মীরজাফরের খাবারের লোভ

কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে নূরুন নবী
কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে নূরুন নবী

[এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমাদের প্রিয় এই বাংলাদেশ। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে কেউ কেউ সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, আবার কেউ অংশ নিয়েছিলেন পরোক্ষভাবে। আমাদের আজকের পর্বের লেখক ড. নূরুন নবী একজন মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, লেখক, বিজ্ঞানী এবং উত্তর আমেরিকার নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের কাউন্সিলম্যান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের মে ৬ ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ সংখ্যায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং তাঁর ডান হাত নূরুন নবীর ওপর প্রতিবেদন করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা নূরুন নবীকে ‘ব্রেইন অব দ্য ফোর্স’ উল্লেখ করা হয়েছে। টাঙ্গাইলের বিখ্যাত টাইগার কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর অন্যতম সহযোদ্ধা নূরুন নবী। তাঁর অনেক পরিচয়। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এবার আমরা তাঁর মুখেই শুনব এক মরণপণ যুদ্ধের গল্প। ড. নূরুন নবী বর্তমানে উত্তর আমেরিকার নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যে বসবাস করছেন।]

গল্প ১২

একজন মীরজাফর ও পাঁচ শ মুক্তিযোদ্ধার বিপর্যয়

ভোর চারটার দিকে আমরা টাঙ্গাইল-মধুপুর সড়কের পূর্বে গর্জনা-গ্রামের কাছে পৌঁছলাম। শত্রুসেনা অবিরত সড়কপথ টহল দিচ্ছে। রাতের অন্ধকার ছাড়া সড়ক অতিক্রম করা নিরাপদ নয়। তাই টাইগার সিদ্দিকী গর্জনা গ্রামে সারা দিন বিশ্রাম নিয়ে রাতে সড়ক অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নিলেন। গর্জনা গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে বিভক্ত হয়ে আমরা বিশ্রামের জন্য আশ্রয় নিলাম। আমাদের পাশে যে বাড়িতে টাইগার সিদ্দিকী আশ্রয় নিলেন, সেটার মালিক একজন বিডি-মেম্বার। তিনি মুক্তিবাহিনীর সেবার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য হয়েছেন বলে আমাদের জানালেন। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চিড়া মুড়ি খেতে দিলেন এবং খাশি জবাই করে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে তার লোকজনকে নির্দেশ দিলেন। তিনটি খাশি জবাই হলো। রান্নার প্রস্তুতি চলছে মন্থর গতিতে। ইতিমধ্যে খবর পাওয়া গেল, বেনু ও খোরশেদ আলমের কোম্পানি রাতে সড়ক অতিক্রম করতে না পেরে আমাদের মতো ওরাও গর্জনা গ্রামের অন্যদিকে অবস্থান নিয়েছে। টাইগার সিদ্দিকী খোরশেদ ও বেনুকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
গর্জনা গ্রামের এই অঞ্চলটি অতি নিচু বলে বর্ষাকালে চারদিকে শুধু পানি আর পানি। এক-একটি বাড়ি যেন একেকটি দ্বীপ। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি এবং এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাতায়াতের একমাত্র উপায় নৌকা। বেলা ১১টা বেজে গেল কিন্তু রান্না শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। টাইগার সিদ্দিকীর মনে সন্দেহ জাগল। তিনি লক্ষ্য করলেন, বাড়ির মেয়েরা হাতে পোঁটলা-পুটলি নিয়ে চুপি চুপি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সন্দেহ আরও গভীর হলো। তিনি গোয়েন্দাবিভাগের সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকে জানতে পারলেন, বাড়ির মালিক বিডি-মেম্বার কট্টর পাকিস্তান সমর্থক। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ টাইগার সিদ্দিকীর মাথার জন্য এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। বিডি মেম্বর সেই টাকার লোভে ঘাটাইলে অবস্থিত পাকিস্তানি ঘাঁটিতে খবর পাঠিয়েছে টাইগার সিদ্দিকীর অবস্থানের কথা।
দুপুর বারোটার দিকে টাইগার সিদ্দিকী দুরবিন দিয়ে দেখতে পেলেন, ১০/১২টি নৌকা বোঝাই পাকিস্তানি সৈন্য ঘাটাইল ব্রাহ্মণশাসনের দিক থেকে গর্জনা গ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন। খোরশেদ আলম ও বেণুকে তাদের অবস্থানে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি ২০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে বিডি-মেম্বারের বাড়ির পাশে একটি উঁচু মাটির ঢিবি ও খড়ের গাদার আড়ালে অবস্থান নিলেন। আমি, বুলবুল খানসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে টাইগার সিদ্দিকীর অবস্থান থেকে দূরে একটি বাড়িতে অবস্থান নিলাম, প্রয়োজনে টাইগার সিদ্দিকীর অবস্থানকে কভারিং ফায়ার দেওয়ার জন্য।
শত্রুর দশটি নৌকা টাইগার সিদ্দিকীর অবস্থানের কাছে আসার আগে দুভাগ হয়ে খোরশেদ ও বেনুর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের কাছাকাছি আসতেই প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হল। স্টেনগান, এলএমজি, রাইফেল ও গ্রেনেডের শব্দে চারদিকে কম্পিত হতে থাকে। গোলাগুলির মধ্যে শত্রুসেনারা নৌকা থেকে নেমে খোরশেদ আলমের অবস্থানের পেছনে একটি বাড়িতে অবস্থান নিয়ে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ চালাতে থাকে। বেনু তার অবস্থানে পৌঁছবার আগেই আক্রান্ত হন। কিন্তু তাঁর দলের সদস্যরা শত্রুসেনার ওপর আক্রমণ চালায়।
প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। যুদ্ধ অনেকটা মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে। হঠাৎ ক্যাপ্টেন খোরশেদ দেখতে পান, তার অবস্থানের খুব কাছেই বাড়ির পূর্বপাশে দুজন পাকিস্তানি সৈন্য হামাগুড়ি দিয়ে অবস্থান পরিবর্তন করছে। তিনি আড়াল থেকে এগিয়ে এসে ওদের ওপর যখন ব্রাশফায়ার করছিল, তখন অন্যদিক থেকে শত্রুর দুটি গুলি এসে তাঁর হাতে ও পেটের ডানপাশ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। খোরশেদ গুরুতর আহত হন। সহযোদ্ধা জাহাঙ্গীর তাঁকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসেন।
খোরশেদ ও বেনুর কোম্পানির হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে শত্রুসেনা নৌকাযোগে টাইগার সিদ্দিকীর অবস্থানের পাশ দিয়ে ঘাটাইলে ফিরে যাচ্ছিল। এক ঘণ্টার যুদ্ধে টাইগার সিদ্দিকীর কোনো আক্রমণের সুযোগ ছিল না। এবার সেই সুযোগ এল। নৌকাগুলো নিশানার মধ্যে এলেই টাইগার সিদ্দিকীর এলএমজি গর্জে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। মাত্র পাঁচ মিনিটের যুদ্ধে খানসেনাদের ৫টি নৌকা ডুবে গেল। বাকি নৌকাগুলো পিছু হটে কভারিং ফায়ার দিতে দিতে ঘাটাইল ফিরে গেল। শত্রুসেনার ৭টি লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। নৌকা ডুবে কতজন সেনা মরেছিল সেটা জানা সম্ভব হয়নি।
ইতিমধ্যে টাইগার সিদ্দিকী গলগন্ডা ও রতনপুরের পশ্চিমে এক গ্রামে সবাইকে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলেন। আহত খোরশেদ ও বেনুর দলের ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা আসলত, স্মৃতি, মতি, আনিস, কামাল ও মিন্টু অসীম সাহসে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় গুলির অভাবে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন। তাঁদের সবাইকে উদ্ধার করতে কালিহাতী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ৪০/৪৫ বছর বয়সী খন্দকার নূরুল ইসলাম যে সাহস দেখিয়েছিলেন, তার তুলনা হয় না। বেলা দুইটার দিকে টাইগার সিদ্দিকীর সঙ্গে আমরা রতনপুরে আহত খোরশেদকে দেখতে গেলাম। আহত হওয়ার পর তাঁর কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। আমি যুদ্ধের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের স্নাতকের ছাত্র ছিলাম। দু-একটা ইঁদুর কাটা দেখেছি। কিন্তু একজন সহযোদ্ধার ক্ষতস্থান দেখে এমন হতচকিত হব, তা ভাবতে পারিনি। খোরশেদ ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। কাদের সিদ্দিকী তাঁকে আশ্বাস দিলেন, আমাদের প্রাণ থাকতে ওর চিকিৎসা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি হবে না। তিনি আমাকে ও বুলবুল খানকে তাঁর চিকিৎসা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব দিলেন। রাতে সড়ক অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত হলো।
আমরা পোড়াবাড়ি পাকুটিয়ার পশ্চিমে একটি গ্রামে অপেক্ষা করছি। সবাই ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত। ১২ আগস্ট হেডকোয়ার্টার থেকে রওনা হওয়ার পর ঠিকমতো খাওয়া হয় নাই। টাইগার সিদ্দিকীর দলের মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা ইতিমধ্যেই সবার ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি দ্রুত এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে যেতেন বলে আমাদের ২০/২৫ মাইল হাঁটা অভ্যাস হয়েছে। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা যুদ্ধের চাপ ও খাবারের সময়ের অভাবে আমরা সবাই ক্লান্ত। কখন সূর্য অস্ত যাবে—এই ভেবে ক্ষণ গুনছিলাম।
এদিকে শত্রুসেনা ১৩ আগস্ট থেকে টাঙ্গাইল-মধুপুর সড়কে বিশেষ করে মাদ্রাসার কাছে আমাদের পূর্বনির্ধারিত সড়কপথে অবিরাম টহল দিয়ে যাচ্ছে। শত্রুকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য প্রচার করা হলো, আমরা আজ রাতে মাদ্রাসার কাছে রাত ২টায় সড়ক অতিক্রম করব। কিন্তু টাইগার সিদ্দিকী গোপনে সবাইকে মাদ্রাসা থেকে কয়েক মাইল উত্তরে পাকুটিয়া পোড়াবাড়ির একটু পশ্চিমে সন্ধ্যার পর জমায়েত হতে নির্দেশ দিলেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর খবরে জানতে পারলাম, শত্রুসেনা উত্তর-দক্ষিণে গাড়িতে টহল দিচ্ছে পনেরো মিনিট পরপর। তাই মাত্র এই পনেরো মিনিটের ফাঁকে আমাদের সড়ক অতিক্রম করতে হবে।
আমরা সন্ধ্যার পর ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সড়কের তিন শ গজ পশ্চিমে একটি জঙ্গলে অপেক্ষা করতে থাকলাম। রাত দশটার দিকে সড়ক অতিক্রমের প্রস্তুতি নিলাম। টহলরত শত্রুর গাড়ি পার হয়ে যাওয়ার পর বেনুর কোম্পানির দুটি দল সড়কের উত্তরে ও দক্ষিণে রক্ষণব্যূহ রচনা করল। প্রথমে মালপত্র নিয়ে তিনটি বড় দল ধানখেতের পাশ দিয়ে অতি দ্রুত অথচ সন্তর্পণে সড়ক অতিক্রম করে গেল।
দ্বিতীয় দলে আহত খোরশেদকে নিয়ে আমি, বুলবুল খান মাহবুব অগ্রসর হচ্ছি। খোরশেদকে একটি তক্তার ওপর শুইয়ে দিয়ে চাঙারির মতো করে চারজন মুক্তিযোদ্ধা কাঁধে নিয়ে যাচ্ছিল। ধানের শিষগুলো তাঁর গায়ে লাগছিল বলে মুক্তিযোদ্ধারা দুহাত উঁচু করে চাঙারির মতো উঁচুতে ঝুলিয়ে ধানখেত পার হলো। সড়ক অতিক্রম করতে আমাদের একটু বেশি সময় লেগে গেল। আমি সড়কের এপারে ধানখেতের আড়ালে বসে রইলাম পরবর্তী দলগুলোকে পথ দেখানোর জন্য। অন্যদিকে টাইগার সিদ্দিকী সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে সড়ক অতিক্রম তত্ত্বাবধান করছিলেন। সব মুক্তিযোদ্ধা সড়ক পার হওয়ার পর তিনি সড়ক অতিক্রম করে আমার অবস্থানে এসে মিলিত হন। প্রায় ১৫ মিনিটের মধ্যে আমরা সবাই সড়ক অতিক্রম করার পর রক্ষণব্যূহ রচনাকারী মুক্তিবাহিনীর দুটি দল কিছুটা উত্তর ও কিছুটা দক্ষিণ দিক দিয়ে সড়ক অতিক্রম করে। আমরা সড়কের তিন-চার মাইল পূর্বপাশে একটি গ্রামে একজন বিডি-মেম্বরের বাড়িতে এসে উঠলাম। খোরশেদকে এখানেও কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেল না। শুধু ক্ষতস্থানে নতুন করে ব্যান্ডেজ করা হলো এবং গরম দুধ খাওয়ানো হলো। আমরা সবাই পেটভরে খেলাম। ১১ আগস্ট রাত থেকে তিন দিন এই প্রথম পেটে ভাত পড়ল। ডালভাত যে এত সুস্বাদু হতে পারে, তা আগে জানা ছিল না। টাইগার সিদ্দিকী আবারও খোরশেদের চিকিৎসা ও নিরাপত্তার দায়িত্বের বিষয়টি আমাকে ও বুলবুলকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। ১৫ আগস্ট ভোর চারটায় প্রায় তিন দিন ও তিনরাত পর বিডি মেম্বারের কাছারিঘরে মেঝেতে বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়লাম।
কয়েক দিনের সাধারণ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অসাধারণ সাহায্য ও সহযোগিতা, মুক্তিবাহিনীর অপরিসীম সাহস ও ত্যাগের গৌরবময় স্মৃতি এবং একজন বাঙালি মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় তিক্ত ও ঘৃণ্য অভিজ্ঞতার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। (চলবে)