মেলায় নিশ্চয়ই বই বিক্রি হতো, কিন্তু বিক্রিটাই বড় ব্যাপার ছিল না। কয়েক বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি বেশ বদলে যেতে থাকল। ১৯৮৪ সাল থেকে পেয়ে গেল বেশ একটা বিশাল রূপ। ক্রমশ মনে হতে লাগল, বিপণনের আকাঙ্ক্ষা এতে প্রবল হয়ে উঠছে। যতই সময় যেতে লাগল, মেলার অন্যান্য দিক উপেক্ষা করে প্রকাশকদের মধ্যে ততই বিপণনাকাঙ্ক্ষা যেন হয়ে উঠতে লাগল বড়।
এই মেলায় দীর্ঘকালের যাওয়া–আসার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একুশের মর্মগত ভাবমূর্তি রক্ষা করার চেয়ে বাণিজ্যের দিকেই বইমেলার অভিমুখ তীব্র হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য বাস্তবতা হলেও মর্মগত দিকে আরও আন্তরিক নজরদারি দরকার। অমর একুশে বইমেলা যেন আমাদের বাঙালিত্বের বোধকে শাণিত রাখতে পারে, তার জন্য বিপণনাকাঙ্ক্ষার চেয়ে উৎকর্ষের আকাঙ্ক্ষাকে তীক্ষ্ণতর করে তুলতে হবে। যাঁরা বিদেশে বসে বাংলার চর্চা করেন, তাঁদের কাছে এই বইমেলা অনেক প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। এই জন্যও উৎকর্ষ অর্জনের আগ্রহকেই তীব্রতর করে তুলতে হবে আমাদের!