জোটবদ্ধ শাসানিতে বীরও ডরায়

১৯৯৩ সালের অক্টোবরে দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিলাম যুক্তরাজ্যে। বিরাট আর্থিক বিপর্যয় মোকাবিলায় ছিল এই দেশত্যাগ। লন্ডনে নানা কসরত আর নাটকের পর সোজা চলে গেলাম বন্ধু হুমায়ুনের ডেরায়। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ পশ্চিমে সাগর তীরের ছোট্ট একটি শহর, পেইংটনে। ইন্টারসিটি ট্রেনে লন্ডন থেকে নিউটন এবোট নামের এক মাঝারি শহরে প্রথম যাত্রাবিরতি।
সেখান থেকে সাগরের পাড় দিয়ে যাওয়া রেলপথ ধরে লোকাল ট্রেনে গাঙচিলের শহর পেইংটন। হাজার দশেক ইংরেজের বাস সেই শহরে। আর সেখানে বন্ধু খুলেছে ‘গ্রিন মাংকি’ নামের ভারতীয় খাবারের দোকান। বসে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। ফোনে অর্ডার করে নিজে এসে খাবার সংগ্রহ করতে হয়। স্টেশনে নেমেই সাক্ষাৎ তিনজন অভ্যর্থনাকারীর সঙ্গে। এদের একজন ছোট বেলার বন্ধু হুমায়ূন আর বাকি দুজন হাছা মিছা নামের ওর প্রিয় দুটি পোষা কুকুর। একটি বনেদি জাতের জার্মান শেফার্ড অন্যটি হিংস্র বলে খ্যাত রুথ ভায়লার। ভয় পেয়েছি দেখে অভয় দিয়ে বন্ধু বলল, ভয় পাসনে। ওরা কালোদের কিছু বলে না। মালিক কালো কিনা তাই! তবে সাদা ইংরেজদের নাকি কখনো কখনো সুযোগ পেলে ভয় দেখায়। খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে বিপর্যয়ের সব কাহিনি খুলে বললাম বন্ধু হুমায়ূনকে।
সব শুনে কাজ দিল, আশ্রয় দিল। সবচেয়ে মূল্যবান যে জিনিস তা হল আমায় অভয় দিল এবং পিঠ চাপড়ে সাহস জোগাল। সব শুনে বলল, সঠিক সিদ্ধান্তে সঠিক জায়গায় এসেছিস। এক অঙ্ক ম্যাজিক গুণে আশি হয়ে যায়। জীবনে তো কাজ করিসনি, এখন বুঝবি কত ধানে কত চাল। মাথা ঠান্ডা করে যুদ্ধে নেমে যা। একদিন সফল হবি। এতে কোনো সন্দেহ নেই। মাঝে অনেক ঘটনা আর রাজ্যের গল্প, সঙ্গে নানা অভিজ্ঞতা নিজ ঝুলিতে জমা হচ্ছে। শুধু চই পিঠা খাওয়ার গল্পটি বলি।
সপ্তাহের প্রথম দিকে দুজনে কিচেনে বসে গল্প করছি। হঠাৎ হুমায়ূন বলল, দোস্ত চই পিঠা (সিলেটী) বানাতে পারিস? যদি আমার পছন্দ মতো চই পিঠা বানিয়ে খাওয়াতে পারিস তবে ৫০ পাউন্ড পাবি। শুনে আমার চোখ ছানাবড়া। বললাম, দেখি পারি কিনা! হ্যাঁ, পেরেছিলাম চই পিঠা বানিয়ে বন্ধুকে খাওয়াতে। চালের গুঁড়ি দিয়ে পিঠা বানিয়ে স্টিম দিয়ে ফিনিশিং। তারপর চুলা থেকে নামিয়ে ঠান্ডা করে ছোট ছোট করে কেটে খাঁটি ঘি দিয়ে মচমচে করে ভেজে যখন খেতে বসলাম, তখন কেউ কারও দিকে তাকাতে পারিনি। নীরবে দুজনের চোখের অশ্রু সেই পিঠাতে মিশে গিয়ে পিঠার স্বাদ নোনতা করে দিল। কারণ দুজনের মা-ই জানতেন মচমচে করে এই চই পিঠা ভাজা তাদের সন্তানদের বড়ই প্রিয় ছিল।
মাঝে কোনো এক কারণে লন্ডন চলে যাই। চেষ্টা করলাম ভালো কিছু করার, তা আর হয়নি। ফিরে আসার সময় বন্ধু বলেছিল, যেকোনো সময় চলে আসিস। আমার দরজা তোর জন্য সব সময় খোলা। এবার আসার পর তাঁর এক বন্ধুর কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিল। তাঁরা দুই ভাই আমার ভালো বন্ধু। আমাকে যেভাবে দেখে তোকেও তেমনি দেখবে। ট্যাক্সি ভাড়া করে নিজে এসে নামিয়ে দিয়ে গেল ব্রিটেনের মাটিতে আমার দ্বিতীয় কাজের জায়গা ‘দ্য গ্যাঞ্জেস’ নামের ভারতীয় রেস্টুরেন্টে।
মালিক দুই ভাই। বাহার ভাই বড় এবং ছোট শাহার। দুজনে মিলে রেস্টুরেন্ট চালাতেন অভিজ্ঞ হাতে। দারুণ ভালো মানুষ আর প্রচণ্ড আড্ডাবাজ। বাহার ভাইয়ের নিজের আরেকটি রেস্তোরাঁ ছিল সাগর তীরের অন্য এক শহর এক্স মাউথে। থাকার ব্যবস্থা গ্যাঞ্জেসের ওপরে দ্বিতীয় তলায়। প্রথম তলার এক রুমে থাকেন আমার মতো আরেক গণেশ উল্টানো পাউন্ড-ডলারের ব্যবসায়ী সিলেটের মাহতাব চৌধুরী। বড় অঙ্কের টাকা ঋণ করে সব লোকসান দিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভায়রার ছেলেদের রেস্টুরেন্টে। তবে বুদ্ধি করে শেফের কাজ শিখে নেওয়ায় স্থায়ী চাকরির সঙ্গে ভালো অঙ্কের বেতন পাচ্ছেন। শেফের গুরুত্বানুযায়ী ওপরের একমাত্র টিভি তাঁর কক্ষে। কাজ শেষে ঘুমাতে যাওয়ার আগে স্কাই চ্যানেলে দেশ-বিদেশের খবরাখবর দেখি। কখনো পুরোনো রেকর্ডকৃত খেলা। সেই সময় এখনকার মতো এতো টিভি চ্যানেল ছড়াছড়ি ছিল না। প্রথম দিন বেশ আদর আপ্যায়ন করলেন। নিজ হাতে কমলা ছুলে ছুলে হাতে দিলেন। আকার-ইঙ্গিতে নানা বিষয় জিজ্ঞেস করাতে বুঝলাম, আমার কেস ওনার জানা হয়ে গেছে।
কথার ফাঁকে ঋণমুক্তির লড়াইয়ে মাহতাবের কাছে দারুণ একটি টিপস পেয়েছিলাম। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, ঋণগ্রস্তরা কখনোই ঋণের আসল অঙ্ক বলে না। আশঙ্কা, লোকে ভয় পেয়ে সরে যাবে। একমাত্র সে নিজেই জানে, মোট ঋণের পরিমাণ কত? মাহতাব চৌধুরী ডেকে বললেন, মোট ঋণের পরিমাণ কাউকে না বলে একদম ছোট অঙ্ক দিয়ে শুরু করে সর্বশেষ বৃহৎ অঙ্কটি বসিয়ে একটি তালিকা বানান। মউয়াজির (শাহার ভাই ডাকতেন) পরামর্শে বানানো তালিকার শুরুতে ছিল, পাড়ার মুদি দোকানের বাকি ২০ টাকা আর তালিকার সর্বশেষ পরিমাণ পূবালী ব্যাংকের ১৬ লাখ টাকা।
সালটা তখন ১৯৯৩। এখনকার মতো দেশে আনিছ আলীরা (ঋণ খেকো) ছিল না। ব্যাংকের ঋণের টাকা ফেরত দিত হতো। এখন দিতে হয় না। জায়গামতো কমিশন দিলে আর ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে সব মাফ হয়ে যায়। দ্বিতীয় তলার দুই রুমের একটিতে আমি আর পাশের রুমে দুজন গায়ানিজ ভারতীয় ছিল, যাদের পর্তুগালে কাজের অনুমতি ছিল। সে সুবাদে যুক্তরাজ্যে কাজ করতে পারত। রেস্টুরেন্টে দুপুরের মেন্যুতে মাছ ও রাতের ডিনারে থাকত মাংস। বেশির ভাগ সময়ে মুরগি রান্না হলেও মাঝে মাঝে রান্না হতো সুস্বাদু ভেড়ার মাংস।
রাতের খাবার কখনো শাহার ভাই নিজে রান্না করতেন। ভীষণ মজাদার হতো তাঁর রান্না। কারণ তিনি নিজে ছিলেন সাউথ ওয়েস্ট অঞ্চলের পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন ভালো শেফ। একদিন দেখি, বেশ ঘটা করে কবুতর রান্না হচ্ছে। প্রায় ৮/১০টি কবুতরের ভুনা। দামি শেফের নানাবিধ মসলার ম্যাজিক মিশ্রণে পুরো রেস্টুরেন্ট মৌ মৌ করছে। সামনে পেছনের সব কর্মীদের যেন আর তর সইছে না। কখন রাতের খাবার খেতে বসব সবাই। শুরু হলো বিদেশের মাটিতে প্রথম কবুতরের মাংস খাওয়ার পর্ব। কবুতর ভুনা বরাবর আমার প্রিয় খাবার। ১৯৭৪-৭৫ সালে চট্টগ্রামে ফিরিঙ্গি বাজারের বার্মা রাজু হোটেলে যেতাম কবুতর ভুনা খেতে। একটি আন্দাজ সাইজের কবুতর ভুনার দাম রাখত ১০ টাকা। ডাল-ভাত ফ্রি। ইচ্ছে মতো খেতে থাকুন। প্লেটের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত লেজ মাথাসহ গলদা চিংড়ির দাম ১০ টাকা। ডাল-ভাত ইচ্ছে মতো। শেফ মউয়াজিকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় পেলেন এত মজার কবুতর? হেসে উত্তর দিলেন, আপনার বাসা থেকে আনা। রহস্য ধরতে না পেরে মজা ভেবে সবার সঙ্গে আমিও হাসলাম। খোলাসা হলো পরের দিন। কানে কানে বলে দিলেন কোথায় পাওয়া যায় কবুতর। সব শুনে না চমকালেও দুদিন পর রাতে শাহার ভাইয়ের সঙ্গে লং ড্রাইভে যাওয়ার সময় শাহার ভাইয়ের হাতে কালো একটি ব্যাগ দেখে রহস্যের উত্তর পেয়ে গেলাম। এত ঝামেলা ঝক্কি করে কবুতর খেতে হয়? না-রে বাবা আমি এসবে নেই।
দুই সপ্তাহ পর মউয়াজির রুমে বসে টিভি দেখছি। জিজ্ঞেস করলেন, কবুতর খাইতা নি? আমার হ্যাঁ বা না জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন, আসেন আমার সঙ্গে, দেখিয়ে দিই কোথায় পাবেন কবুতর। ওনার পিছু পিছু হাঁটছি। মউয়াজি ঢুকলেন আমার রুমে। রাস্তার পাশের দিকের জানালা খুলে নিচে তাকাতে বললেন।
ও মা ! নিচে তাকিয়ে আমি হতবাক। শত শত ছোটবড় কবুতর বিল্ডিংয়ের কার্নিশে বসা। সময় নষ্ট না করে দেখিয়ে দিলেন কীভাবে কবুতর ধরতে হয়। জানালা খুলে ভেতরের মেঝেতে চাল নয়তো বিস্কুট রেখে দিলে আধা ঘণ্টার মধ্যে ৩০/৪০টি ছোট বড় কবুতর রুমে ঢুকবে। জানালার কাচ ফেলে ছোটগুলো মানে বাচ্চাগুলো রেখে বেশি বয়সের মা কবুতরদের ছেড়ে দিতে হবে। পরদিন শেফ সাহেব নিজ এসে ছড়িয়ে দিলেন চাল আর বিস্কুট। বলে গেলেন, ১০/১২টি বাচ্চা ধরে বড়গুলো ছেড়ে দিতে। মনে মনে খুঁত খুঁত আবার ভুনা খাবার লোভ—দুটো পাশাপাশি চালু রেখে ৮/১০টি বাচ্চা ধরে বড়গুলো ছেড়ে দিলাম। মধ্যরাতে কবুতর ধরা পর্ব সেরে ঘুমাতে গেলাম রাত দেড়টার দিকে। ঠিক এক ঘণ্টা পর রুমের জানালার কাচে পাখা ঝাপটানোর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানার পাশের লাইট জ্বালিয়ে উঠে জানালার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইলাম ঘটনা কি?
জানালার দিকে একবার তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। এ কি? শত শত লাল লাল কবুতরের রাগত চোখ যেন জানালার কাচে সেটে আছে। দু-চারটি বা ১০-২০টি নয়। জানালার চিলতে কার্ণিশে আমার দিকে চোখ লাল করে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শত শত কবুতরের দল। যারা বসতে পারছে না। তাদের কেউ কেউ এসে জানালার কাচে আছড়ে পড়ে পাখা দিয়ে জাপটাচ্ছে। আমি স্পষ্টত তাদের চোখের ভাষা পড়তে পারছি। ওরা যেন বলছে ওহে মাংস খেকো অবিবেচক, গরু-ছাগল-ভেড়া-মুরগি সব খেয়েও তোমরা তৃপ্ত নও। এখন খেতে শুরু করেছ আমাদের সন্তানদের। তোমাদের রসনার এই আগ্রাসন থেকে কেউ কি রক্ষা পাবে না? তুমি কি ভুলে গেছ, তুমি নিজেও দুটো কচি কচি সন্তানের বাবা! আর তুমি কিনা আটকে রেখেছ আমাদের প্রিয় সন্তানদের। কোনো বিবেচনায় আমাদের সন্তানদের হত্যা করে শরিক হবে হাড়-মাংস চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়ার উৎসবে। বন্ধ করো এসব অমানবিক কাজ। যদি ভালো চাও, ছেড়ে দাও আমাদের এই নিরপরাধ সন্তানদের।
বিশ্বাস করুন, আজও সেই সারিবদ্ধ কবুতরের লাল লাল চোখের রাগত চাহনি যখন আমার স্মরণে আসে, পুরো শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। জোটবদ্ধ রক্ত হিম করা লাল চোখের চাহনিতে এত শক্তি থাকতে পারে, তা আমার অজানা ছিল। আর সেই ভয় আমাকে বাধ্য করেছিল কালক্ষেপণ না করে ডিসেম্বরের তীব্র শীতের রাতে সব কটি জানালা খুলে দিতে। জানালা খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের কোণে জড়সড় হয়ে থাকা বাচ্চা কবুতরগুলো এক সঙ্গে উড়ে উড়ে জানালা দিয়ে মুক্ত আকাশে ফিরে গেল। একসঙ্গে উড়ে গেল চিলতে কার্নিশে বসা শত শত মা কবুতর। রসনা সংযত করার এই শিক্ষা পেয়ে মনে হলো, এ ঘটনা থেকে শুধু জানাই হলো না, বুঝতে পেরেছিলাম—জোটবদ্ধ হয়ে শাসাতে জানলে, বীরের বুকেও কাঁপন ধরে যায়।